রেজাউল করিম খোকন

  ২০ নভেম্বর, ২০২৩

মতামত

‘স্মার্ট বাংলাদেশের’ জন্য অপার সম্ভাবনাময় সমুদ্র খাত

বিশ্বব্যাংকের তথ্য মোতাবেক, বিশ্বের ধনী দেশগুলোর ৯০ ভাগই ২০২২ সাল নাগাদ মহামারির আগের অর্থনৈতিক অবস্থায় ফিরে যাবে। পর্যাপ্ত টিকাপ্রাপ্তির কারণে ধনী দেশগুলোর অর্থনীতি এত বেশি দ্রুত বেড়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তবে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর উত্তরণের গতি অনেক ধীর। ফলে মহামারি-পরবর্তী বিশ্বে ধনী ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বৈষম্য অনেক বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের মতো নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য সমুদ্রসম্পদ আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি করা মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠায় সহায়ক। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দেশের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সমুদ্রসম্পদ আহরণের প্রতি জোর দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন। এখনো বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ ব্লু ইকোনমি থেকে আসে। এটার পরিমাণ বার্ষিক ৯৬০ কোটি ডলার। তবে এই খাত থেকে আয়ের সম্ভাবনা অবারিত। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো আয় হয়। সমুদ্রের শুধু মাছ রপ্তানি থেকেই ১০-১২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। অনেকে সমুদ্র অর্থনীতি সম্পর্কে খুব ভালো জানেন না। তাই তারা বিনিয়োগ করতে চান না। আবার কেউ কেউ মনে করেন, রাষ্ট্রীয় পলিসি এ খাতে বিনিয়োগে সহায়ক নয়। সমুদ্র-যোগাযোগ পথ ও সমুদ্র পরিবহন, মৎস্যসম্পদ, খনিজসম্পদ, জ্বালানি নিরাপত্তা, জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজভাঙা শিল্প, দক্ষ জনবল সরবরাহ, পর্যটন ও পরিবেশ সংরক্ষণ করে সমুদ্রসম্পদ আহরণ করা যায়। ব্লু ইকোনমি থেকে বিপুল আয়ের অপার সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে। কিন্তু কাজে লাগানো যাচ্ছে খুব সামান্য। সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হওয়ার পর বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশ বছরে ৯৬০ কোটি ডলারের সম্পদ আহরণ করছে। যদিও সম্ভাবনা আকাশচুম্বী। কোনো কোনো পরিসংখ্যানে বছরে আড়াই লাখ কোটি ডলারের সম্পদ আহরণ সম্ভব। সমুদ্রসম্পদ আহরণে সমন্বিত পদক্ষেপের অভাবে বিপুল সম্ভাবনা হাতছাড়া হচ্ছে। বিশেষ করে সমুদ্র খাতে বিনিয়োগ সীমিত। সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হওয়ার প্রায় ৭ বছর পরও সমুদ্রসম্পদ আহরণে তেমন অগ্রগতি হয়নি। ছিটেফোঁটা কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার বাস্তবায়নের গতি খুবই ধীর। কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে সমুদ্রসম্পদ আহরণে সব উদ্যোগ বলতে গেলে থেমে গেছে। বঙ্গোপসাগর আমাদের অর্থনীতির জন্য অনেক সম্ভাবনার আধার হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। মূল্যবান খনিজসম্পদ ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বাংলাদেশের অগভীর ও গভীর সমুদ্রের তলদেশে। ১৩টি জায়গায় আছে সোনার চেয়ে দামি বালি। যাতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমানাইট, জিরকন, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইট। অগভীর সমুদ্রে বিপুল পরিমাণ সিমেন্ট তৈরির অন্যতম কাঁচামাল ‘ক্লে’র সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে ইলমেনাইট, গার্নেট সিলিমানাইট, জিরকন, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইট-সমৃদ্ধ ভারী খনিজ বালু পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের সমুদ্র ভাগেও বড় ধরনের গ্যাসের মজুদ রয়েছে। ব্লু ইকোনমি ও নীল সমুদ্রের অর্থনীতির সম্ভাবনা-সংক্রান্ত অনুসন্ধানী রিপোর্ট থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী অগভীর সমুদ্রের তলদেশে কোবাল্ট, ভানাডিয়াম, মলিবডেনাম ও প্ল্যাটিনাম নামে গঠিত ম্যাঙ্গানিজ ক্রাস্ট এবং তামা, সিসা, জিংক, কিছু পরিমাণ সোনা ও রুপা দিয়ে গঠিত সালফাইডের অস্তিত্ব রয়েছে। এসব অতি মূল্যবান সম্পদ সমুদ্রের ১৪০০ থেকে ৩৭০০ মিটার গভীর তলদেশে রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশ শুধু অপার খনিজসম্পদেই পূর্ণ নয় ৩০ থেকে ৮০ মিটার গভীরতায় এক ধরনের ক্লের সন্ধান পাওয়া গেছে। অগভীর সমুদ্রের এই ক্লে উত্তোলন করা গেলে বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্পে বিপ্লব ঘটে যাবে। কারণ ক্লে সিমেন্ট উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল। সাগরে মূলত দুই ধরনের সম্পদ রয়েছে। এগুলো হলো প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদ। প্রাণিজ সম্পদের মধ্যে মৎস্য ও সামুদ্রিক নানা প্রাণী, লতাগুল্ম প্রভৃতির কথা বলা যায়। বঙ্গোপসাগরে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ এখনো যথেষ্টভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি নানা সীমাবদ্ধতার কারণে। যদি পরিপূর্ণভাবে বঙ্গোপসাগরে মৎস্যসম্পদসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী মূল্যবান লতাগুল্ম আহরণের মাধ্যমে এগুলো যথাযথ প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে রপ্তানি পণ্য তালিকায় এগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করতে পারে। এমনিতেই রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনায়ন এবং রপ্তানি বাণিজ্যের বহুমুখীকরণে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগরের প্রাণিজসম্পদ বিরাট উৎস হয়ে উঠতে পারে। বঙ্গোপসাগরে অপ্রাণিজ সম্পদের শেষ নেই। অপ্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে তেল, গ্যাস, চুনাপাথর প্রভৃতি। খনিজের মধ্যে আরো রয়েছে ১৭ ধরনের খনিজ বালু। এর মধ্যে ইলমেনাইট, জিরকন, রুটাইল, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট মোনাজাইট, কায়ানাইট, লিকোক্সি উল্লেখযোগ্য। বঙ্গোপসাগরে এই আটটি খনিজ বালু বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। এগুলোর দামও অনেক বেশি। বঙ্গোপসাগরে অর্জিত সমুদ্রসীমা থেকে প্রায় ১০ লাখ টন এসব খনিজ বালু আহরণ সম্ভব। এ ছাড়া সাগরের তলদেশে ক্লেসার ডেপোজিট, ফসফরাস ডেপোজিট, এডাপোরাইট, পলিমেটালিক সালফায়েড, মাঙ্গানিজ নডিউল নামক খনিজ পদার্থ আকরিক অবস্থায় পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। এদের পরিশোধনের মাধ্যমে লেড, জিংক, কপার, কোবাল্ট, মলিব ডেনামের মতো দুর্লভ ধাতুগুলো আহরণ করা সম্ভব হবে। এসব দুর্লভ ধাতু উড়োজাহাজ নির্মাণে, রাসায়নিক কারখানায় এবং বিভিন্ন কল-কারখানায় উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা যাবে।

বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করছেন, এ খাতে সরকারের নীতি বিনিয়োগের অনুকূল নয়। বাংলাদেশের বার্ষিক বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ২৫০০ বাণিজ্যিক জাহাজের সাহায্যে চট্টগ্রাম ও মোংলাবন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। বিদেশি জাহাজগুলোকে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে। সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি করে এ ব্যয় কমানো সম্ভব। বাংলাদেশের মিঠাপানিতে যেখানে ২৫০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়, সেখানে বঙ্গোপসাগরে রয়েছে প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির মাছ। তার মধ্যে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ওপর প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভর করছে উপকূলীয় প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবিকা। বড় ট্রলারের সংখ্যা সীমিত হওয়ায় বঙ্গোপসাগরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার ছোট নৌকা ব্যবহার করে জেলেরা মাছ ধরছেন। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এখন এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে বড় ট্রলারের অভাব এবং গভীর সমুদ্রে মাছ ধরায় দক্ষতা না থাকায় পর্যাপ্ত মাছ আহরণ করা যাচ্ছে না। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়, সামুদ্রিক টোনা মাছের চাহিদা অনেক বেশি। এ মাছ খুব দ্রুত বিভিন্ন সাগরে ঘোরাফেরা করে। এগুলো গভীর সমুদ্র থেকে আহরণ করতে হয়। কিন্তু আমরা এসব মাছ আহরণ করতে পারছি না। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল থেকে প্রচুর লবণ উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশে ব্লু ইকোনমিতে বেসরকারি বিনিয়োগ পর্যাপ্ত নয়। ব্লু ইকোনমিতে কিছু কিছু বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে। বিশেষ করে মাছ ধরার ট্রলার, সমুদ্র ভ্রমণে পর্যটন, মালামাল পরিবহন, আরো অনেক খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে। তবে বিনিয়োগে মানুষকে আগ্রহী করে তোলার জন্য ব্র্যান্ডিং ঠিকমতো হচ্ছে না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে পলিসির বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিস্তৃত সমুদ্র তলদেশ ও উপরিভাগ থেকে সর্বোচ্চ সুযোগ কাজে লাগাতে সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ ও বেসরকারি খাতের অর্থায়নে সমুদ্রের নৈকট্য পরিমাপসহ জরিপ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ দিনে দিনে কমে আসছে। অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদেরও আধিক্য কোনো সময়েই ছিল না। সীমাবদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি জোরালো হতে পারেনি। বারবার হোঁচট খেয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রেও উৎপাদনশীলতা বেড়েছে বটে, তবে এ অবস্থা একটানা দীর্ঘদিন বজায় থাকবে না। কৃষিজমির পুনঃব্যবহারের ফলে উৎপাদনশীলতা দিনে কমে আসছে। জনসংখ্যার চাপ এবং শিল্পায়ন-নগরায়ণের কারণে কৃষিজমির পরিমাণ কমে আসছে। তেমনি প্রেক্ষাপটে বঙ্গোপসাগর আমাদের অর্থনীতির সমৃদ্ধির জন্য বিরাট ভরসার কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠতে পারে। বঙ্গোপসাগরকে অবহেলা না করে এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’র সমৃদ্ধির জন্য অপার সম্ভাবনাময় সমুদ্র খাত। আমাদের আগামী দিনের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে অনেক আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে। সেই আশঙ্কাগুলো দূর করতে হলে বঙ্গোপসাগরের বিরাজমান খনিজসম্পদকে পরিপূর্ণ ব্যবহারের নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে ব্লু ইকোনমি সেল গঠন করা হয়েছে। এই সেল থেকে সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা বাস্তবায়নে বিভিন্নভাবে কাজ করছে। সমুদ্রসম্পদ আহরণে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ এবং এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা বাস্তবায়নে যে ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা আমাদের সবাইকে আশাবাদী করে তুলেছে। এসব উদ্যোগ যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে বিপুল সম্ভাবনাময় বঙ্গোপসাগরের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার ঘটবে। এ ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ কিংবা অবহেলার কোনো উপায় নেই।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close