জি বি এম রুবেল আহম্মেদ
মুক্তমত
স্মৃতির পাতায় গাঁথা বীর-উত্তম খালেদ মোশাররফ
বীর-উত্তম খালেদ মোশাররফের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১ নভেম্বর জামালপুর জেলা, ইসলামপুর উপজেলার মোশাররফগঞ্জে। পিতা মোশাররফ হোসেন ও মাতা জমিলা আখতার। কক্সবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে মেট্রিক এবং ১৯৫৫ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন। পরে তিনি পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান। ১৯৫৭ সালে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভের পর ৮ বছর বিভিন্ন সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন তিনি। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় খালেদ মোশাররফ চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অ্যাডজুটেন্ট হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছিলেন। এরপর কাকুল মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর তিনি মেজর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি ডিগ্রি পাওয়ার পরে তাকে ব্রিগেড মেজর হিসেবে খারিয়াতে ৫৭ ব্রিগেডে নিয়োগ দেওয়া হয়। জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে সেনা প্রশিক্ষণে যাওয়ার কথা থাকলেও ১৯৭০ সালের মার্চে তাকে ঢাকায় বদলি করা হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে তার নেতৃত্ব ও ভূমিকা ছিল বিরল। ১৯৭১ সালে ২৪ মার্চ তাকে কুমিল্লায় চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২৬ মার্চ মৌলভীবাজারের শমসেরনগরে তিনি চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি সৈনিক নিয়ে অবস্থান করছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে। তিনি খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহ করেন এবং সেই রাতে তার বাহিনী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশে রওনা হন। ২৭ মার্চ সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছালে তার বাহিনী এবং সেখানে আগে থেকে অবস্থানরত মেজর শাফায়াত জামিলের বাহিনী সম্মিলিত হয়। ইতিমধ্যেই তার বেতার নির্দেশ পেয়ে শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে বাঙালি সৈনিকরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত পাঞ্জাবি সৈনিকদের আটক করেন। তিনি চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব নেন। পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি তার বাহিনীর অফিস ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে তেলিপাড়া চা বাগানে সরিয়ে নেন। গেরিলা যোদ্ধা শফি ইমাম রুমী সেক্টর-২-এ খালেদ মোশাররফের অধীনে মেলাঘরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। জুন মাসের শেষের দিকে দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের একটি চিঠি নিয়ে শাহাদাত চৌধুরী ও হাবিবুল আলম আসেন শরীফ ইমামের বাড়িতে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চলাচল ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে খালেদ মোশাররফ তার কাছে বাংলাদেশের সেতু ও কালভার্টের ব্যাপারে তথ্য চেয়ে পাঠান। শরীফ ইমাম ব্রিজের ঠিক কোন কোন স্থানে বিস্ফোরক বেঁধে ওড়ালে সেতু ভাঙবে অথচ কম ক্ষতি হবে অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সহজে মেরামত করা যাবে, সেভাবে বিস্তারিত তথ্য দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সফল প্রতিরোধ করতে করতে মধ্য এপ্রিলে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবিরাম বিমান আক্রমণের শিকার হন, ফলে তিনি ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থান নেন। মুজিবনগর সরকার তাকে ২ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব দেয়। যুদ্ধের সময় খালেদ মোশাররফ লেফটেন্যান্ট কর্নেলের পদে উন্নীত হন। ২৩ অক্টোবর খালেদ মোশাররফ মাথায় গুলি লেগে মারাত্মক আহত হন এবং লক্ষ্মৌ সামরিক হাসপাতালে দীর্ঘ চিকিৎসা লাভের পর সুস্থ হন। তিনি একজন বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার এবং ‘কে-ফোর্স’-এর সর্বাধিনায়ক ছিলেন এবং বীরত্বের জন্য তাকে বীর-উত্তম পদকে ভূষিত করা হয়।
স্বাধীনতার পর খালেদ মোশাররফ ঢাকা সেনা সদর দপ্তরে স্টাফ অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। পরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন খালেদ মোশাররফ। কিন্তু দুঃখজনক দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র তিন দিন পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞের অন্যতম কারণ ছিল তার দেশপ্রেম। এই মুক্তিযোদ্ধার দেশপ্রেম ছিল জীবনের চেয়েও মূল্যবান। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অভাবনীয় অবদানের কথা জাতি আজীবন মনে রাখবে। ইতিহাসের পাতায় থেকে যাবেন চিরকাল।
লেখক : সংস্কৃতিকর্মী ও কলাম লেখক
"