শহীদুল ইসলাম (শুভ)
আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ
ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমবে

বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র। যুগের পর যুগ ধরে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ ও একচেটিয়া শাসন করে যাচ্ছে। যারাই তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাদেরই পরিণতি হতে হয়েছে কুয়া ব্যাঙ্গের মতো। কিন্তু দিন দিন এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা যেন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যাপকভাবে গ্রাস করছে। ক্ষমতার দাপট দেখাতে গিয়ে একের পর এক হারাচ্ছে মিত্রদের। মতের অমিল হলেই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নিজের জন্য খাল কেটে যেন কুমির আনছে। ফলে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে পরিচিত রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করছে। রাশিয়া ও চীন তাদের অর্থনৈতিক চাকাকেও চাঙা করে দিচ্ছে। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুখ ফিরিয়ে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলছে। কবি জীবনানন্দ একটি কবিতা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখলেও এটি যেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে মিলে যাচ্ছে। জীবনানন্দ বলেন, ‘বুড়ো হয়ে গেছ তুমি, বুড়ো পৃথিবীর মতো।’ তরুণ বয়সে যেমন হাক ও গর্জন দেওয়া যায়, বৃদ্ধ বয়সে তা পারে না। ইচ্ছে থাকলেও তা প্রয়োগ করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রও এখন তরুণ বয়স থেকে বৃদ্ধ বয়সে চলে এসেছে। তাই তেমন কেউ আর নিষেধাজ্ঞাকে ভয় করে না। আগের মতো ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না। বরং তাদের চোখে আঙুল দিয়ে পৃথিবীর অন্যতম হয়ে উঠছে চীন, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়া।
যুক্তরাষ্ট্র এখন দিশাহারা হয়ে পড়ছে। একদিকে চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ, অন্যদিকে চলমান ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ যেন যুক্তরাষ্ট্রকে আরো ঘোলাটে বানিয়ে দিল। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ চালায় এবং এখনো চলমান। একে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সঙ্গে নিয়ে রাশিয়ার ওপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল এবং যা এখনো বহাল আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেখানে রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর নির্ভর, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে পড়ে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। আদতে তারা এই নিষেধাজ্ঞা নিজেদের ক্ষতি করে দিত না। যুক্তরাষ্ট্রের চাপের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে তাদের ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং তার প্রতি আস্থাও কমছে। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বিশ্ববাজারে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। নিত্যপণ্যের মূল্য হুরহুর করে বাড়ছে। এর জন্য অনেকে রাশিয়াকে দোষারোপ করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে না থামিয়ে আরো উসকে দিচ্ছে। বিশ্ববাজারে রাশিয়াকে ছোট করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এসব নোংরা পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার মুখ্য সময়টা বেঁচে নিলেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে। ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র কোটি কোটি টাকা এবং অস্ত্র অনুদান দিচ্ছে। ইউক্রেনও সুযোগ বুঝে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে চেপে বসেছে। এতে তাদের যেমন সার্থকতা আছে, যুক্তরাষ্ট্রও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা এবং নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে চাচ্ছে। যুদ্ধের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, যুদ্ধে বিজয়ের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করবে। ২০০ মিলিয়ন ডলারের ঘোষণা দিয়ে শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পপন্থিদের বিরোধিতায় ইউক্রেনকে দেওয়া হয় মাত্র ২৪ মিলিয়নেরও কম, যা খুবই সামান্য। তারা প্রতিশ্রুতি রাখেনি। শেষ পর্যন্ত থাকবে কি না তাও অনিশ্চিত।
যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, ‘আমরা দড়ির একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি।’ এর মানে দাঁড়ায় ইউক্রেনকে তারা আর সহযোগিতা বা অনুদান দিতে চাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের সাহায্য না করে, তারা কি পারবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে? যুক্তরাষ্ট্র কি তাদের একা ছেড়ে দিল? বন্ধুকে মাঝপথে রেখে যুক্তরাষ্ট্র কি তাদের ‘প্রকৃতরূপ’ দেখাল? এত দিন ধরে যে যুদ্ধ চলছে তার জন্য কি যুক্তরাষ্ট্র দায়ী নয়? ইউক্রেনকে দেওয়া স্বপ্ন কি ভেঙে দিল যুক্তরাষ্ট্র? এখানেও দায়ী ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের এমন ব্যবহারে মিত্র দেশগুলো হতাশ হবে। তারাও দূরত্ব বাড়িয়ে দেবে। প্রকৃত বন্ধু খুঁজতে চাইবে। বন্ধু হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র যে বিশ্বস্ত নয় সেটাও আরেকবার প্রমাণ হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেমন পুরো বিশ্বকে নতুন মেরূকরণ করেছে, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইসরায়েলের ফিলিস্তিনে হামলাও নতুন মাত্রা যোগ করবে।
৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ঢুকে যে হামলা চালিয়েছে এবং ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু বিদেশি নাগরিকদের বন্দি করেছে, তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে ইসরায়েল গাজায় যে হামলা চালাচ্ছে বা ভবিষ্যতে হামাসের ওপর যে নজর রাখবে এতে করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নতুনভাবেই তৈরি হবে। হামাস এমন সময় আক্রমণ করেছে, যখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে ছিল একাট্টা। নেতানিয়াহুর আসন নড়বড়ে ছিল। এই হামলায় তার আসন আরো পাকাপোক্ত হলো। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতাই এখানে মুখ্য হয়ে উঠবে। যে যুক্তরাষ্ট্র সৌদির সঙ্গে এত ধর-কষাকষি করছে ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তা হামাস মুহূর্তেই বিনষ্ট করে দিল। ইসরায়েলের পাল্টা আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান তাতে মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন হারাবে। আর হামাসের পক্ষে মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন মিলল। এদিকে তুরস্ক, কাতার, মিসর, লেবানন, পাকিস্তান ও মালয়েশিয়াসহ মুসলিম দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এমন সমর্থনকে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। যুদ্ধ না থামিয়ে ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বড়ই বোকামি। মুসলিম দেশগুলোর ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না। এটাকে কাজে লাগাবে রাশিয়া ও চীন।
ইসরায়েল ফিলিস্তিন যুদ্ধ নিয়ে পুতিন বলেন, ‘ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন তাদের সমস্যার মূলে নজর দিত হবে।’ পুতিনের এমন কথা কৌশলী। আরব লীগসহ মুসলিম দেশগুলো সমর্থন করেছে। আরব লীগের মুখপাত্র জামাল রুশদি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া যৌক্তিক ও ভারসাম্যমূলক মন্তব্য করেছে।’ তারা রাশিয়াকে মধ্যস্থতায় চাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তাদের বিশ্বাস রাখতে পারছেন না। ইসরায়েলকে সমর্থন করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুবিধাজনক হয়নি। ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ওপর ১৯৪৭ সাল থেকেই ক্রমাগত গৃহহীন করে আসছে। ইসরায়েল ১৯৭৩, (ইয়ম কিপুর), ১৯৯৩, ২০১২, ২০১৪ ও ২০২১ সাল পর্যন্ত হামলা করে আসছে। প্রতিবারই যুক্তরাষ্ট্রের মদদে তারা হামলা করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অনেকটা ভাটা পড়েছে। ইসরায়েল ফিলিস্তিন যুদ্ধে লাভবান হবে রাশিয়া। সবার মনোযোগ থাকবে এদিকে আর রাশিয়া এই ফাঁকে ইউক্রেনকে হস্তগত করার চেষ্টা করবে, যুক্তরাষ্ট্রকে কুক্ষিগত এবং মধ্যপ্রাচ্যের ওপর প্রভুত্ব করার চেষ্টা করবে।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম যুক্তরাষ্ট্রের ও ইউরোপের চাপের কথা স্বীকার করেন। হামাসের ওপর নিন্দা জানানোর জন্য তারা চাপ দিচ্ছিল। তিনি তা করেননি। তিনি জানান, তাদের সঙ্গে (হামাসের) অনেক আগ থেকেই কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। অনেক প্রতিনিধিও তাদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেখা করেছে। তিনিও যুক্তরাষ্ট্রের চাপকে উপেক্ষা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না।
যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক রাষ্ট্র, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। যে আশায় তারা নিষেধাজ্ঞা দেয় তা তেমন করে কাজে আসে না। নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশগুলো অন্য দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। রাশিয়া ও চীন তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে। এতে রাশিয়া চীনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বিশেষ করে চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে। তুলনামূলক যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব সেখানে অনেক কমেছে। উত্তর কোরিয়া, কিউবা, সিরিয়া, ইরান, ভেনিজুয়েলা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশ, বেলারুশ, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, চীন, কঙ্গো, ইরান, লেবানন, লাইবেরিয়া, মালি, মিয়ানমার ও সোমালিয়াসহ অনেক দেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
কথায় বলে, ‘আধিপত্য চিরদিন থাকে না।’ একসময় পুরো বিশ্বকে শাসন করেছে ব্রিটিশরা। অথচ আজ তাদের অর্থনীতি ভঙ্গুর। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়; ক্ষমতা চিরদিন থাকে না। এই ভারত উপমহাদেশে কতগুলো বংশের শাসন ছিল। আজ তাদের চিহ্নও নেই। কত সভ্যতা ছিল। তারাও আজ নেই। হয়তোবা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবও ধ্বংস হওয়ার সময় এসে গেছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
"