রেজাউল করিম খোকন

  ১৭ নভেম্বর, ২০২৩

মতামত

দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে যা প্রয়োজন

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রায় ২০০ কোটি মানুষের বসবাস। অথচ এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্যের পরিমাণ খুবই কম। এসব দেশের বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। তাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অভাব আছে। এই দেশগুলোর রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় উপার্জনকারীর অধিকাংশই আবার অদক্ষ। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক বাধার পাশাপাশি অশুল্ক বাধাও আছে। বিশ্বের মোট বাণিজ্যের মাত্র ৮ শতাংশ হয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। শুধু ঔপনিবেশিক আমল নয়, দেশগুলোর সঙ্গে হাজার বছরের সম্পর্ক বাংলাদেশের। আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে নৌ, সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার কমিয়ে ১৮ শতাংশে নিয়ে আসতে পেরেছে। আমরা অবকাঠামো উন্নয়ন করছি। আমরা ভারত, নেপাল ও ভুটানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে অবাধে চলাচল করতে আগ্রহী। দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ বাণিজ্যই হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় এবং অঞ্চল হিসেবে ‘দক্ষিণ এশিয়া’ এখনো শক্তিশালী কোনো জায়গা নয়। অথচ একে শক্তিশালী করার সুযোগ আছে। বাংলাদেশ-ভারতের অবকাঠামো উন্নয়ন যতটুকু হয়েছে, তা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তার ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর জোর দিতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সংযোগ কম। এজন্য আঞ্চলিক সহযোগিতা ও প্রতিশ্রুতি দরকার। বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সুবিধার দিক থেকে আঞ্চলিক অখণ্ডতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে মোটামুটি মিল আছে। এগুলো হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা। কিন্তু দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ খুবই কম। গভীর গবেষণার মাধ্যমে সমস্যাগুলো মোকাবিলায় ঐকমত্য দরকার। আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্ব নিয়ে অতীতে বহুবার আলোচনা হয়েছে। এখন নতুন বাস্তবতা। ফলে নতুন করে চিন্তা করার সময় এসেছে। অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ হয় নিজেদের মধ্যে। তাই বাণিজ্য বাড়াতে ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বের হওয়া দরকার। আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জোরদারে দরকার শক্তিশালী গণতন্ত্র। আঞ্চলিক সংঘাত আছে। আছে জলবায়ু পরিবর্তন। এসব সমস্যা দূর হওয়া উচিত। আর এজন্য দরকার আঞ্চলিক সহযোগিতা।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো একই ভৌগোলিক রেখায় অবস্থান করলেও তাদের মধ্যে একক মুদ্রা (কমন কারেন্সি) প্রচলনের মতো অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা এখনো তৈরি হয়নি। এ অবস্থায় দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা বাড়াতে হবে। কমাতে হবে ব্যবসার খরচ। পাশাপাশি নিয়মিত পারস্পরিক পরামর্শ চালু করতে হবে। এর নেতৃত্ব দিতে হবে ভারতের মতো দেশকে। একটি অঞ্চলের জন্য একক মুদ্রা প্রচলন করতে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। এর মধ্যে অর্থের অবাধ চলাচল, সীমান্ত অতিক্রম করার স্বাধীনতা, ঝুঁকি সহনশীলতা, পারস্পরিক আস্থা, একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন ইত্যাদি। একই ভৌগোলিক সীমায় অবস্থানের পরও প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা ভিন্ন। মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতের মুদ্রা রুপি বেশ অস্থিতিশীল। তাই কোনো ব্যাংক রুপি কিনে রাখলে তাতে ঝুঁকি থাকতে পারে। এ ছাড়া সার্বভৌমত্ব ইস্যু বিবেচনা করলে দক্ষিণ এশিয়ায় একক মুদ্রা চালুর প্রেক্ষাপট এখনো তৈরি হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি অনেক। একক মুদ্রা বা কোনো দেশের মুদ্রাকে নীতিনির্ধারক ধরে চালকের আসনে বসানো যুক্তিযুক্ত হবে না। এখন একক মুদ্রা ব্যবহারের মতো ইউনিয়ন গড়ে তোলার সময়ও হয়নি। টাকা-রুপি ও চীনা মুদ্রায় লেনদেন চালু হলেও তাতে সাড়া মিলছে না। ভারতের সঙ্গে প্রতি মাসে বাংলাদেশ ও চীনের বড় আকারের বাণিজ্য ঘাটতি আছে। এজন্য মুদ্রা অদলবদলের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এখনো দক্ষিণ এশিয়ায় একক মুদ্রা প্রচলনের মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। এর আগে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ মিলে ‘রুপা’ নামের মুদ্রার প্রচলন করতে চেয়েছিল। সেই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি। এখন যে পরিমাণ রুপি আয় আছে, রুপিতে শুধু সে পরিমাণ আমদানি করা হচ্ছে। রাশিয়া, আফগানিস্তান ও চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের নিজস্ব মুদ্রার লেনদেন হয়। একক মুদ্রার আশা না ছেড়ে আমাদের সবার বিকল্প খোঁজ করা উচিত। যাতে ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমে। চ্যালেঞ্জ থাকলেও বসে না থেকে স্বল্প পরিসরে নতুন উদ্যোগ হিসেবে শুরুর চিন্তা করা উচিত। বাণিজ্যকে সামনে রেখে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য স্বল্প পরিসরে হলেও একক মুদ্রার প্রচলন হতে পারে। এর চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে দেশগুলোর আমদানি-রপ্তানি ও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া একই ধরনের হওয়া। প্রতিটি দেশের পণ্য শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত ডকুমেন্ট বা কাগুজে প্রমাণাদির সংখ্যাও ভিন্ন। এতে সময় ও অর্থ ব্যয় হয় বেশি। একটি নির্দিষ্ট ছকে সবাই শুল্কায়ন করলে তা নিয়ে আপত্তি উঠলেও নিষ্পত্তি করা সহজ হয়। এটি সব দেশ চাইলেই পারে। ডলারের বিকল্প লেনদেন চালু হলে খরচ কমবে। ধীরে ধীরে বৈশ্বিক বাজারে ডলারের লেনদেন কমছে। ২০২২ সালের জুলাইয়ে লেনদেনের ৯ শতাংশ ছিল ডলারবহির্ভূত, যা গত বছরের ডিসেম্বরে বেড়ে হয়েছে ১৪ শতাংশ। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় ব্যবসা বাড়াতে খরচ কমাতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসার স্বার্থে নতুন নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। ডলারকে দুর্বল করে দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুদ্রার মর্যাদা থেকে তাকে নামিয়ে আনার চেষ্টাও ব্রিকস দেশগুলো করে যাচ্ছে। চীনা আধিপত্যের অধীনে থাকা ব্রিকস নামের এই গ্রুপ মার্কিন স্বার্থবিরোধী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের নীতি অনুসরণ করে থাকে বলে সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির গতি বাড়াতে আঞ্চলিক বাণিজ্য বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ছে প্রায় সময়ই। অনেক বাধাবিপত্তির কারণে মাঝেমধ্যে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য হোঁচট খাচ্ছে। তেমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর বাণিজ্যিক লেনদেন বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর মাধ্যমে উপকৃত হবে বাংলাদেশ। বাণিজ্যের হাত ধরে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটতে পারে। ভারতের শুধু ত্রিপুরাতেই বছরে ৫০০ কোটি রুপির পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ রপ্তানির মাত্রা আরো বাড়াতে পারে। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্য রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্ত-সংলগ্ন হওয়ায় এসব রাজ্যে পণ্য পরিবহনেও বিদ্যমান ব্যবস্থা অনেকটা অনুকূল। যে কারণে এসব রাজ্যে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক ভারসাম্য অনেকটা বজায় রাখা সম্ভব। বাংলাদেশ থেকে বিবিধ পণ্য রপ্তানি হয় মিয়ানমারে। এর মধ্যে রয়েছে গার্মেন্টসামগ্রী, কৃষিপণ্য, হিমায়িত খাদ্য, চামড়াজাত পণ্য, জুতা, ওষুধপত্র প্রভৃতি। বর্তমানে নানা জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। অথচ বাণিজ্য সহজীকরণ করা হলে এই রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ অনেক গুণ বাড়ানো সম্ভব। মিয়ানমারের ওষুধবাজার মূলত আমদানিনির্ভর। প্রায় চার বিলিয়ন ডলারের ওষুধের বিরাট বাজার রয়েছে সেখানে। তারা প্রধানত থাইল্যান্ড, চীন থেকে ওষুধ আমদানি করে থাকে। বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে ওষুধ রপ্তানির ক্ষেত্রে লক্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। সেখানে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মিয়ানমারে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানির দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে।

নেপাল, মিয়ানমার, ভুটান, ভারতের কয়েকটি সীমান্তবর্তী রাজ্য আমাদের নিকট প্রতিবেশী। দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে হলে প্রথমেই দরকার এসব দেশ এবং রাজ্যের সঙ্গে কানেকটিভিটি বৃদ্ধি করা। বিশেষ করে চার দেশীয় (ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান) প্রস্তাবিত সরাসরি সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা শক্তিশালী করা হলে বাংলাদেশ থেকে এসব দেশে রপ্তানির পথ সুগম হবে এবং রপ্তানির পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়িয়ে বাংলাদেশ নেপালকে ট্রানজিট সুবিধা দিতে পারে। বাণিজ্যিক যোগাযোগ বাড়লে দুদেশের টেকসই উন্নয়নের পথ সুগম হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, মিয়ানমার ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রসারের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনে শক্তিশালী আঞ্চলিক সংযোগ, সহযোগিতা এবং বাণিজ্য প্রক্রিয়া সহজ করা জরুরি। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রযুক্তি গ্রহণের পাশাপাশি ঔপনিবেশিক আমলের আমলাতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব গ্রহণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে এই অঞ্চলের দেশগুলোর একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক জাতি আছে। প্রায় ২০০ কোটি জনগোষ্ঠীর বসবাস এখানে। কিন্তু ‘দক্ষিণ এশিয়া’ পরিচয়টা এখনো ব্যাপকভাবে পরিচিত নয়। আঞ্চলিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ প্রবাহ, আর্থিক সংযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য সার্কটাকে কাজে লাগানোর সুযোগ আছে। এমন বাস্তবতায় এই অঞ্চলের দেশগুলোকে ওপরের দিকে নিতে হলে দরকার রাজনৈতিক ঐকমত্য। পাশাপাশি সব সময় তদারকির জন্য দরকার আলাদা একটা শক্তিশালী দপ্তর। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উন্নয়নে একটা দপ্তর থাকা দরকার।

লেখক : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close