সৈয়দ আনোয়ার রেজা
মুক্তমত
বর্বরোচিত হামলা যুদ্ধ নয় গণহত্যা
মানব ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত আছে, যা আমাদের প্রকৃতির অন্ধকার দিকগুলোর সাক্ষ্য বহন করে। এ রকম একটি অন্ধকার অধ্যায় হলো যুদ্ধ চলাকালে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের অবাধ ধ্বংস। এটা কী যুদ্ধ, না অন্যকিছু?
আমরা যখন মসজিদ থেকে গির্জা, মন্দির থেকে বিহার ও লালিশ উপাসনালয়গুলোর ভয়ংকর ধ্বংসাবশেষ লক্ষ করি, তখন বেদনাদায়কভাবে পরিষ্কার হয়ে যায়- বর্বর হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে যাওয়া মানবতার অপূরণীয় ক্ষতি।
ইতিহাস, ঐক্য এবং বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদ অথবা মন্দির নিছক পাথুরে শিল্পের কাঠামো নয়, বরং এটি একটি সম্প্রদায়ের আত্মা। নিজেদের বোধ ছাড়াই পবিত্র এ জায়গাগুলোতে আক্রমণ করা একটি জাতির হৃদয় ছিঁড়ে ফেলার মতো। একইভাবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত ধ্বংসের মাধ্যমে একটি গোষ্ঠীকে ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই না। একটি জাতির এ অগ্রগতির ভিত্তিগুলো ধ্বংসের নামে প্রজন্মের আশা এবং স্বপ্ন পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।
তদুপরি, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা বাধা দিয়ে মানুষের শ্বাসরোধ করার প্রয়াস চলছে! এগুলোকে আমরা যুদ্ধ বলতে পারি না। অস্তিত্বকে শ্বাসরোধ আর যা-ই হোক, অবশ্যই যুদ্ধ নয়। এটি অবশ্যই আগ্রাসনের একটি রূপ, যা রাজনৈতিক মতাদর্শকে অতিক্রম করে মানবতার বিরুদ্ধে সর্বকালের নিকৃষ্ট অপরাধ। এ কাজগুলো বর্ণনা করার সময় ‘গণহত্যা’ শব্দটি অতিরঞ্জিত নয়।
তিন দশক ধরে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ সংঘাত ও যুদ্ধ দ্বারা বিধ্বস্ত! ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইউক্রেন এবং ফিলিস্তিনের যুদ্ধগুলো শুধু হাজার হাজার মানুষের জীবন ছিনিয়ে নেয়নি, বরং মানবতার সম্মিলিত চেতনার ওপর একটি স্থায়ী দাগও রেখে গেছে। ২০০৩ সালে শুরু হওয়া ইরাকের যুদ্ধে চরমপন্থি গোষ্ঠীর উত্থান ও পতন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সংঘাতে জর্জরিত আফগানিস্তান, জন্ম হলো তালেবান শক্তি। ২০১১ সালে শুরু হওয়া সিরিয়া যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের রক্তে লাল হয়ে বয়ে গেছে ফোরাত নদী। ইউক্রেনের সংঘাত, বিশেষ করে দোনেস্ক এবং লুহানস্কের পূর্বাঞ্চলে অগণিত ইউক্রেনীয়দের জীবনকে করেছে ব্যাহত। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাত অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে অব্যাহত রয়েছে। পশ্চিমা শক্তির আগ্রাসন ও যুদ্ধ চলাকালে অস্ত্রবাণিজ্য যেন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এ লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইসরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনের মতো বিশ্বশক্তি। যে প্রশ্নটি বড় আকার ধারণ করে তা হলো- কে বিশ্বশক্তি হতে চায় এবং কেন তারা এখনো যুদ্ধে লিপ্ত?
প্রতিটি জাতি বৈশ্বিক মঞ্চে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে এবং কেউ কেউ বিশ্বশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চায়। এ মর্যাদা অর্জনের পশ্চাতে প্রায়ই ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং জাতীয় গর্বের মধ্যে নিহিত থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, প্রায়ই বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে বিবেচিত, সারা বিশ্বে সামরিক ব্যস্ততা এবং ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। রাশিয়া, তার সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং বিশাল ভূখণ্ডের সঙ্গে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ কীভাবে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা এবং মানুষের দুর্ভোগের দিকে নিয়ে যেতে পারে, তার উজ্জ্বল উদাহরণ ইউক্রেন ও সিরিয়ার সংঘাত।
ইতিহাসের পরতে পরতে ক্ষমতার জটিল গল্প, জড়িয়ে আছে মানবতার অন্তহীন লড়াই, আলো নিভিয়ে দিচ্ছে পেশিশক্তির আধিপত্য। এ ধরনের বর্বরতার জবাব দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কারণ এ কাজগুলো শুধু একটি দেশ বা জাতির ওপর আক্রমণ নয়, বরং এটি মানবতার ওপর আক্রমণ। অতএব, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার মতো শক্তিশালী হয়ে কাজ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তবে একটি বৈশ্বিক সমাজ গঠনে দৃঢ় সংকল্পে থাকতে হবে। যুদ্ধের নামে নিকৃষ্ট গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করার দাবি তোলার চূড়ান্ত সময় এখনই। ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসের বৈচিত্র্য রক্ষায় আর কত শিশুর রক্তে পিচ্ছিল হবে পিচঢালা পথ?
লেখক : কবি-কথাসাহিত্যিক ও সংগঠক
"