মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

  ১৬ নভেম্বর, ২০২৩

মতামত

জনকল্যাণে প্রয়োজন পরিবেশ সুরক্ষিত উন্নয়ন

দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নগরায়ণ কার্যক্রমকে সফল করতে দীর্ঘকাল ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃক্ষ নিধন হয়েছে। এ ছাড়া মানুষের লোভের কবলে পড়ে দেশে নির্বিচারে নানা প্রজাতির গাছপালা ধ্বংস হয়েছে। একটি অসাধু চক্র উন্নত প্রজাতির সরকারি পুরোনো গাছ কেটে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে মুনাফা লুটেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ দুর্বিপাকের কারণেও বিনষ্ট হচ্ছে বিপুল বনসম্পদ, বিপন্ন হয়েছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ। জীববৈচিত্র্য রক্ষার লক্ষ্যে গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বহুবার। এই আদেশবলে কোনোক্রমেই বনভূমি থেকে কোনো গাছ কাটা যাবে না। এমনকি ঝড়ের কবলে অথবা মড়কে আক্রান্ত হয়ে বনাঞ্চলে যেসব গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় সেগুলোও কেউ সংগ্রহে নিতে পারার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোনো আইনকানুন, বিধিনিষেধ আরোপ করেও বৃক্ষনিধন বন্ধ করা যায়নি। লুকিয়ে নয়, কখনো প্রকাশ্যে চলছে গাছ কাটার মহাযজ্ঞ। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশন সম্প্রতি সাত মসজিদ রোড এলাকার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। অথচ এলাকার বট, বরই, বকুল, কৃষ্ণচূড়া শিরীষগাছসহ ঝোপঝাড়, লতাগুল্ম এলাকার পাখি, পতঙ্গ ও সরীসৃপের মতো জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার নামে প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের মহোৎসব চলছে। সব মিলিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সহস্রাধিক বৃক্ষনিধন করার অভিযোগ রয়েছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যেসব নানা প্রজাতির প্রাণী ও পাখির বিচরণ ছিল, বৃক্ষনিধনের ফলে তা হুমকির মুখে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সারা দেশে বৃক্ষনিধনের মহাযজ্ঞে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রতীক পাহাড়ের বন উজাড় ও বৃক্ষনিধনের ফলে জীববৈচিত্র্য হচ্ছে হুমকির সম্মুখীন, বন্যপ্রাণী হারাচ্ছে আবাসস্থল। প্রকৃতি হয়ে পড়ছে ভারসাম্যহীন। বিগত কয়েক যুগ ধরে পাহাড় কাটার পাশাপাশি পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজিকে নির্বিচারে ধ্বংস করে সমতল ভূমিতে মুনফালোভী সিন্ডিকেট গড়ে তুলছে আবাসিক প্লট ও অভিজাত ফ্লাট। নিম্ন আয়ের হতদরিদ্র, ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর জন্য গাছপালা কেটে ফেলে পাহাড়ের গায়ে গড়ে তুলছে বস্তি। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত পাহাড়ের মালিকানা ভূমি মন্ত্রণালয়ের। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় বনজসম্পদ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। পাহাড় এলাকায় বাড়িঘর নির্মাণের নিয়ন্ত্রণ পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যাস্ত। এদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা সুযোগ করে দিয়েছে নির্বিচারে পাহাড় কাটা, পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা গাছপালা উজাড় করে দালানকোঠা, বস্তি নির্মাণের ক্ষেত্র। পরিবেশ ধ্বংসের এমন অপতৎপরতা কোনোক্রমেই বন্ধ করা যাচ্ছে না।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের হিসাব মতে, বাংলাদেশে বর্তমান বনভূমির পরিমাণ ১১ দশমিক ২ শতাংশ, যা বিশ্বের কম বনাঞ্চলের দেশ হিসেবে এশিয়ায় অবস্থান তৃতীয়। পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশের আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বৃক্ষ এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর সম্পূর্র্ণ নির্ভরশীল প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য। দেশে বর্তমানে ভূমির পরিমাণ ১ কোটি ৪০ লাখ হেক্টর। এরই মধ্যে ১২ লাখ হেক্টর রয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় বৃক্ষ কাটা থেমে থাকেনি। ভাওয়াল গড়, মধুপুর গড় দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। পরিবেশ ভারসাম্যের কথা বিবেচনায় না এনে নগরায়ণ হলে বিপন্ন, অসহায় হয়ে পড়বে মানুষ। একসময় বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ বনভূমি কেটে ফেলে আবাসস্থল তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু এর বিপরীতে নতুন করে অধিক পরিমাণ গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বহুকাল ধরে। মানুষের নিত্যনতুন চাহিদা মেটাতে তৈরি হতে থাকে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, শিল্প-কারখানা। আর এসব করতে গিয়ে কেটে ফেলা হয় প্রচুর পরিমাণ গাছপালা। ক্রমেই উজাড় হচ্ছে বনভূমি। আন্তর্জাতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার হতে পারে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। ঋতুচক্র পরিবর্তনের কারণে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। বাংলাদেশের অহংকার তথা বিশ্বের প্রধান ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের প্রায় ৫ হাজার প্রজাতির গাছের ১০৬টির অস্তিত্ব ইতিমধ্যে বিলুপ্তপ্রায়। ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ৩০ ভাগ কমে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।

উদ্ভিদ ও প্রাণী নিয়ে গঠিত জীববৈচিত্র্য অন্যের সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকে। পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিতভাবে অবদান রাখে। বাংলাদেশের পাহাড় অঞ্চল, সমতল ভূমি এবং উপকূলীয় এলাকার সামান্য বনাঞ্চল, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড় এলাকার বনের কিছু গর্জন, সেগুন, জারুল ও গামারি-জাতীয় বৃক্ষ, দিনাজপুর, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের বনাঞ্চলের নানা জাতের গাছপালা প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় সহায়তা করছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমে খুলনা ও পটুয়াখালী জুড়ে অবস্থিত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন দীর্ঘকাল ধরে দেশের জীববৈচিত্র্য তথা পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রেখে চলেছে। প্রায় ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশের মোট বনভূমির প্রায় ৪৪ শতাংশ জুড়ে এ বনের সুন্দরী, গেওয়া এবং কেওড়াগাছ ছাড়াও রয়েছে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ ও নানা প্রজাতির বানর, যা এক বিরল দৃষ্টান্ত। প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় সুন্দরবনের বিপুল পরিমাণ গাছপালা ও পশুপাখির ভূমিকা অপরিসীম। কারণ উপকূলীয় বনে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে বাতাস আর্দ্র থাকে। বনভূমি যেকোনো উৎস থেকে আসা পানিপ্রবাহের চাপ কমায় এবং ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস থেকে দেশের মাটিকে রক্ষা করে। অধিকন্তু গাছপালা বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ কমিয়ে দিয়ে বাতাসে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে এবং বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়। এমনকি বন যানবাহনের কালো ধোঁয়ার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বায়ুমণ্ডলকে মুক্ত রাখতে সাহায্য করে। ঝড়-ঝঞ্জা, সাইক্লোন, বন্যা ও জলোচ্ছ্ব¡াসের হাত থেকে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে বনাঞ্চল। বাংলাদেশের ওপর স্মরণকালের মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়গুলো দেশের বিভিন্ন স্থানসহ উপকূলীয় এলাকার গাছপালা, পশুপাখিসহ মানুষের জানমালের অপরিসীম ক্ষতি করেছে। বিশেষ করে, দেশের অমূল্য সম্পদ সুন্দরবন উপকূলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকার বন বিনষ্ট হয়েছে। তবে সুন্দরবনের অবস্থানের কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের বিশাল জনবসতি এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। সুন্দরবনই ঝড়ের গতিবেগ রোধ করে ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ঘরবাড়ি, গাছপালাসহ প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করেছে। বাঁচিয়েছে উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য মানুষকে।

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে বনভূমি উজাড়, বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তিসহ অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্প-কারখানার দূষণকে দায়ী করা হয়ে থাকে। এটা অনস্বীকার্য যে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়ে দেশের পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা করতে অধিকতর বনাঞ্চল সৃষ্টি করা অত্যাবশ্যক। এ ক্ষেত্রে উপকূলীয় বনায়নেরও কোনো বিকল্প নেই। এই লক্ষ্যে ব্যক্তিগত এবং সরকারি উদ্যোগে পতিত জমি, নদী ও রাস্তার পাড়ে প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানো দরকার। দেশের অরক্ষিত বিশাল চরাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক বনাঞ্চল সৃষ্টি করে সবুজবেষ্টনী গড়ে তোলা জরুরি। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত সমন্বিত উদ্যোগে দীর্ঘমেয়াদি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন এবং রোপিত গাছপালার নিয়মিত পরিচর্যা দেশের বনজসম্পদ বৃদ্ধি এবং পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। উপকূলীয় বনভূমি সুরক্ষাসহ উপকূলীয় এলাকায় নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি জোরদার করা হলে তা ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক থেকে দেশকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে। পুরোনো বন সংরক্ষণ, নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি এবং সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার করে দেশের বনভূমিকে আশাব্যঞ্জক পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব। জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন শীর্ষক এক সম্মেলনে প্রতিটি দেশে বনাঞ্চল বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘ন্যাশনাল ফরেস্ট্রি অ্যাকশন প্রোগ্রাম’ তৈরির আহ্বান জানানো হয়েছে। তাতে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেশের বনজসম্পদ রক্ষা, বৃদ্ধি, পরিবেশ উন্নয়ন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ‘ফরেস্ট্রি মাস্টার প্যান’ প্রণয়ন করা হয়েছে। আগামীতে দেশের মোট ভূমির ২০ শতাংশ বনায়নের আওতায় আনা হবে বলে আশা করা যায়। এই লক্ষ্যে বৃক্ষহীন অথচ বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত ৭ লাখ ৫৮ হাজার একর জমিতে নতুন গাছ লাগানোর কথা রয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নগরায়ণ হলে, শিল্পোন্নয়ের প্রয়োজনে বনভূমি কমে যাওয়া স্বাভাবিক। এ সত্ত্বেও শিল্পোন্নত দেশ মালয়েশিয়া দেশের মোট আয়তনের ৭৯ দশমিক ৭ শতাংশ বনাঞ্চল রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান বাংলাদেশের পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা করে উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে বন্ধ করতে হবে বৃক্ষনিধন। বর্তমানে দেশের মানুষের মাঝে গাছ লাগানোর উৎসাহ লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রতিবছর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বর্ষা ঋতুতে বৃক্ষমেলার আয়োজন করা হচ্ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে গাছের চারা ও কলম তৈরি করে বিক্রির বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে। ছাদবাগান থেকে বাড়ির আঙিনায় অনেকে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদগাছ লাগাতে শুরু করেছেন। দেশের বেশ কিছুসংখ্যক শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গ্রামমুখী হয়ে জমিতে বৃক্ষের উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করেছেন। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বন বিভাগের দায়িত্ব রয়ে গেছে। প্রাকৃতির পরিবেশ ভারসাম্যহীন উন্নয়ন কখনো টেকসই হতে পারে না। প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষায় নতুন বনাঞ্চল তৈরি করতে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close