মোতাহার হোসেন

  ১৬ নভেম্বর, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

বিশ্ব গণমাধ্যমের দৃষ্টিতে অনন্য শেখ হাসিনা

মহামারি করোনার অভিঘাতে আক্রান্ত বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সমভাবে। এই ধকল কেটে উঠতে না উঠতে রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের মুখে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি, বাংলাদেশের অর্থনীতি। করোনাকালে মানুষের জীবন, কর্মকাণ্ড ও অর্থনীতির চাকা সচল রখতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতি এবং মানুষের জীবনযাপনে তেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বিশ্বব্যাপী করোনায় মানুষের প্রাণহানি এবং অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রধানমন্ত্রীর সঠিক ও সময়োচিত পদক্ষেপে বাংলাদেশ স্বল্প সময়ে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। যুদ্ধাক্রান্ত অর্থনীতির এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে কোন দিকে মোড় নেয়, এখনই তা বলা সম্ভব নয়। এরই মধ্যে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক বাস্তুচ্যুত ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে ‘মানবতার জননী’ হিসেবে ভূষিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বের বিরাজমান টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে পদ্মা সেতু, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তল দেশে বঙ্গবন্ধু টানেলসহ প্রায় একডজন মেগা প্রকল্প ‘বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তুলনা তিনি নিজেই, তিনি আমাদের অহংকার, আমাদের গৌরব, আমাদের সুখে-দুঃখের কাণ্ডারি, অন্ধকারে আশার আলো। তিনি মার্গারেট থ্যাচার বা ইন্দিরা গান্ধীর চেয়ে বেশিবার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন।

বিশ্বের দেশে দেশে প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ নেতৃত্ব, কেরিশম্যাটিক লিডারশিপ প্রভৃতি আখ্যায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি তাকে নিয়ে দুটো সংবাদপত্র সংবাদ প্রকাশ করেছে। ‘শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে বিশ্বের প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অন্যটি প্রকাশ করে ‘আউটলুক ইন্ডিয়া সাময়িকী’। উভয় প্রতিবেদনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন, নেতৃত্ব ও ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।

টাইম ম্যাগাজিন লিখেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন এক বিস্ময়কর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যার হাত ধরে ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশ নিতান্ত পাট উৎপাদনকারী থেকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলা হয়, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের পর ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা বিশ্বে সবচেয়ে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা নারী রাষ্ট্রপ্রধান। এ সময়ের মধ্যে তিনি সব পক্ষকেই পরাস্ত করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি আগামী জানুয়ারিতে আবারও জাতীয় নির্বাচনে লড়তে যাচ্ছেন এবং এই লড়াইয়েও জেতার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আত্মবিশ্বাসী যে আমার জনগণ আমার সঙ্গে আছে। তারাই আমার প্রধান শক্তি।’

রাজনীতির ময়দানে শেখ হাসিনার লড়াই-সংগ্রামের কথা তুলে ধরে টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনীতিতে আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এখন পর্যন্ত ১৯ বার গুপ্তহত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো কিছু রাজনৈতিক দল আবারও নির্বাচন বয়কটের হুশিয়ারি দিয়েছে। তাদের দাবি, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে দিতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ এখন নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সদস্যের সংখ্যার দিক থেকে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবদান সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশি অভিবাসীরা এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে বাণিজ্যিক ও উন্নয়ন অগ্রগতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সরাসরি বিনিয়োগের বৃহত্তম উৎস এবং বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির শীর্ষ গন্তব্য। তিনি প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছেন।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটি ক্ষেত্রে চীনের ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক উপস্থিতির মোকাবিলা করতে মরিয়া, যা তাদের সরকারি নীতি থেকেই স্পষ্ট। আর সেই নীতি থেকেই ‘ওয়াশিংটন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নীতির বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে বলে মনে হচ্ছে। এই বিশ্লেষকের মতে, এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় একটি ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। আর তা হলো, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে বাংলাদেশের ওপর তারা যে চাপ দিচ্ছে তার বিপরীত ফল হতে পারে।

শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক সাফল্য প্রশংসনীয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৬ সালে জিডিপির পরিমাণ ছিল মাত্র ৭১ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারে। শুধু তা-ই নয়, একসময় বাংলাদেশ খাদ্য সংকটের দেশ হলেও এখন খাদ্য রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। সামাজিক সূচকেও উন্নতি হয়েছে। প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৯৮ জন মেয়ে শিশুই বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। বাংলাদেশ হাইটেক ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার লড়াইয়ের প্রশংসা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও জলবায়ু সংকটের মধ্যে রয়েছে। প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় এই ব-দ্বীপে আঘাত হানে। ফলে বছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়। অন্যদিকে সমুদ্রের পানিস্তর ক্রমশ বেড়েই চলেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার আয়তনের চার গুণ বেশি জনসংখ্যার জীবন ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। যার জন্য দায়ী মূলত উন্নত বিশ্বের দেশগুলো।

শেখ হাসিনা সেই উন্নত দেশগুলোর কাছে শুধু নিজের দেশই নয়, অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ২০২৫ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের দাবিতে সোচ্চার। তিনি বলেছেন, ‘আমরা শুধু প্রতিশ্রুতি শুনতে চাই না। উন্নত দেশগুলোকে এবার এগিয়ে আসতেই হবে।’ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, শেখ হাসিনা টানা তিন মেয়াদে সরকারে থেকে উন্নয়নের যে অগ্রযাত্রা ধরে রেখেছেন, তা বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বারবার বাধা দেওয়া চেষ্টা করেছে বিএনপি। যে কারণে বিএনপিকে একটি ‘সন্ত্রাসী দল’ বলে অভিহিত করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি সমর্থকরা যেভাবে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছিল, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আবারও সেই জ্বালাও-পোড়াও শুরু করেছে তারা।

অন্যদিকে, ‘আউটলুক ইন্ডিয়া সাময়িকী’ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের দৃঢ় সমর্থন থাকবে বলেও উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সাময়িকী আউটলুক ইন্ডিয়া। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের ওপর বিরোধী দল, যুক্তরাষ্ট্র ও বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের চাপ থাকলেও পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের কোনো আগ্রহ নেই সরকারের। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারত প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কিছু বলেনি এবং ধারণা করা হচ্ছে তিনি (শেখ হাসিনা) যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটির প্রতি সমর্থন থাকবে নয়া দিল্লির।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দিল্লি এ ক্ষেত্রে লো প্রোফাইল বজায় রাখছে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপকারী হিসেবে চিহ্নিত হতে চায় না। এক বছর ধরে বিএনপিও বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছে। তবে দিল্লির অবস্থান পাল্টাবে বলে মনে হয় না। শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগকে দৃঢ় সমর্থন জানাবে। এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়োগের জন্য শেখ হাসিনাকে চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে আসছে ওয়াশিংটন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের ওপর চাপ থাকলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধীদের দাবি মানবে না। তিনি আত্মবিশ্বাসী যে ১৫ বছরের শাসনামলের ইতিবাচক রেকর্ড তাকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসবে।

এদিকে ২০১৪ সালে বিএনপির নির্বাচন বয়কট করা ছিল কৌশলগত ভুল। বিএনপি ও তাদের জোট মিত্র জামায়াতে ইসলামী ওই সময় রাজপথে নজিরবিহীন সহিংসতার জন্ম দিয়েছিল। এবারও বিএনপির নির্বাচন বয়কটের কৌশল সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের অংশ হতে পারে বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ জানুয়ারিতে যখন আরেকটি বিক্ষোভপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। রাজপথে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর লড়াই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ঢাকা আবারও অস্থিতিশীল। এর পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লিকে কিছু বিষয় আমলে নিতে হবে। প্রথমত, জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। এই নির্বাচন সামনে রেখে আবারও বিদেশি শক্তির লড়াইয়ের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে ঢাকার ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে বাংলাদেশে উপস্থিতি বৃদ্ধি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চীন। এর ফলে শত্রু এবং মিত্রের মধ্যবর্তী এক জটিল অবস্থায় পড়েছে ভারত।

দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন বাংলাদেশ। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নেমে গেছে ২০ বিলিয়ন ডলারে। এ দিয়ে তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানো কঠিন। এর সঙ্গে জীবন ধারণের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেপ্টেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়িয়েছে শতকরা ৯ দশমিক ৬ ভাগে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রণয় বর্মা। বৈঠকে উভয় দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার অবস্থা নিয়ে তারা সন্তোষ প্রকাশ করেন। আমাদের প্রত্যাশা, দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরব বিচরণ, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আগামী দিনেও অব্যাহত থাকবে সমভাবে।

লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ এবং সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close