হাসান কামরুল
দৃষ্টিপাত
সমুদ্রের পরিবেশ ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ জরুরি
গভীর সমুদ্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিরসন নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমুদ্র বিভিন্ন কারণে দূষিত হয়ে পড়ছে। এর অন্যতম কারণ জাহাজ থেকে নির্গত বিভিন্ন তরল বর্জ্য ও অধিক পরিমাণে সমুদ্রসম্পদ আহরণ। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ১৯ সেপ্টেম্বর গভীর সমুদ্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণা-সংক্রান্ত এক উচ্চপর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশ, আর্জেন্টিনা, টোঙ্গা, কুক আইল্যান্ডসহ সদস্যরাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা অংশ নেন। গভীর সমুদ্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে কীভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জাতিসংঘের ঘোষিত উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারে, সে বিষয়ে সভায় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গভীর সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য রক্ষা, সমুদ্রসম্পদের পরিমিত ব্যবহার ও পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন এবং সেই সঙ্গে সমুদ্রসম্পদের সঠিক ব্যবহারের ফলে জাতিসংঘ ঘোষিত উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব বলেও আশা করেন।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান-সম্পদসমৃদ্ধ ও জীববৈচিত্র্য এ উপসাগরকে অতুলনীয় করে তুলেছে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত ব্লু ইকোনমি, বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভস, ডেল্টাপ্ল্যান ইত্যাদি সমুদ্রসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের লক্ষ্যেই প্রণয়ন করা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে প্রায় ১ হাজার ২০০ প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ ও ২০০ প্রজাতির ফাইটোপ্লাঙ্কটন ও জুপ্লাঙ্কটন (সমুদ্রের নিচে বিভিন্ন ধরনের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমাবেশ) রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ২ দশমিক ২ মিলিয়ন মানুষ সরাসরি সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ পেশায় জড়িত। প্রত্যক্ষভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের বহু মানুষের মূল পেশা মাছ ধরা ও বিক্রি করা। বাংলাদেশের সামুদ্রিক মাছের বহির্বিশ্বে বিশাল বাজার রয়েছে এবং বাংলাদেশ সামুদ্রিক মাছ ও সি ফুড রপ্তানি করে বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করে (সূত্র : মৎস্য অধিদপ্তর)। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতিবছর প্রায় ৮ মিলিয়ন টন সামুদ্রিক মাছ আহরণ করা হয়; এর মধ্যে বাংলাদেশের জেলেরা মাত্র ৭০ হাজার টন মাছ ধরতে সক্ষম (সূত্র : স্যাভ আওয়ার সি)। এত বিশাল মজুদের মাত্র কিয়দংশ বাংলাদেশ আহরণ করে। যদি সক্ষমতা বাড়ানো যায়, তবে সমুদ্রে মৎস্য আহরণে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। আধুনিক স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ব্যবহার করা, উন্নতমানের বোট সংযোজন ও প্রশিক্ষিত জনবল ব্যবহার করার মাধ্যমে সামুদ্রিক মাছ আহরণের পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে।
বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি ব্লক গভীর সমুদ্রে ও বাকি ১১টি ব্লক অগভীর সমুদ্রের অন্তর্ভুক্ত। কয়েক বছর ধরেই সরকার দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে এসব ব্লকে দ্বিমাত্রিক ও সিসমিক সার্ভে করে যাচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত সঠিক রিজার্ভের পরিমাণ জানা যায়নি। সম্প্রতি আমেরিকানভিত্তিক পৃথিবীর বিখ্যাত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি এক্সন মবিল বাংলাদেশের গভীর ও অগভীর সমুদ্রাঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের আগ্রহপত্র দিয়েছে। এর আগেও আরেক বিখ্যাত কোম্পানি কনোকো ফিলিপস বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধান কার্যক্রমে জড়িত ছিল। আশপাশের দেশগুলো যেমন মিয়ানমার তাদের সমুদ্রের অংশে গ্যাসের বিশাল মজুদ (১০০ টিসিএফ) পেয়েছে বলে স্বীকার করেছে। সে হিসেবে বাংলাদেশের অংশেও একটা সন্তোষজনক রিজার্ভ থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
সম্প্রতি জাইকার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী সেন্টমার্টিনে সামুদ্রিক অ্যাকোয়ারিয়াম স্থাপনে বাংলাদেশকে আধুনিক কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন। এটি সত্যিই একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হতে পারে, সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য বোঝার জন্য একটি অ্যাকোয়ারিয়াম খুবই দরকার। এটি মৎস্য ও সমুদ্রবিজ্ঞানীদের গবেষণার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। অ্যাকোয়ারিয়ামে যেসব প্রজাতির সম্মিলন ঘটবে তাদের খাদ্যাভ্যাস, চালচলন, জীবনধারণ, জন্মবিস্তার বা ব্রিডিং ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হবে; যা সমুদ্রসম্পদ আহরণে মৎস্য ও সমুদ্রবিজ্ঞানীদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করবে। এ ধরনের অ্যাকোয়ারিয়াম জাপান, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে। বাংলাদেশের কক্সবাজারেও ছোট পরিসরে এ ধরনের একটি অ্যাকোয়ারিয়াম রয়েছে, যা মেরিন ফিশারিজ ও নৌবাহিনীর গবেষণায় ব্যবহার হচ্ছে।
সরকার ২১০০ সালের মধ্যে ডেল্টাপ্ল্যান বাস্তবায়নে যে কৌশল গ্রহণ করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সমুদ্রকেন্দ্রিক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতীকরণ। এ লক্ষ্যেই কক্সবাজারের মহেশখালীতে দেশের একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা হচ্ছে, যা বাংলাদেশ ও এর আশপাশের দেশগুলোর অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে ত্রিপুরা, আসাম, কলকাতা, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার- এসব অঞ্চলের উদ্যোক্তারা এ পোর্ট ব্যবহার করে তাদের বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে পারবেন। ফলে চট্টগ্রাম পোর্টেরও সক্ষমতা বাড়বে বহু গুণে। মালামাল পরিবহনে খরচ ও সময় দুটিই কমবে। আর এ পোর্ট হয়ে উঠবে আঞ্চলিক বিজনেস হাব। এখন চট্টগ্রাম পোর্টে বড় জাহাজ (৫০ হাজার টন ও এর অধিক) সরাসরি ভিড়তে বা নোঙর করতে পারে না, এসব জাহাজ গভীর সমুদ্রে নোঙর করে রাখা হয়, তারপর ছোট ছোট জাহাজ বা লাইটার জাহাজে করে মালামাল লোড-আনলোড করা হয়। ফলে পরিবহন খরচ বেড়ে যায় বহু গুণে এবং আমদানি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত টাকা যোগ হয়ে পণ্যের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর অপারেশনে আসার পর এ ধরনের খরচ কমিয়ে আনা যাবে বহুলাংশে। কারণ, বড় জাহাজ (৫০ হাজার থেকে শুরু করে লাখ টনের জাহাজ) সরাসরি বন্দরে ভিড়তে পারবে এবং মালামাল খালাস করতে পারবে। এতে আমদানি ব্যয় অনেকাংশে কমবে, এটি আশা করা।
বিশ্বব্যাপী সমুদ্র অঞ্চল বিভিন্নভাবে দূষিত হচ্ছে। সমুদ্রকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য দিন দিন বেড়েই চলছে। ২০২২ সালে শুধু এশিয়া অঞ্চলে ১১ বিলিয়ন টন পণ্য আমদানি রপ্তানি হয়েছে (রপ্তানি হয়েছে ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন টন ও আমদানি হয়েছে ৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন টন)। এর মধ্যে ৪২ শতাংশই ছিল খাদ্যপণ্য; যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি (সূত্র : ইউএনসিটিএডি)। এশিয়া অঞ্চলে পৃথিবীর মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় অর্ধেক হয়ে থাকে। সারা বিশ্বের ব্যবসায়ীরা এশিয়াভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যে ঝুঁকে পড়ছেন। এতে এ অঞ্চলের সমুদ্র মারাত্মক হারে দূষণের শিকার হচ্ছে। জাহাজ থেকে নানা ধরনের বিষাক্ত তরল ও কঠিন বর্জ্য যেমন ব্লাস্ট ওয়াটার ও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ পরিশোধন ছাড়াই সমুদ্রে ফেলা হচ্ছে, যা সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। তা ছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, সুনামি সমগ্র বিশ্বের সমুদ্রকে ক্রমেই উত্তপ্ত করে তুলছে। এতে সমুদ্রকেন্দ্রিক পেশায় ঝুঁকি বাড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে প্রশমনব্যবস্থা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা না গেলে এশিয়া অঞ্চলের সমুদ্র মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এর প্রভাব পড়বে এ অঞ্চলের মানুষের ওপর। সমুদ্রের পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা এবং দূষণরোধে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় প্রশমনব্যবস্থার কার্যকর বাস্তবায়নে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। কিছুদিন পরপরই কক্সবাজারে সমুদ্রের ঢেউয়ে মাছসহ অনেক মৃত সামুদ্রিক জীব ভেসে আসার খবর পাওয়া যায়। কেন এত মৃত প্রাণী ভেসে আসে, তার অনুসন্ধান করতে হবে এবং এসব সমস্যার সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সমুদ্রে পরিবেশের ঝুঁকি নিরূপণে এশিয়ার প্রতিটি দেশকে নিজ নিজ উদ্যোগ গ্রহণ করে ক্রসবর্ডার প্রকল্প বা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার স্বার্থে ব্লু ইকোনমি বা নীল অর্থনীতি বাস্তবায়নের
মানদণ্ড নির্ণয় করে সম্পদ আহরণে মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। অন্যথায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এমনভাবে চেপে বসবে যে, সেই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের খুব একটা সুযোগ পাওয়া যাবে না।
লেখক : জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক
"