নিরঞ্জন রায়

  ০৩ অক্টোবর, ২০২৩

মতামত

অর্থ পাচার রোধে ব্যাংকারদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন লেনদেন সম্পন্ন করা যাবে, আর কোনটি যাবে না, তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হবে কীভাবে? এখানেই হচ্ছে ব্যাংকারদের মুনশিয়ানা। আর এই মুনশিয়ানা নির্ভর করে ব্যাংকারদের পর্যাপ্ত এবং ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের ওপর। ব্যাংকিং পেশার গুরুত্বপূর্ণ একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিয়মের ব্যত্যয় করে কোনো লেনদেন সম্পন্ন করলেও, যদি সেটি সঠিক হয় বা কোনো রকম ক্ষতিকর না হয়, তাহলে সব ঠিক থাকে এবং ব্যাংকারদের তখন কোনো দোষ থাকে না। পক্ষান্তরে, শতভাগ নিয়ম মেনে কোনো লেনদেন সম্পন্ন করা সত্ত্বেও যদি সেটি সঠিক না হয় বা ক্ষতিকর কিছু হয়, তাহলে প্রথম অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় ব্যাংকারদের।

কিছুদিন আগে দেশ থেকে একজন ব্যাংকার আমার কাছে এলসির মাধ্যমে লেনদেনের জটিল একটি বিষয় জানতে চেয়েছিলেন। বিষয়টি এমন যে, দেশের একজন আমদানিকারক এলসি খুলে বিদেশ থেকে দামি দীর্ঘস্থায়ী একটি মেশিন আমদানি করে এনেছেন এবং এর মূল্যও যথারীতি পরিশোধ করে দিয়েছেন। মেশিনটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ওয়ারেন্টির অধীনে ছিল। ওয়ারেন্টি হচ্ছে বিক্রয়চুক্তির একটি বাড়তি সুবিধা, যার মাধ্যমে মূল্যবান জিনিসপত্র বা মেশিনের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সঠিকভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। কোনো মেশিন যদি ওয়ারেন্টি বলবৎ থাকা অবস্থায় নষ্ট হয়ে যায় বা ঠিকমতো কাজ না করে, তাহলে সেই মেশিনের উৎপাদনকারী বা সরবরাহকারী ওয়ারেন্টির শর্ত অনুযায়ী মেশিনটি ঠিক করে দেবে অথবা মেশিনটি পরিবর্তন করে নতুন একটি মেশিন সরবরাহ করবে।

মূল্যবান জিনিসপত্র বা দীর্ঘস্থায়ী মেশিন বিক্রির ক্ষেত্রে এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। উল্লিখিত সেই আমদানিকারকের আমদানি করা মেশিনটি ঠিকমতো কাজ করছে না এবং বাংলাদেশে সেটি ঠিক করারও ব্যবস্থা নেই। যেহেতু মেশিনটি ওয়ারেন্টির অধীনে আছে, তাই সেটি এখন রপ্তানিকারকের কাছে ফেরত পাঠাতে হবে। যাতে এটি ঠিক করে অথবা এর পরিবর্তে নতুন আরেকটি মেশিন পাঠিয়ে দিতে পারে। সেই ব্যাংকারের জানার বিষয় হচ্ছে- এভাবে আমদানি করা মেশিন ফেরত পাঠাতে কোনো সমস্যা হবে কি না।

খালি চোখে দেখলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা বলেই মনে হবে। আপাতদৃষ্টিতে এতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এমনকি ব্যাংকে যারা গ্রাহকসেবা (রিলেশনশিপ ম্যানেজার), বিক্রয় বা সেলস এবং মার্কেটিং বিভাগে কাজ করেন, তাদের কাছেও বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক মনে হবে। এমনকি যারা ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেন বা এলসি বিভাগে কাজ করেন, তারাও দেখবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম বা ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অনুমোদন করে কি না। যদি করে তাহলে তাদের কাছেও বিষয়টি খুবই সাধারণ মনে হবে। সমস্যা হয় তখনই যখন বিষয়টি কমপ্লায়েন্স বা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়।

কেননা, সে ক্ষেত্রে লেনদেনের ভালো দিক যত না দেখা হয়, তার চেয়ে বেশি খতিয়ে দেখা হয় সেই লেনদেনের সঙ্গে ক্ষতিকর দিক কী থাকতে পারে, বিশেষ করে এর সঙ্গে অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত কোনো ঝুঁকি আছে কি না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কারণেই আলোচ্য বিষয়টিতে অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত ঝুঁকি বিদ্যমান। সেই ঝুঁকির বিষয়টি সম্পূর্ণ লাঘব না করে কোনোভাবেই এই ধরনের লেনদেনকে স্বাভাবিক মনে করার কারণ নেই। এখানেই ব্যাংকারদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ বলতে একেবারে প্রায়োগিক বা হাতে-কলমে কাজের আলোকে প্রশিক্ষণ। একজন ব্যক্তি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দক্ষ হতে পারেন, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রশিক্ষণ যদি না নেওয়া থাকে তাহলে এই ধরনের কৌশলী বিষয় বুঝে ওঠা সম্ভব নয়।

আলোচ্য লেনদেনের যে ধরন বা কাঠামো, তাতে ট্রেড-বেজড অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত ঝুঁকি বিদ্যমান। মূল বা অরিজিনাল লেনদেনটি যদি অর্থ পাচারের উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়ে থাকে, তাহলে প্রথম লেনদেনটি, অর্থাৎ এলসি খোলা, মেশিনারি ইন্সপেকশন, মেশিনারি দেশে আসা এবং এলসির মূল্য পরিশোধের সবই একটি বৈধ লেনদেন হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এ-সংক্রান্ত ফাইলও ক্লোজ হয়ে যাবে। সবাই বিষয়টি মাথা থেকে ঝেড়েও ফেলবে। এক বছর পর ঠিকমতো কাজ করছে না- এর জন্য যার মেশিন তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো এবং সেখান থেকে পুরোনো অকেজো একটি মেশিন ধোয়ামোছা এবং রংচঙের মাধ্যমে চকচকে করে নিয়ে এসে ফেলে রাখা হলো। যেহেতু লেনদেনের এই অংশে কোনো রকম এলসি খোলা বা অর্থ আদান-প্রদান হয়নি, তাই এটি নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামাবে না, যদি না বিশেষ কোনো তদন্ত শুরু হয়।

লেনদেনের পুরো প্রক্রিয়া বা সাইকেল সম্পন্ন হওয়ার পর এই মেশিন আমদানির এলসি বাবদ যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়েছিল, সেখান থেকে আনুষঙ্গিক খরচ ও কমিশন বাবদ অর্থ কেটে রেখে বাকি অর্থ পাচারকারীকে দিয়ে দেওয়া হবে। এভাবেই জটিল লেনদেন কাঠামো তৈরি করে ট্রেড-বেজড মানি লন্ডারিং সংঘটিত হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের বিশেষ সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এ সমস্যার সমাধান হবে কীভাবে। সে ক্ষেত্রে লেনদেনের মূল সমস্যায় যেতে হবে এবং আন্তর্জাতিক প্র্যাকটিস অনুসরণ করে বিষয়টির সমাধান করতে হবে। প্রথমত, বিক্রয় চুক্তির শর্তগুলো পর্যালোচনা করে দেখতে হবে যে, সেখানে ওয়ারেন্টির অধীনে কী ধরনের সুবিধা প্রদানের কথা উল্লেখ আছে। মেশিনটি যদি সঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে কীভাবে সমাধান করা হবে। অর্থাৎ, সমস্যাটি সংশোধন করে মেশিনটি যথাযথভাবে চালু করার ব্যবস্থা করা হতে পারে, অথবা মেশিনটি পরিবর্তন করে নতুন একটি মেশিন সরবরাহ করা হবে। প্রথম ক্ষেত্রে এই ধরনের মেশিন উৎপাদনকারী বা সরবরাহকারীর অঞ্চলভিত্তিক কিছু দক্ষ লোকবল থাকে, যাদের পাঠিয়ে মেশিনের সমস্যাটি সমাধান করা হয়।

দ্বিতীয় ক্ষেত্রে যদি সেভাবে মেশিনের ত্রুটি দূর করা সম্ভব না হয়, তাহলে ধরে নেওয়া হয় যে, মেশিনটি ব্যবহারের উপযোগী করা যাবে না। তখন নতুন একটি মেশিন আমদানিকারকের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে আগের মেশিনটি স্ক্র্যাপ করে দিতে বলা হয়। যদি পরিবেশগত কারণে আগের মেশিনটি স্থানীয়ভাবে স্ক্র্যাপ করা সম্ভব না হয়, তাহলে তারা সেটি যেনতেনভাবে ফেরত পাঠিয়ে দিতে বলে। এ ক্ষেত্রে পেশাদার প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির মাধ্যমে দ্বিতীয় মেশিনটি চালু করে সঠিকভাবে কাজ করার বিষয়ে একটি কমিশনিং সনদ প্রদান করার বাধ্যবাধকতা থাকে।

অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন যে, যত পদক্ষেপই নেওয়া হোক না কেন অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং বন্ধ করা যাবে না। তাদের ধারণা অমূলক নয় মোটেই। কারণ, যত পদক্ষেপই গ্রহণ করা হোক না কেন এই অপরাধ শতভাগ নির্মূল করা সম্ভব নয় এবং বিশ্বের কোনো দেশেই সেটি সম্ভব হয়নি। বিগত দুই যুগ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কঠোর মাত্রার মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনসহ অনেক শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে। তার পরও এই অপরাধ শতভাগ বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। তবে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংকারদের জ্ঞানের অভাব, দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতার কারণে যে সব অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং সংঘটিত হয়ে থাকে, তা যথেষ্ট হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে।

উল্লেখ্য, অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং সংঘটিত হয়ে থাকে বিভিন্নভাবে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ১. সংঘবদ্ধ পাচারকারীদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে, ২. কর্তৃপক্ষ বা ক্ষমতাসীনদের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতা এবং ৩. ব্যাংকারদের অজ্ঞতা, দুর্বলতা এবং সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে। প্রথম দুটো ক্ষেত্রে অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং বন্ধ করতে ব্যাংকাররা এককভাবে খুব একটা সফল হতে পারবেন না। জাতীয়ভাবে এবং সম্মিলিতভাবে অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করলেই হয়তো এই ধরনের অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং কমিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু তৃতীয় ক্ষেত্রে যেভাবে অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং হয়, তা বন্ধ করতে ব্যাংকাররা ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকাররা সেই ভূমিকা রাখছেনও। দেশের ব্যাংকাররাও পারবেন যদি তাদের সেভাবে তৈরি করা যায়। আর এখানেই ব্যাংকারদের পর্যাপ্ত এবং ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

অনস্বীকার্য যে, দেশের প্রচলিত আইন, যেমন- মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশনসহ অন্যান্য আইন ও বিধিবিধান মেনেই লেনদেন করতে হবে। কিন্তু প্রচলিত আইন এবং বিধিবিধান মেনে চললে সব লেনদেন সম্পন্ন করা সম্ভব নাও হতে পারে। যেসব লেনদেন প্রচলিত আইন এবং বিধিবিধান মেনে পরিচালিত হবে এবং যেখানে অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত কোনো রকম ঝুঁকি নেই, শুধু সেসব লেনদেন ব্যাংকাররা সম্পন্ন করতে অনুমোদন দেবে। যেসব লেনদেনের ক্ষেত্রে দেশের এবং আন্তর্জাতিক আইন ও বিধিবিধান মেনে চলা সত্ত্বেও কোনো রকম অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত ঝুঁকি থাকবে, সেসব লেনদেন ব্যাংকাররা কোনো অবস্থাতেই অনুমোদন করবেন না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন লেনদেন সম্পন্ন করা যাবে, আর কোনটি যাবে না, তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হবে কীভাবে? এখানেই হচ্ছে ব্যাংকারদের মুনশিয়ানা। আর এই মুনশিয়ানা নির্ভর করে ব্যাংকারদের পর্যাপ্ত এবং ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের ওপর। ব্যাংকিং পেশার গুরুত্বপূর্ণ একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিয়মের ব্যত্যয় করে কোনো লেনদেন সম্পন্ন করলেও, যদি সেটি সঠিক হয় বা কোনো রকম ক্ষতিকর না হয়, তাহলে সব ঠিক থাকে এবং ব্যাংকারদের তখন কোনো দোষ থাকে না। পক্ষান্তরে, শতভাগ নিয়ম মেনে কোনো লেনদেন সম্পন্ন করা সত্ত্বেও যদি সেটি সঠিক না হয় বা ক্ষতিকর কিছু হয়, তাহলে প্রথম অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় ব্যাংকারদের।

ব্যাংকারদের এই ধরনের ঝুঁকি শতভাগ লাঘব করা না গেলেও, উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে রাখা সম্ভব শুধু পর্যাপ্ত এবং ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে। আমাদের বিশ্বাস, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে তাদের কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত এবং ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে।

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close