মো. সাখাওয়াত হোসেন

  ০২ অক্টোবর, ২০২৩

মতামত

স্ট্যাচু অব লিবার্টির দেশ অপতৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু

গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট মাধ্যম থেকে জানা যায়, প্রায় দেড় শ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে নিউইয়র্কের লিবার্টি দ্বীপে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দুই দেশের জনগণের বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ ফ্রান্সের জনগণের পক্ষ থেকে ভাস্কর্যটি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে উপহার দেওয়া হয়। স্ট্যাচু অব লিবার্টি নামে পরিচিত হলেও ভাস্কর্যটির মূল নাম ‘লিবার্টি এনলাইটেনিং দ্য ওয়ার্ল্ড’। ভাস্কর্যটির ডান হাতে আছে প্রজ্বালিত মশাল এবং বাঁ হাতে একটি বই, যার মলাটে রোমান অক্ষরে লেখা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার তারিখ ৪ জুলাই ১৭৭৬। স্ট্যাচু অব লিবার্টির মুকুটে আছে সাতটি কাঁটা, যা সূর্য, সাত মহাদেশ বা সাত সমুদ্রকে নির্দেশ করে। এর পায়ের কাছে পড়ে থাকা ভাঙা শিকল যুক্তরাষ্ট্রের দাসপ্রথা রহিতকরণের প্রতীক। স্ট্যাচু অব লিবার্টির মূল ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১৫১ ফুট। তবে বেদিসহ এর উচ্চতা ৩০৫ ফুট। বিশাল এ ভাস্কর্যের নাকের দৈর্ঘ্য ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং এর দুই কানের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১০ ফুট। তামার তৈরি মূর্তিটির ওজন দুই লাখ কেজির বেশি। ১৮৮৬ সালের ২৮ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড ভাস্কর্যটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ১৯২৪ সালে একে জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করে।

অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যাচু অব লিবার্টি স্বাধীনতার সপক্ষে দাঁড়িয়ে আছে, স্বাধীনতার চর্চা ও স্বাধীনতার বার্তা পুরো পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার নিমিত্তে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করার কথা। কিন্তু স্বাধীনতাকে রহিত করার লক্ষ্যে দেশটি থেকে ষড়যন্ত্র হয়, হচ্ছে এমন বার্তাই পৃথিবীব্যাপী চলমান। এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্ট্যাচু অব লিবার্টির যে দর্শন সেটি কিন্তু একেবারে সাংঘর্ষিক। সাম্রাজ্যবাদের যে নীতি আমেরিকা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে সেটি যদি চলমান থাকে তাহলে দেখা যাবে পৃথিবীর মধ্যে সর্বসময় এক ধরনের সংঘাত ও যুদ্ধময় পরিস্থিতি বজায় থাকবে। বর্তমানে চলমান রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে এ জায়গাতেও যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন; যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে পুরো পৃথিবীকে নিজের কবজায় নিয়ে আসা এবং এ জন্য যা যা করণীয় সে সমেত কাজ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এমনও দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রকে খুব অযাচিত উপায়ে হস্তক্ষেপ করে রাষ্ট্রের মধ্যে একটি বিশৃঙ্খল ও অরাজকতা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাঁয়তারা করছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এ স্লোগানে যুক্তরাষ্ট্রের চলমান আন্দোলন নিয়েও অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে, দ্বিধা সন্দেহ রয়েছে।

যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা চর্চা করার কথা, স্বাধীনতা যাতে বলবৎ থাকে সে লক্ষ্যে কাজ করার কথা, তা না করে একটি দেশের স্বাধীনতাকে কীভাবে খাটো করা যায়, কটাক্ষ করা যায় সে কাজটি করছে যুক্তরাষ্ট্র, তথা ইন্ধন জোগাচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচারকাজ বন্ধে বিবৃতি প্রদান করেছেন। শুধু তা-ই নয়, এ বিবৃতির সঙ্গে বিশ্ববরেণ্য অনেকেই রয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একটি দেশের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী চলমান বিচারকাজ বন্ধ করতে কেউ কি বিবৃতি দিতে পারে? আচ্ছা আমেরিকাতে যখন বর্ণবৈষম্যের কারণে অনেকেই নির্যাতনের শিকার হন, তখন তো কেউ বিবৃতি দেন না কিন্তু বিষয়টি স্পষ্টতই মানবাধিকারের লঙ্ঘন। অথচ আমেরিকাতে বর্ণবৈষম্য এখনো প্রবল। সে জায়গায় বাংলাদেশে বিচারাধীন বিষয় বন্ধ করতে বিবৃতি প্রদান এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আঘাত হানার শামিল। বিচার নিষ্পত্তি হলে বিচার প্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি হলে সে ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্তের মিশেলে বক্তব্য দেওয়া যেতে পারে। অবশ্য আমেরিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল।

অনেকেই বলছেন, বিবৃতি দেওয়ার আগে বিষয়বস্তু না জেনেই বিবৃতিদাতারা বিবৃতি দিয়েছেন। শ্রমণ্ডঅধিকার ও শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়ে চলমান মামলায় বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিরা বিবৃতি দেওয়ার আগে সার্বিক বিষয়ে যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন ছিল। সে কারণেই লবিষ্টের প্রসঙ্গ চলে আসে, কেননা লবিষ্ট শুধু আইনজীবীর মতো অর্পিত কাজকে গ্রহণ করে এবং অর্পিত কাজকে যেকোনো মূল্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই লবিষ্টরা তাদের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে থাকেন। ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি প্রদানের পক্ষেও এমন হয়ে থাকতে পারে। তিনি প্রস্তাব রেখেছেন, নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিয়েছেন এবং বিনিময়ের কারণেই সংশ্লিষ্টরা বিবৃতি দিয়ে থাকতে পারেন। উল্লেখ্য, এর আগে হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী পরিচালনায় বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়েছিলেন ড. ইউনূস।

শুধু তা-ই নয়, বিবৃতি যদি ড. ইউনূস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে একভাবে মূল্যায়ন করা হতো কিন্তু বিবৃতি গড়িয়েছে দেশের নির্বাচন নিয়েও। বাংলাদেশের নির্বাচন হবে বাংলাদেশের সংবিধান মেনে, আইন অনুযায়ী। সেখানে অন্যদের মতামত প্রদানের অধিকার থাকার কথা নয়। আচ্ছা পাশের দেশ ভারতের নির্বাচন নিয়ে কি বাংলাদেশ কথা বলতে পারে? আবার আমেরিকার নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে কি ভারতের কথা বলার নৈতিকতা রয়েছে? নিশ্চয়ই নেই, তাহলে বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে অন্যদের মাথা ঘামানোর কথা নয়। তবে মাথা ঘামানোর জন্য কাজ করা হয় সেটিই মূল কথা। বিশেষ করে লবিষ্ট নিয়োগ করে তাদের দিয়ে কথা বলানো হয়ে থাকে, বিবৃতি দেওয়া হয়ে থাকে। লবিষ্টদের মূল কাজই হচ্ছে নিয়োগকর্তার ইচ্ছানুযায়ী কর্মসম্পাদন করা। এখানে লবিষ্টদের দোষারোপ করার কোনোরূপ সুযোগ নেই, কেননা তাদের কর্মই এটি। আবার অনেক ক্ষেত্রে লবিষ্টদের ইতিবাচক কাজেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশেষ করে কোনো দেশের সঙ্গে অন্য একটি দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে লবিষ্টদের ব্যবহার করার রীতি ও রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অপতৎপরতার ক্ষেত্রে লবিষ্টদের উপর্যুপরি ব্যবহার লবিষ্ট সম্পর্কে মানুষের মধ্যে তীব্র নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে বাংলাদেশ সম্পর্কে যত গুজব ও নেতিবাচক প্রোপাগান্ডার আবির্ভাব ঘটে সবকিছুর মূল উৎস আমেরিকা থেকে সৃষ্টি হয়। আবার নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার সূত্রপাতও আমেরিকা থেকে বের হয়। কাজেই বিষয়গুলো কিন্তু একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কযুক্ত। অন্যদিকে, বাংলাদেশের প্রচলিত বিচারে যাদের শাস্তি হয়েছে তাদের আশ্রয়স্থলও আমেরিকা। বিষয়গুলো প্রত্যেকটি স্ট্যাচু অব লিবার্টির বার্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বিপরীতমুখী আচরণের শামিল।

আমরা মনে করি, আমেরিকা স্ট্যাচু অব লিবার্টির বার্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজ দেশের মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিতে কাজ করবে এবং অন্য কোনো দেশে হস্তক্ষেপ করে ওই দেশের স্বাধীনতাকে ধূলিস্যাৎ করার অপচেষ্টা থেকে সরে আসবে। যে মহান ব্রত নিয়ে স্ট্যাচুটি দাঁড়িয়ে আছে তার মর্যাদা রক্ষা করতে পারলেই সাম্রাজ্যবাদের যে কালিমা আমেরিকার গায়ে জড়িয়ে আছে তা থেকেও মুক্তি পেতে পারে রাষ্ট্রটি। আমেরিকাকে এ বিষয়েও বুঝতে হবে কোনো কারণ ব্যতিরেকে বাংলাদেশের ওপর হস্তক্ষেপ পৃথিবীর কেউই মেনে নেবে না এবং আমেরিকার যে গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা তা ক্রমান্বয়ে কমে আসবে এবং অদূর ভবিষ্যতে গ্রহণযোগ্যতা একেবারে তলানিতে নেমে আসবে। সর্বোপরি বলা যায়, অন্যায়ভাবে অন্য দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ কোনো সভ্য দেশের কাজ হতে পারে না।

লেখক : চেয়ারম্যান

ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close