আবু আফজাল সালেহ

  ০১ অক্টোবর, ২০২৩

বিশ্লেষণ

ছোট ছোট উদ্যোগ বদলে দেবে চিত্র

পর্যটনের বাংলাদেশের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন স্পট/শ্রেণির স্পট আকৃষ্ট করতে সক্ষম। বড় কিছু উদ্যোগের সঙ্গে দরকার ছোট ছোট পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। ছোট ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্যোগ বদলে দেবে বাংলাদেশের পর্যটন খাত। বিশ্ব জানে, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। কান্তজিও, পাহাড়পুরসহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, মসজিদণ্ডমন্দির-প্যাগোডাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা। জল-পাথর-বন-পুরাকীর্তি-উপজাতি-চা নিয়ে বাংলাদেশের ট্যুরিস্ট স্পট অনেক সমৃদ্ধ। বৈচিত্র্যময় কৃষ্টিকালচারে দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করা সম্ভব।

পর্যটনকে বলা হয় অদৃশ্য অর্থনৈতিক শক্তি। পর্যটন হচ্ছে বিশ্বের শীর্ষ আয়ের খাতের একটি। পর্যটনশিল্প অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য খরভব নষড়ড়ফ হিসেবে কাজ করে ওইসব দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। এ শিল্পের সঙ্গে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে অনেক শিল্প নির্ভর করে। পর্যটন একটি বহুমাত্রিক ও শ্রমঘন শিল্প। সবচেয়ে দ্রুত সম্প্রসারণশীল ও বৃহৎ বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড হিসেবে এ শিল্প বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রচুর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় পর্যটন খাত থেকে। পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টর (যেমন- পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইনস ও অন্যান্য) যোগাযোগের মাধ্যম থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতি বছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য যেকোনো বৃহৎশিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বেশি। আমাদের সম্ভাবনাও প্রচুর রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের জন্য অত্যন্ত অনুকূল।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য আলাদা পরিকল্পনা নিতে হবে। একই সঙ্গে পাহাড়, সমুদ্র সৈকত, নদী, পাথর, বনাঞ্চল, ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্থাপত্য, বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা ইত্যাদির প্যাকেজ পৃথিবীর আর কোনো একক স্থানে নেই। শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্যটনে আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে, বাজেট বাড়াতে হবে। সুন্দরবন হচ্ছে আকর্ষণীয় একটি বিষয়। কিন্তু বনের বিভিন্ন অংশ সরকারের ভিন্ন ভিন্ন দপ্তর নিয়ন্ত্রণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে। এতে উন্নয়নে স্লথ হয়। ফলে, সুন্দরবনের জন্য দপ্তর/বিভাগ চালু করা যেতে পারে। আলাদা দপ্তর করা গেলে সুন্দরবনের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ একার হতেই থাকবে। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সহজ ও অল্পসময়ে করা সম্ভব হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবনের জন্য আলাদা দপ্তর ও মন্ত্রী রয়েছে। অথচ ৬২ শতাংশ সুন্দরবন বাংলাদেশের হয়েও আলাদা কোনো দপ্তর নেই। ইকো-ট্যুরিজম সর্বোচ্চ কাজে লাগানো দরকার। এ ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট ছোট অনেক স্পট গড়ে উঠেছে। তবে বড় বড় স্পটে পর্যায়ক্রমে পর্যটনবান্ধব করে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

বিদেশি পর্যটক যে দেশে যত বেশি সে দেশের পর্যটন থেকে আয় ততই বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্স বা ইউরোপে বিদেশিদের আনাগোনা অনেক বেশি। তাই এসব দেশে পর্যটন থেকে আয়ের পরিমাণও বেশি। এশিয়ার মধ্যে চীন, থাইল্যান্ডে পর্যটন খাত থেকে আয়ের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণও কিন্তু বিদেশি পর্যটক। ভারত বা শ্রীলঙ্কা আমাদের অঞ্চলে পর্যটন আয় বেশি। কারণ তাদের পরিকল্পিত চিন্তাভাবনা। ছোট রাষ্ট্রসমূহ (যেমন- হংকং, সিঙ্গাপুর, ম্যাকাউ, মালদ্বীপ ও ফিজি) কিন্তু পর্যটন খাত থেকে প্রচুর আয় করে শুধু বিদেশিদের আনাগোনার জন্যই। চীন, জাপান, মালয়েশিয়া পর্যটন খাত থেকে প্রচুর আয় করে দেশি পর্যটকের চেয়ে বিদেশি পর্যটকের জন্য। উল্লিখিত দেশের পর্যটন খাতে চীনের পর্যটক আয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে। পর্যটনশিল্পের প্রচারের জন্য ট্রেন/বাস/স্টিমার/লঞ্চ প্রভৃতির যাত্রী টিকিটে সংশ্লিষ্ট এলাকার ট্যুরিস্টম/ঐতিহ্যের ছবি সংযুক্ত করা যায়। সংশ্লিষ্ট ট্রেন- স্টেশন থেকে টিকিটে সেই এলাকার পর্যটন এলাকার ছবি ও একেবারেই সংক্ষিপ্ত শিরোনাম দিতে হবে। এতে মনের অজান্তেই যাত্রীরা সংশ্লিষ্ট এলাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকা/ঐতিহ্য স¤পর্কে জানতে পারবেন। জেলাভিত্তিক না-করা গেলেও রেলের টিকিটে অঞ্চলভিত্তিক এ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তবে বাস বা নৌযাত্রীদের টিকিটে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রাধান্য দিতে হবে। আর একটি সুপারিশ খুব কার্যকর হতে পারে- সেটি হলো ট্রেন স্টেশনগুলোতে বা বাস টার্মিনালে বা নৌবন্দরে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভ্রমণের চিত্র দেয়ালে তুলে ধরা যায় এবং ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করলে খুব ভালো হবে। ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরা নিকটস্থ স্পট ঘুরে আসতে অনুপ্রাণিত হবে বলে মনে করি। বিশ্বে চীনা পর্যটকরা বেশি ব্যয় করে। চীনের নাগরিকের বেশির ভাগ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাই তাদের আকৃষ্ট করতে বৌদ্ধ স্থাপনাগুলোতে যোগাযোগ ও অন্যান্য সুবিধা বাড়াতে হবে। চীনা পর্যটকদের আনতে পারলে অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার হবে। থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায় পর্যটন খাতে অনেক এগিয়ে। দেখা যায়, চীনা পর্যটকের হার অনেক বেশি এ দুদেশে। ভারতেও পর্যটন থেকে আয় অনেক হয়। কিন্তু শুধু চীনা/জাপানিদের উল্লিখিত দুদেশের সমান হতে পারেনি। তাই, উল্লিখিত দুই দেশ থেকে ভারত পিছিয়ে। বিশ্ব পর্যটকের বড় একটি অংশ খ্রিস্টান ধর্মের। অনেক পর্যটক বিভিন্ন ধর্মের প্রসিদ্ধ স্থাপনা ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। তাই, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও স্থাপনাগুলোতে অধিক নজর দেওয়ার দরকার বলে মনে করি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের স্থাপনাতেও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিশেষ নজর দিতে হবে।

দেশের বর্তমানের ১৭ জি-আই পণ্যকে দেশি-বিদেশি পর্যটকের কাছে পরিচিত করতে হবে। পাশাপাশি প্রসিদ্ধ কিছু খাবার/জিনিস যোগ হতে পারে। অনেক পর্যটন ¯পটে যাওয়ার কানেক্টিং রোড অপ্রশস্ত ও খারাপ। পর্যটন স্পটে যাওয়ার কানেক্টিং/লিংক রোডের উন্নয়ন করতে হবে। জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে পাহারপুর কানেক্টিং রোড বা রামসাগর লিংক রোড উদাহরণ হতে পারে। এগুলো প্রশস্ত, সংস্কার বা নির্মাণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহাসিক, ও প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর/স্থাপনা উন্নয়ন করতে হবে। উপজাতি সংস্কৃতির বিকাশ করতে ব্যবস্থা নিতে হবে। চা-শিল্পের উন্নয়ন ও বিস্তার করলে পর্যটক বাড়বে। নদী ও গ্রামীণ পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড গ্রামীণ পর্যটন থেকে অনেক আয় করে। আমাদের গ্রাম ও নদীকেন্দ্রিক পর্যটনে জোর দিতে হবে। হাওর পর্যটনে গুরুত্ব দিতে হবে। হাওরে উন্নয়ন করতে হবে। পর্যটন-স্পটগুলোতে নারী ও প্রতিবন্ধী পর্যটকদের জন্য বিশেষ সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। ওয়াসরুম ও নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। দুগ্ধ-কর্নার করা যেতে পারে। জেলাব্র্যান্ডিং জোরালো করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রচার বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বড় বা সব স্পটে হাত দিতে না-পারলেও পকেট পকেট পর্যটন স্পট বিকশিত করার পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। গুচ্ছ-উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন- (১) বোর্ডার ট্যুরিজম : চায়না-ভিয়েতনাম বোর্ডার ট্যুরিজম খুব কাজে দিচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হতে পারে আমাদের বিরাট সম্ভাবনা। যেমন- ‘বর্ডার হাট’ একটি ভালো পরিকল্পনা। (২) ধর্মীয় স্থাপনা : ভারত-শ্রীলঙ্কা-নেপাল হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নিদর্শন ভ্রমণ করেন অনেকে। বাংলাদেশ-ভারত মুসলিমণ্ডহিন্দু স্থাপনা এমন দৃষ্টান্ত হতে পারে। (৩) শহর পর্যটন : প্যারিস (র‍্যাংকিং-১), বেইজিং (২), সাংহাই (৩), ম্যাকাউ (৬), টোকিও (৭), ব্যাংকক (১০), সিঙ্গাপুর (১২) বিশ্বেও শীর্ষস্থানীয় জিডিপিতে অবদান রাখা শহর। প্রথম তিন শতভাগ শহরভিত্তিক পর্যটন। যোগাযোগব্যবস্থা ও পর্যটন স্পট বিবেচনায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম পর্যটন শহর (পার্শ্ববর্তী শহরসহ) হতে পারে। (৪) অডিও/ভিডিও/চিত্র প্রকাশ : তাজমহলসহ ভারতের অনেক ট্যুরিস্ট স্পটে দেখেছি বিভিন্ন স্থাপনায় অডিও সেট করা। সেখানে চাপ দিলেই বিভিন্ন তথ্য (হিন্দি-ইংরেজি) পাওয়া যাবে। এ রকম ব্যবস্থা নিলে আমরাও বিদেশি পর্যটককে তথ্য দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারব। প্রয়োজনে ভিডিও/এপস চালু করা যেতে পারে। প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে যাবেন পর্যটক। (৫) ছুটি : নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি- এই তিন মাসে শুক্রবার ও শনিবারের সঙ্গে রবি বা বৃহ¯পতিবার এক দিন ছুটি (দু-তিন সপ্তাহে) প্রদান/বর্ধিতকরণ করা ভালো কাজ হতে পারে। এতে চাকরিজীবীরা তিন দিনের ছুটি পাবেন এবং পর্যটনে উৎসাহিত হবেন। এতে বিপুল রাজস্ব আদায় হবে। পর্যটন-সংশ্লিষ্ট শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন হবে। গত বছর (২০২২ সালের ২৫ ডিসেম্বর রবিবার হওয়ায় পর্যটন স্পটগুলোতে প্রচুর চাপ হয় ও বিপুল রাজস্ব আয় সম্ভব হয়েছে। (৬) পুরস্কার ও প্রণদনা : পর্যটন-সংশ্লিষ্ট লেখক, সংগঠন ও ট্যুর আয়োজনকারীদের মধ্যে র‍্যাংকিং করে পুরস্কার প্রণোদনা বা স্বীকৃতি দিলে ভালো হবে। এতে করে লেখকরা সংবাদপত্রে আরো বেশি বেশি ফিচার প্রকাশ করতে আগ্রহী হবে। (৭) অভিজ্ঞতা বাস্তবায়ন : পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ড, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল পর্যটনে অনেক আয় করে। এসব দেশের বিভিন্ন উদ্যোগ/অভিজ্ঞতা আমাদের দেশে রূপান্তর করে বাস্তবায়ন করা ফলপ্রসূ হবে বলে মনে করি।

সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ইত্যাদি রাষ্ট্রের আমাদের দেশের মতো বৈচিত্র্যময় ট্যুরিস্ট স্পট নেই। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, সি-বিচ, পাহাড়, ধর্মীয় স্থাপনা ইত্যাদির ভেরিয়েশন রয়েছে আমাদের দেশে। তার পরও উল্লিখিত দেশে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে পর্যটনে শীর্ষস্থানীয় একটি খাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, যানবাহনগুলোতে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে আমরা বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করতে পারি। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে। এ ছাড়া বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তথ্য মতে, এ শিল্প থেকে ২৯ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০.৫ ভাগ। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজার ধরতে পারে তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close