এম এ মাসুম

  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য ও চ্যালেঞ্জ

স্বাধীনতার ৫০ বছরে স্বনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতি অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো, সেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। বিগত এক যুগ ধরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জিত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শুধু বিশ্বের বিস্ময় নয়, বরং উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে অভিহিত। বাংলাদেশের এই স্বীকৃতি এসেছে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির মতো আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে। মাথাপিছু আয়, খাদ্য ও পুষ্টি প্রাপ্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। নানাবিধ সমস্যা এবং দুঃসময়েও বিশ্বের বুকে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ অনেক মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি সম্পন্নও হয়েছে। যেমন- পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল ইত্যাদি।

বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের প্রথম আবাসিক প্রতিনিধি ছিলেন নরওয়ের ইয়ুস্ট ফালান্দ। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত ফালান্দ ও মার্কিন অর্থনীতিবিদ জ্যাক আর পার্কিনসন যৌথভাবে একটি বই লেখেন। যার নাম ছিল ‘বাংলাদেশ : দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’। যেখানে তারা লিখেছেন, অর্থনীতির দিক থেকে বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারবে না। তাদের অনুমানের অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়েছে বাংলাদেশ। ইয়ুস্ট ফালান্দের সম্পাদনায় আরেকটি বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে। নাম ছিল ‘এইড অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স : দ্য কেস অব বাংলাদেশ’। সেখানেও তিনি পরিষ্কারভাবে লিখেছিলেন, টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে বহু বছর বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে।

১৯৫৯-৬২ সময়ে অস্টিন রবিনসন ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। ১৯৭৩ সালে তিনি ‘ইকোনমিক প্রসপ্রেক্টস অব বাংলাদেশ’ নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। যেখানে তিনি লেখেন, বাংলাদেশে উৎপাদন যে হারে বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে জনসংখ্যা। এর ফলাফল হচ্ছে দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, মৃত্যু ইত্যাদি। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৭০ ডলার। অস্টিন রবিনসন এক হিসাবে বলেছিলেন, যদি বাংলাদেশ ২ শতাংশ হারে মাথাপিছু আয় বাড়ায়, তাহলে লাগবে ১২৫ বছর; আর ৩ শতাংশ হারে আয় বাড়লে লেগে যাবে ৯০ বছর। এটা সম্ভব যদি বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারে। বাংলাদেশ তা পারবে কিনা, তা নিয়ে তার গভীর সংশয় ছিল।

বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রথম রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। বিশ্বব্যাংক তখন বলেছিল, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল।’ সেই বিশ্বব্যাংকই ১৯৯৫ সালে ‘বাংলাদেশ ২০২০ : একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত সমীক্ষা’ শিরোনামে বাংলাদেশ নিয়ে একটি গবেষণা করে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি কোথায় যাবে, এটাই ছিল গবেষণার বিষয়বস্তু। বিশ্বব্যাংকের সেই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা ছিল, দারিদ্র্যের হার দ্রুত নামিয়ে আনা, প্রবৃদ্ধির হার ৭-৮ শতাংশে উন্নীত করা, ৫ কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণ, পরিবেশের কার্যকর সংরক্ষণ, ২০২০ সালের মধ্যে বার্ষিক ৮০০ কোটি ডলার প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আনা ইত্যাদি। এখন দেখা যাচ্ছে, প্রায় সব কটি লক্ষ্যই অর্জন করেছে বাংলাদেশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক বেশি এগিয়েও রয়েছে।

গত এক যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলছে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে বলেছে, বাংলাদেশ এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। সিইবিআরের পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, ২০২১ সাল হতে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটবে গড়ে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হারে। তবে এর পরের ১০ বছরে এই হার কিছুটা কমে গড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হবে। সিইবিআরের সূচক অনুযায়ী, ২০৩৫ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রথম ২৫টি দেশের তালিকায় যুক্ত হবে তিনটি নতুন দেশ- ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশের উত্থানকেই সবচেয়ে নাটকীয় বলতে হবে। বর্তমান র‌্যাঙ্কিং ৪১ থেকে বহু দেশকে টপকে বাংলাদেশ পৌঁছাবে ২৫ নম্বরে।

বিখ্যাত মার্কিন অনলাইন সংবাদপত্র পলিসি ওয়াচার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রশংসা করে বলেছে, অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কেস স্টাডিতে পরিণত হয়েছে। অনলাইন পত্রিকাটির ২২ জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি কি সত্যিই দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে?’ এই শিরোনামের এক নিবন্ধে বলা হয়, সামষ্টিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৫০ বছরে ২৭১ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পলিসি ওয়াচারের সম্পাদকীয় বাছাই বিভাগে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধের লেখক সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক ড. এমিলিয়া ফার্নান্দেজ দক্ষিণ এশীয় ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞ এবং নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। নিবন্ধে এমিলিয়া ফার্নান্দেজ বলেন, অনেক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কেস স্টাডিতে পরিণত হয়েছে, যা খুব কম অর্থনীতিবিদই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ২০০৬ সালে বাংলাদেশ যখন জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায়, তখন অনেকেই এটিকে আকস্মিক সৌভাগ্য বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে, বাংলাদেশ প্রতি বছর পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে এবং বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির অন্যতম। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সফল যাত্রা একটি ভালো উদাহরণ এবং মাত্র দুই দশকে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচকে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে এবং গত ২০ বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা পাকিস্তানের আড়াই গুণ।

নিবন্ধে বলা হয়, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক রক্ষণশীল থিঙ্ক ট্যাঙ্ক দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে ৫৬ দশমিক ৫ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ ১২০তম স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের সমান স্কোর নিয়ে ভারত ১২১তম অবস্থানে এবং পাকিস্তানের অবস্থান ১৫২তম। এমিলিয়া ফার্নান্দেজ বলেন, বৈশ্বিক শান্তি সূচকে বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অবস্থিত একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস’র (আইইপি) প্রকাশিত সর্বশেষ গ্লোবাল পিস ইনডেক্সে (জিপিআই) দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালে এবং সে সময় প্রতিটি অর্থনৈতিক সূচকে ভারত ও পাকিস্তান এগিয়ে ছিল। আজ ৫০ বছর পর প্রায় প্রতিটি সূচকে ভারত ও পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে। এটাই স্বাধীনতার মহান অর্জন।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধারা শক্তিশালী ও স্থিতিশীল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয় ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশে প্রচুর বিনিয়োগ হতে হবে, প্রয়োজনীয় জনবল থাকতে হবে এবং আর্থিক খাত, ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ ও অবকাঠামো শূন্যতা পূরণের মতো খাতগুলোতে উদ্ভাবনী সংস্কার করতে হবে। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত ও একটি টেকসই উন্নয়নের জন্য সুশাসনের বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, স্ব^জনপ্রীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। দেশি-বিদেশি গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের সুশাসনের বড় বাধা হচ্ছে দুর্নীতি। দেশের উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হবে, যখন এর সুবিধা দেশের প্রান্তিক থেকে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে।

লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close