সুস্মিতা চক্রবর্তী
মুক্তমত
কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ জরুরি
বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপ্রাপ্তবয়স্করা অদম্য আশা ও জীবন জগৎ সম্পর্কে কৌতূহলী থাকে। জীবন গঠনের প্রস্তুতি গ্রহণের এই সময় কিশোররা কখনো আবেগের বশবর্তী হয়ে আবার কখনো নিজেকে জাহির করার জন্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ দ্বারা অতিসহজে প্রভাবিত হয়ে অসামাজিক ও নিয়মণ্ডশৃঙ্খলার পরিপন্থী কাজ করে ফেলে। কিশোর অপরাধ গ্রাম, অনুন্নত এলাকা, শহরাঞ্চলে বস্তিগুলোর মধ্যে বেশি দেখা যায়। সঠিক সামাজিকীকরণের অভাব, পিতা-মাতার অপর্যাপ্ত তদারকি, কুসঙ্গের প্রভাব ইত্যাদি কারণে শিশুরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এটি যেমন কিশোরদের নিজেদের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি তার পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রের জন্যও হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রণীত শিশু অধিকার আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু হিসেবে বিবেচিত হবে। এদের মাধ্যমে যেসব অপরাধ ঘটে সেগুলোই কিশোর অপরাধের মধ্যে পড়ে। পরিবারের লোকদের যথেষ্ট তদারকির অভাবে কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। দরিদ্র পরিবারে বাবা ও মা উভয়েই কাজে গেলে সন্তানরা বাইরে খেলাধুলা করতে গেলেও খারাপ বন্ধুদের প্রভাবে অপরাধে যুক্ত হয়। সেই শিশুরা হয়তো জানেই না তারা অপরাধ করছে। ভালো কাজ ও খেলা মনে করেও তারা অপরাধ করে ফেলে। তারা অধিকাংশই বস্তি এলাকায় থাকে। এসব এলাকায় অপরাধের প্রভাবকগুলো অধিকহারে বিদ্যমান থাকে।
বাবা-মাও ভালো-মন্দ, নৈতিক-অনৈতিক, ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞান তাদের সন্তানদের না দেওয়া কিশোরদের অপরাধ করার অন্যতম কারণ। তারা অপরাধ করে যেসব টাকা, সামান্য সম্পদ পায় সেগুলো তাদের পরিবারের মানুষেরা অনেক সময় ভালো চোখে দেখে কিন্তু এই লোভের খেসারত সেই পরিবারগুলোকে মর্মান্তিকভাবে দিতে হয়। এসব অপরাধ করার সময় অনেক সময় মৃত্যুও হতে পারে। এমনকি ধীরে ধীরে একজন শিশু বড় অপরাধ করার দিকে ধাবিত হয়। যার ফলে আইনের আওতায় আসার পর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ফাঁসিও হতে পারে। এর মাধ্যমে বাবা-মা হারায় তাদের সন্তানকে। পরিবারটিও সমাজে নিন্দিত হয়। নিম্নবিত্ত পরিবারে যেখানে টাকা না থাকা অপরাধের কারণ সেখানে উচ্চবিত্ত পরিবারে অর্থের প্রাচুর্য অপরাধ ঘটার কারণ হয়। অল্প সময়ে আরো বেশি অর্থ উপার্জনের জন্য তারা ক্যাসিনো, মাদক সেবন, মাদকের আদান-প্রদান, জুয়াসহ অপরাধ করার জন্য যত টাকা দরকার সেটার সরবরাহও বড়লোকদের সন্তানরা করে। অর্থের সহজলভ্যের ফলে এসব কাজ করা তাদের জন্য সহজ হয়। এদের বাবা-মা টাকা বিশাল অঙ্কের টাকা হাতখরচের নামে দিয়ে দিলেও কোথায় খরচ করছে সে হিসাব নেয় না। জবাবদিহির অভাবে এরা বেপরোয়া জীবনযাপন করে এবং সঙ্গী বন্ধুদেরও নিজেদের সঙ্গে খারাপ পথে নিয়ে যায়। ধৈর্যের অভাব ও অল্প পরিশ্রমে অধিক প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা কিশোর অপরাধ হওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ। বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম ব্যর্থতা ও দেরিতে কিছু পাওয়াকে সহজে মেনে নিতে নারাজ। তারা যা চায় তা পাওয়ার জন্য অন্যায় পথে যেতেও রাজি। এমনকি অন্যের অর্জিত কিছু ছিনিয়ে নিতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না।
আজকের শিশু আগামীর বাংলাদেশ গড়বে। সেজন্য শিশুদের যোগ্য ও দক্ষ করে গড়ে তোলা অত্যন্ত প্রয়োজন। কিশোর অপরাধ একটি জাতির উন্নতির পথে একটি বিরাট বাধা। এটি থেকে দেশের কিশোরদের মুক্ত করতে সর্বপ্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে পরিবারকে। এখান থেকেই শিশুর সঠিক সামাজিকীকরণ নিশ্চিত করতে হবে। পরিবারের কিশোরদের ছোট বয়স থেকেই ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় থেকে শুরু করে অপরাধ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। সব সময় পর্যবেক্ষণ করা দরকার তাদের আচরণ, অভ্যাস ব্যবহার, কথাবার্তা ইত্যাদি। বন্ধুবান্ধব কারা সে বিষয়েও খেয়াল রাখা দরকার। ধর্মীয় শিক্ষা, ধর্মগ্রন্থ পাঠ, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো পালনে উৎসাহিত করার মাধ্যমেও পরিবার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে পারে। সন্তানরা যাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঠিক ব্যবহার করে পরিবারকে সেদিকে সজাগ থাকতে হবে। বন্ধুরাও কিশোর অপরাধ রোধে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। কোনো সহপাঠী বিপথে চলে যাচ্ছে কি না সেটার খেয়াল রাখা দরকার। কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে জানতে পারলে তার পরিবারকে প্রথমে জানিয়ে তারপর তাকে কিশোর অপরাধের কুফল সম্পর্কে অবগত করা যেতে পারে। দুঃসময়ে পাশে থাকা ও মানসিক সহায়তা দিয়েও কাউকে ভালো পথে নিয়ে আসা সম্ভব। শিক্ষকরাও ক্লাসে পড়ানোর পাশাপাশি উপদেশ, উদাহরণ দেওয়ার মাধ্যমে কিশোর অপরাধ বন্ধে কাজ করতে পারেন। কিশোর অপরাধের ভয়াল থাবা থেকে দেশকে মুক্ত করতে পরিবার, বন্ধুমহল, শিক্ষকদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। তবেই আমরা এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারব।
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
"