সামিয়া খানম

  ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

মুক্তমত

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবক হিসেবে বাংলাদেশ

ধরুন আপনি এমন একটি পরিবারে বাস করছেন যার নেতৃত্ব স্থানীয় পর্যায়ে আপনার বাবা-মা থাকলেও পরিবারের সব সদস্যের সব ধরনের চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা তাদের নেই। যার ফলে তাদের প্রভাবক হিসেবে আপনার চাচা, ফুপি পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। কিন্তু হঠাৎ যদি তাদের জীবনে এমন কোনো দুঃসহ সময় চলে যেটা তাদের অস্তিত্বের জন্যই প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তবে এর পরিণতি কি হবে কখনো ভেবে দেখেছেন? বাংলাদেশ ঠিক এই অবস্থানেই রয়েছে যেখান থেকে তাকে চিন্তা করতে হয় অন্য কোনো দেশের অস্তিত্ব, তাদের সব কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিকতা বা অস্বাভাবিকতা এ দেশের জন্য হতে পারে অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুগুলোর অন্যতম, যা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এক-তৃতীয়াংশ মানুষের জন্য চিন্তার কারণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বিষয়াবলি প্রশ্নবিদ্ধ হয় বারবার। কারণ এ বিষয়গুলো একটি দেশ পরিচালনার অন্যতম প্রধান শক্তিগুলোর অন্যতম।

১৯৯১ সাল, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভক্তি, সূচিত হলো নতুন আরো ১৫টি দেশের। ইউক্রেন এর মধ্যে অন্যতম। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে ইউক্রেন তার সব কার্যক্রম সাবলীলভাবে চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। তবে তা সফলতা ও ব্যর্থতা উভয়ের উত্থান-পতনে নিমজ্জিত হয়েছে বারবার। তবু থেমে যায়নি লড়াই। কথায় আছে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা অনেক বেশি কঠিন। ইউক্রেন যেন তার জীবন্ত প্রতিফলন। আমেরিকা এই দুটি দেশের মধ্যে এমন একটি শক্তি, যা রাশিয়াকে দমাতে এবং তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য করতে পারে সব অকল্পনীয় পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। তারই প্রতিফলন হিসেবে গঠন করে উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট বা ন্যাটো। এখানে আমেরিকা নিজেদের আরো বেশি শক্তিশালী করার স্বার্থে ন্যাটোতে নিযুক্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি করতে থাকে, যা রাশিয়ার জন্য বড় হুমকির বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ রাশিয়াকে প্রতিহত করতে আমেরিকা একটি বা দুটি নয় একে একে একত্রিশটি দেশের সমন্বয় করেছে, যা রাশিয়ার অস্তিত্বের লড়াইয়ে অনেক বড় বাধাস্বরূপ। অতঃপর একপর্যায়ে রাশিয়া যখন ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ করার দাবি জানায়, সমস্যাটি সেখানেই কঠিন হতে কঠিনতর হতে থাকে। আমেরিকার একমুখী সৈরাচারী নীতি যেন রাশিয়াকে বারবার কোণঠাসা করতে চায় কিন্তু রুশ সেনারা দমে যাওয়ার পাত্র নন। মধ্যস্থতাকারী আমেরিকা ইউক্রেনকে শক্তি ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করলেও রুশ শক্তিও তাদের দমানোর জন্য প্রস্তুত। তাই তো ইউক্রেনের শঙ্কা যেন দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ এটিকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাস বলেও মনে করেছিলেন। তবে এর ভয়াবহতা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের থেকে কোনো দিক থেকে কম নয়। এ ছাড়া এর শেষ আদৌ কবে হবে তা নিয়ে যেন উদ্বিগ্নতার শেষ নেই।

সবচেয়ে বড় যে উদ্বেগের বিষয় তা হলো রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বায়নের এই যুগে এটি সারা পৃথিবীকে প্রভাবিত করছে, বাংলাদেশ ও এর বাইরে নয়। তাদের জ্বালানি শক্তি, ভোজ্য তেল, গম, কৃষিপণ্য ইত্যাদি বাংলাদেশের বাজারকে অস্থিতিশীল করছে দিনের পর দিন। বাংলাদেশের রপ্তানি করা পোশাকশিল্পের ওপরও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। কিছু দেশের নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায় বাংলাদেশ তার সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক খাত নিয়ে পড়েছে শঙ্কায়। পৃথিবীর রুটির ঝুরি নামে খ্যাত ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশ গম আমদানি হচ্ছে ব্যাহত। যার ফলে বেকারিজ পণ্যগুলোর দাম ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায় রাশিয়া নির্দিষ্ট কিছু দেশে স্বল্পমূল্যে তেল রপ্তানি

কার্যক্রম শুরু করেছে। যার ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে

হু-হু করে।

মুদ্রাস্ফীতি তাই বাংলাদেশে যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ ২০২১ সালে এ হার ছিল ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। যার প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৃদ্ধি করা তেল ও জ্বালানি শক্তির মূল্যের ফল। শুধু কি খাদ্য, জ্বালানি শক্তি আর কৃষিপণ্যেই রয়েছে এ যুদ্ধের প্রভাব? তবে এর বিস্তার কতখানি? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরো হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আলোচিত বিষয়াবলি। উত্তর শুধুই নেতিবাচক রূপে আঘাত হেনেছে বারবার। করেছে বাংলাদেশের সব বিষয়ের ভিত্তিস্তর অর্থনৈতিক কাঠামোকে দুর্বল। বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগণ তাই এবার নিজে দেশ নয় বরং বহিঃস্থ লড়াইয়ের প্রভাবক হিসেবে নিজেদের ভাগ্যাকাশকে করছে দোষারোপ। তবে এর শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই? বাংলাদেশ তথা পুরো বিশ্ব এখন অপেক্ষার প্রহর গুনছে, কবে উঠবে নতুন একটি সূর্য, যা শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন নয়, বরং এর প্রভাবক

হিসেবে পুরো পৃথিবীকে করবে মুক্ত। আমরা সেই নতুন দিন নতুন আর একটি নতুন সূর্যের অপেক্ষায়।

লেখক : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close