এস এম আতিয়ার রহমান

  ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

আলোচনা

গ্রামেও পাওয়া যাচ্ছে শহরের সুবিধা

গ্রামের পথে পথে কাদা, অনেক স্থানে হাঁটু-সমান। সেই কর্দমাক্ত পথ পার হয়ে যেতে হবে গন্তব্যে। স্কুলে, হাট-বাজারে, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে, নিজের ঘরে। কাঁচা মাটির রাস্তায় বৃষ্টি পড়লেই অবস্থা খারাপ। শুধু কাঁচা রাস্তাতেই নয়, নিজ বাড়ির আঙিনায়ও কাদাপানি। ঘরে উঠতে হলে ঠিলে বা কলসিতে জমা বৃষ্টির পানিতে পা ধুয়ে তারপর ঘরের বারান্দায় ওঠা। একবার উঠলে আর প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাওয়া নয়। কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি, থামেই না। বাইরে মেঘ আর বৃষ্টিতে আচ্ছন্ন প্রকৃতি। সন্ধ্যা না হতেই ব্যাঙ, ঝিঁঝি পোকামাকড়ের ডাক। ঘরে কেরোসিনের তেলের সলতে ল্যাম্প বা হারিকেনের আলোয় উড়ে আসে পোকা। উঠানবাড়ি আর কাছের ঝোপঝাড়ে জোনাকির আলো।

বিকেলে বা সন্ধ্যায় কিছু গ্রাম্য পদের নাশতা। চাল ভাজা, গমের রুটিতে তেল দিয়ে ভেজে কড়কড়ে শক্ত করে মচমচিয়ে খাওয়া। বেশি হলে গুড়ের তৈরি পাকান পিঠা, কুলি বা পাটিসাপটা। ঘরের বারান্দায় থাকা কৃষিশ্রমিকদের অনেকেই বলতে পারতেন সেই গল্প। সেই গল্প শুনতেন বাড়ির সবাই, এমনকি পাশের এঘর-ওঘরের মানুষও। এ চিত্র শ্রাবণের শেষ থেকে ভাদ্র মাসের। সে বেশি দিনের কথা নয়। আমাদের মহান স্বাধীনতার পরও দেড়-দুই দশক এ দৃশ্য ছিল গ্রামগঞ্জে।

সে সময়ের আরো একটি দৃশ্যের কথা না বললেই নয়। ভোরে আজান দেওয়ার পরই মা-চাচিরা উঠে রান্না শুরু করতেন। জমিতে আমন ধানের বীজপাতা লাগাতে যাবেন গৃহকর্তা ও কৃষাণ। তাদের জন্য সকালে একবারেই নাশতা বা খাবার দিতে হবে। দূরের পথ, বিলের মধ্যে নদী-নালা। তাই হাল চাষের জন্য গরু, জোয়াল, মই, লাঙল নিয়ে রাত না পোহাতেই যাত্রা। খুব ভোরে সেই কর্দমাক্ত রাস্তায় হালের গরু সঙ্গে নিয়ে যেতে শুধু একটি শব্দ ভেসে আসত ‘হৈ, চল চল, যা যা।’ কাদায় আটকে যাচ্ছে গরু, আর সঙ্গে থাকা মানুষের পদযুগল। মাঝে মাঝে গরু তাড়াতে লাঠির বাড়ির শব্দ। ছাতা নেই, মাথায় বড়জোর হোগলার জোংড়া, মাথালি বা গামছা। বৃষ্টি ও কাদার কারণে কৃষক গৃহকর্তা ও কৃষিশ্রমিকের পায়ের ও হাতের আঙুলের মধ্যভাগের চামড়া খেয়ে যেত। হাত-পায়ের নখগুলো মসৃণ থাকত না। সন্ধ্যায় দেখা যেত শুকনো মরিচের মুখ খুলে তার মধ্যে সরষের তেল দিয়ে তা আগুনে সেঁকে সেই গরম তেল পায়ের বা হাতের আঙুলের ফাঁকে দিচ্ছেন কৃষক। মাঝেমধ্যে সহ্য করতে না পেরে উহ! হাঁ! করে উঠছেন। কেউ বা তুঁতের পানি দিচ্ছেন। কাল আবার যেতে হবে জমিতে। এই কারণে এসব ব্যবস্থা। তখনকার দিনে ওষুধ পাওয়া যেত না। তাই এই টোটকা চিকিৎসা। এভাবেই চলত সে সময়। এখনকার প্রজন্ম সে চিত্রের কথা ভাবতেও পারবে না। দেশের খুব কম স্থানেই এখন এ দৃশ্য দেখা যায়। কারণ, এখন গ্রামের রাস্তা-ঘাটে ইটের সলিং, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পিচঢালা পাকা। আমন চাষ কমে গেছে। তাও যা চাষ হয়, তার প্রায় ৭০-৮০ ভাগ যান্ত্রিক লাঙল দিয়ে।

ভাদ্র মাসের মধ্যে আমন ধানের বীজপাতা না লাগালে ফলন ভালো হয় না। কমবেশি সে সময় সবার লক্ষ্য থাকত এ মাসেই ধানের চারা লাগানো। এখন অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। তবে আমন মৌসুম ঠিক রয়েছে। কৃষক এখন অনেক সচেতন। সময়মতো আমন ধানের চারা লাগাতে চান। এখন বৃহত্তর খুলনা ছাড়া প্রায় সবস্থানে উচ্চফলনশীল ধানের আবাদ করা হয়। মোট আমন আবাদি জমির ৮০-৮৫ ভাগ উচ্চফলনশীল জাতের ধানই লাগান কৃষক। বাকি ১৫-২০ ভাগ জমিতে স্থানীয় জাতের আমন চাষ হয়। ফলে, ১৫ ভাদ্রের আগেই উচ্চফলনশীল বা আধুনিক জাতের ধানের চারা রোপণ শেষ হয়। আশির দশকেও দেখা যেত উত্তরাঞ্চলে ভাদ্রের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে যখন আমন ধানের চারা লাগানো শেষ, তখন দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটে স্থানীয় জাতের ধানের চারা রোপণ হচ্ছে আশ্বিনের প্রথম পক্ষ পর্যন্ত। চিংড়ির ঘের। তাই ভাদ্র মাসে মাছ ধরে তারপর ঘের থেকে পানি নামিয়ে লাগানো হতো আমন ধানের চারা। এখন সে দৃশ্য খুব কম স্থানেই দেখা যায়। এত গেল আমন ধান চাষের কথা।

ভাদ্র মাসকে সে সময় অভাবের শুরুর মাস বলা হতো। উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা শুরু হতো এ মাস থেকে। শুধু উত্তরাঞ্চল নয়। চিংড়ি চাষ শুরুর আগে তা দক্ষিণাঞ্চলেও দেখা যেত। শতকরা ৮০-৯০ ভাগ কৃষকের ঘরের ধান ফুরিয়ে যেত। আমন ধান লাগাতে গিয়ে কৃষিশ্রমিকের খরচসহ পরিবারের অন্যান্য খরচ মেটাতে আয়ের প্রধান উৎস আমন ধান বিক্রি করে দায় সারতে হতো। তাই ভাদ্র মাসে এসে আর্থিক টান পড়ত। আমাদের সাহিত্যেও এই ভাদ্র মাসের অভাবের চিত্র ফুটে উঠেছে। মাঠে তখন ফসল থাকত না। কিছু এলাকায় আউশ হতো, পাট হতো। আমন উঠত কার্তিক-পৌষ মাসে। বীজতলার উঁচু জমিতে সাধারণত বালাম বা আগাম জাতের ধান লাগানো হতো। এটা কার্তিক মাসের মাঝামাঝি ফ্লাওয়ারিং হতো। কার্তিক মাসের শেষ দিকে মাঠের কোনো কোনো স্থানে সোনালি বর্ণ পেত। কৃষক তাকিয়ে থাকতেন আর ধারণা করতেন- এই তো আর ১০-১৫ দিন গেলেই ধান কাটা যাবে, অভাব মোচন হবে।

ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক অভাবের এই তিন মাস গ্রামে মহাজনদের বা ধান ব্যবসায়ীরা টাকা খাটাত। টাকা দিয়ে আগাম চুক্তিতে কম দামে ধান কিনত। বাজারে এক শ বা দেড় শ টাকা এক মণের দাম থাকলে তারা কিনতেন দশ-পনেরো টাকা কম দিয়ে। তাই দেখা যেত কৃষক মৌসুমে যখন ধান বিক্রি করতেন, তখন বাজার দরের চেয়ে মহাজনের কাছে দিতে হতো কম দামে। কারণ ব্যাংক ছিল না, থাকলেও খুব কম। নগদ অর্থের অভাব। এ কারণে দাদন ব্যবসা ছিল জমজমাট। এখনো অনেক স্থানে কমবেশি তা আছে। ইংরেজি বছরের শুরুতে এই ধান বিক্রি করে মিটত নানা চাহিদা। ছেলেমেয়ের স্কুলের বেতন, নতুন বই-খাতা, জামাকাপড়, স্যান্ডেল। পরিবারের অন্যদের লুঙ্গি ও গামছা শাড়ি। বিয়ে, উৎসব সাধারণত ধান বিক্রি করেই করা হতো। এ ছাড়া পরিবারের অনান্য খরচ মিটত ধান বিক্রি করে। আমন ধানই ছিল গ্রামের কৃষক পরিবারের মূল আয়ের উৎস। এখন সে চিত্র পাল্টে গেছে। বোরো ধানের মৌসুম আসায় ঘরে ঘরে শুকনো মৌসুমে উচ্চফলনশীল ধান চাষ হয়।

গ্রামে এখন যাতায়াত ব্যবস্থা থেকে শুরু করে জীবনযাপনে এসেছে নানা পরিবর্তন। শহরের অনেক কিছুর সমান সুযোগ রয়েছে এখন গ্রামে। মা-চাচিদের সেই কাঠ দিয়ে রান্নার কষ্ট কমেছে। রাইসকুকারে চাল তুলে দিলেই ভাত হয়ে যাচ্ছে। গ্যাসের চুলায় রান্নায় নেই চোখ ঝাঁজানো ধোঁয়া। সেই সঙ্গে জলবায়ুরও পরিবর্তন হয়েছে। আগের মতো লাগাতার ৪-৫ দিন বৃষ্টি নেই। এখন ভাদ্দুরে তালপাকা গরমই বেশি। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রির ওপরে উঠেছে। তাই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত থাকাই শ্রেয়। তার পরও অনেকে এই ভাদ্দুরের দিনে এখনো সেই চিত্র এখন স্মরণ করেন। অনুভব করেন শুধু বয়োজ্যেষ্ঠরা। যাদের বয়স পঞ্চাষোর্ধ্ব তারাই, যারা সেই চিত্র দেখেছেন, ভুক্তভোগী। সেই ইতিহাস নতুন প্রজন্ম যেমন জানতে পারে না, আবার তাদের আগ্রহও নেই। ফলে, ইতিহাসের এসব উপাদান জানা থেকে বাদ পড়েছে তারা। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এখন জীবনাচার পাল্টে গেছে।

লেখক : পরিচালক (পিআরএল), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close