মো. সাখাওয়াত হোসেন
বিশ্লেষণ
প্রধানমন্ত্রীর চার প্রস্তাব ও জি-২০ সম্মেলন
বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে জি-২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে বিশ্বনেতাদের সামনে ৪টি প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশগ্রহণের অব্যবহিত পরে তার প্রদত্ত ভাষণ ও বক্তব্য নিয়ে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয়। তিনি পর্যায়ক্রমে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হওয়ায় বিশ্বনেতারাও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন করে থাকেন এবং বাস্তবায়নের তাগিদ অনুভব করেন। সদ্য সমাপ্ত জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর প্রদত্ত বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ইতিমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। কেননা প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী ও বিচক্ষণ বক্তব্যের ফলে এর কার্যকারিতা নিয়ে আলোচকরা উন্মুখ হয়ে থাকেন। প্রকৃত অর্থে বিশ্ব শান্তি ও সম্প্রীতির লক্ষ্য বাস্তবায়নের বহুবিধ কারিশমা রয়েছে, আর প্রকৃত অর্থেই যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে যুদ্ধময় পৃথিবীর যাতনা ঘুচে পুরো পৃথিবীতে শান্তির আলোকবর্তিকা বহমান থাকবে।
জি-২০ সম্মেলনের ‘ওয়ান আর্থ’ অধিবেশনে প্রথম প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাপী সংকট মোকাবিলায় জি-২০ এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশ সংকট মোকাবিলায় কার্যকর সুপারিশ তৈরি করতে তাদের প্রচেষ্টাকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। তিনি দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলেন, মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে এবং বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সাহসী, দৃঢ় এবং সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং তাতে প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তৃতীয়ত, জলবায়ুজনিত অভিবাসন মোকাবিলায় অতিরিক্ত অর্থায়নের ব্যবস্থা করার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষতি এবং ক্ষয়ক্ষতি তহবিল চালু করা। আসন্ন কপ-২৮ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে ক্ষতি ও ক্ষতির জন্য তহবিল বাস্তবায়নে কাজ করা জরুরি। সবশেষ তিনি যোগ করেন, সব মানুষেরই উপযুক্ত জীবনযাপনের সমান অধিকার থাকা উচিত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা ও মানবিক সহায়তার ব্যাপারে আলোকপাত করেন।
বিশ্বব্যাপী চলমান যেকোনো সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে জি-২০ গৃহীত যেকোনো ধরনের উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশ থাকবে বলে প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনস্থলে সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন। এ একটি ইঙ্গিতকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে এ বক্তব্যে প্রমাণিত হয় পৃথিবীতে সংকট রয়েছে এবং সংকট মোকাবিলায় উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে নতুবা সংকট ক্রমান্বয়ে ঘনীভূত হবে এবং সব পৃথিবীতে একটি শ্বাপৎসংকুল পরিস্থিতি তৈরি হবে। শুধু তা-ই নয়, সংকট মোকাবিলার ক্রীড়নক হিসেবে বাংলাদেশের ভূমিকা রাখারও সক্ষমতা তৈরি হয়েছে।
বিশ্বে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশসমূহকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে এগিয়ে আসতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে অল্প শ্রমমূল্যে কাজে লাগিয়ে বৈষম্যের ব্যবধান বৃদ্ধি করে। এ অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে, পারস্পরিক সহযোগিতার দর্শনকে কাজে লাগিয়ে একে অন্যের সহযোগী হিসেবে কাজ করার প্রয়াস নিতে হবে। মোটের ওপর যে বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে তা হচ্ছে বিশ্বকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও সংকটমুক্ত করার তাগিদে তড়িৎ গতিতে বাস্তবতার মিশেলে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। না হলে যুদ্ধময় পরিস্থিতির আবির্ভাব ঘটবে এবং পুরো পৃথিবীর মানুষকে এর জন্য খেসারত দিতে হবে, যেমন খেসারত দিতে হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে।
এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উত্তপ্ত পৃথিবীর ভয়াবহতায় পৃথিবীর একটা অংশের মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সে জায়গাতে যে দেশগুলো বেশি পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ করে থাকে, তাদের কাছ থেকে ক্ষয়ক্ষতির ভিত্তিতে তহবিল সংগ্রহ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ন্যায্যতার ভিত্তিতে যে শ্রেণিটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করার নিমিত্তে উদ্যোগ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সম্মিলিত উপায়ে কাজ করতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে আমরা এমন একটি পর্যায়ে অবস্থান নিয়েছি, যে জায়গাতে দেখা যায় বিশ্বের এক অংশে জলবায়ু-সংক্রান্ত কোনো ধরনের সমস্যার উদগিরণ হলে অন্য অংশে বসবাস করা শ্রেণিটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু এ ক্ষতিগ্রস্ততার দায় কিন্তু কেউই গ্রহণ করছে না, ফলে পৃথিবী ক্রমান্বয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কাজেই পুরো পৃথিবীর স্থিতাবস্থা রক্ষার্থে পরিকল্পনা ছাড়া কাজ করার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকট ক্রমান্বয়ে ঘনীভূত হচ্ছে এবং রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধ কার্যক্রমও চোখে পড়ার মতো। নিজেরাই নিজেদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে হত্যায় লিপ্ত হচ্ছে। রোহিঙ্গা শিবিরকে অনেকেই সন্ত্রাসী কার্যক্রমের উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করছে। এসব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে রোহিঙ্গা নিয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্ববাসীর বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে কমে আসে। সংগত কারণেই এ-সংক্রান্তে বাংলাদেশের ওপর একটি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। আবার মাঝেমধ্যে প্রত্যাবাসনের আলোচনা শুরু হলেও সেটির বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়নি। এ বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত বাস্তবায়ন হওয়া সম্ভব নয়। সে কারণেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের ইতিবাচক অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। দিন দিন রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছে এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে বিষয়টি খোলাসা করার উদ্দেশ্যে জি-২০ সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে শেখ হাসিনা জোরালো বক্তব্য প্রদান করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা আমাদের পৃথিবীকে বাঁচাতে ও শক্তিশালীকরণে জি-২০ অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। আমাদের একে অন্যের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে এবং আমাদের মাতৃ-পৃথিবীর যত্ন নেওয়ার জন্য নিজেদের ফের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এ বিষয়টি কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা পৃথিবীর স্বার্থ রক্ষার্থে এর আগে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই আশ্বাস দিয়েছে কিন্তু বাস্তবে সেসবের প্রতিফলন ঘটেনি। এ বিষয়টি মনে করিয়ে দিতেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জি-২০-এর প্ল্যাটফরমকে বেছে নিয়েছেন। পৃথিবীতে যে চলমান অস্থিরতা বিরাজমান তা থেকে উত্তরণের জন্য সম্মিলিত উদ্যোগের বিকল্প নেই এবং সম্মিলিত উদ্যোগগুলো কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবে রূপদান করা উচিত। তা না হলে আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ থাকবে প্রতিশ্রুতিগুলো।
মোদ্দা কথা, শেখ হাসিনার প্রস্তাবগুলো বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করার সুযোগ থাকায় মূলত প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে চলমান পৃথিবীর সংকট মোকাবিলায় একযোগে কাজ করতে হবে, যুদ্ধময় পৃথিবীর পরিস্থিতি থেকে কল্যাণকর পৃথিবীর দিকে দায়িত্বশীলদের অধিক মনোযোগের ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদান করা উচিত, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে আলাদা করে তহবিল গঠনের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করা উচিত। বাংলাদেশ মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল এবং এখনো পর্যন্ত সেসবের ভার বহন করে যাচ্ছে। তথাপি দেশের মানুষের কাছে রাষ্ট্রের কাছে রোহিঙ্গা ইস্যুটি একটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যত দ্রুত রোহিঙ্গাদের সমস্যাটিকে সমাধানের নিমিত্তে কাজ করা হবে, ততই এ দেশের মানুষের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
শুধু তা-ই নয়, ইতিবাচক পৃথিবীর জয়গানের আহ্বানের হেতু প্রধানমন্ত্রী জি-২০ সম্মেলনে উল্লিখিত বিষয়গুলো উত্থাপন করেছেন। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে যদি কল্যাণকর পৃথিবী প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা সম্ভব হয় তাহলে সব মানুষের মানবাধিকার যেমনভাবে নিশ্চিত করা যাবে, ঠিক তেমনিভাবে যুদ্ধময় পরিস্থিতিরও বিনাশ ঘটবে। পৃথিবী এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে প্রত্যেককে প্রত্যেকের ওপর ভরসা করতে হয়, নির্ভর করতে হয়। এক ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পুরো পৃথিবীকে বুঝিয়ে দিয়েছে শান্তিময় পরিস্থিতি কতটা অবশ্যম্ভাবী। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই শেখ হাসিনার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের তাগিদ অনুভব করবে বিশ্ব সম্প্রদায়- এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা ও বিশ্বাস।
লেখক : চেয়ারম্যান
ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
"