প্রকাশ ঘোষ বিধান
মতামত
পৃথিবীর প্রতিরক্ষার ঢাল ওজোন স্তর

ওজোন স্তর বায়ুমণ্ডলের দ্বিতীয় স্তরে অর্থাৎ স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরের মধ্যে ২০-৩৫ কিমি উচ্চতায় ওজোন গ্যাসের একটি ঘনস্তর বলয়রূপে পৃথিবীকে ঘিরে রয়েছে। এই স্তরটিকে ওজোন স্তর বা ওজোনোস্ফিয়ার বলা হয়। বায়ুমণ্ডলে তাপ উৎপাদক বিক্রিয়ায় অক্সিজেন পরমাণুর সঙ্গে অবিয়োজিত অক্সিজেন অণুর রাসায়নিক সংযুক্তির ফলে সৃষ্টি হয় ওজোন অণু এবং তা থেকে গঠিত হয় ওজোন গ্যাসের স্তর। অক্সিজেন অণুর এক বিশেষ রংহীন রূপ এই ওজোন। মূলত এটি পৃথিবীকে সূর্যের অতিবেগুনিরশ্মি থেকে সুরক্ষা দেয়।
ফরাসি পদার্থবিদ চার্লস ফ্যাব্রি এবং হেনরি বুইসন ১৯১৩ সালে ওজোন স্তর আবিষ্কার করেন। পরে ব্রিটিশ আবাহাওয়াবিদ জি এম বি ডবসন ওজোন স্তর নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে তিনি ওজোন পর্যবেক্ষণ স্টেশনসমূহের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। ওজোন স্তর ক্ষয় ও তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালের ১৯ ডিসেম্বরে এক সভায় প্রতি বছর ১৬ সেপ্টেম্বর ‘আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর রক্ষা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৫ সাল থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা যায়, বায়ুমণ্ডলে ক্রমাগত ক্লোরোফ্লোরো কার্বন বা সিএফসি গ্যাস বৃদ্ধির ফলে ওজোন স্তর ক্ষয় হচ্ছে। আর মানুষের কর্মকাণ্ডে ক্রমাগত এই গ্যাস বেড়ে চলেছে। তা ছাড়া বায়ুমণ্ডলে পুঞ্জীভূত গ্রিনহাউস গ্যাস উৎসারণের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে নানা প্রাকৃতিক দুরারোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
ওজোন গ্যাসের একটি পর্দা আছে, যার ফলে সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত অতিবেগুনিরশ্মি ভূপৃষ্ঠে আসতে পারে না। বায়ুমণ্ডলের এই ওজোন স্তর সূর্যের অতিবেগুনিরশ্মির প্রভাব থেকে পৃথিবীর জীবজগৎকে ছাতার মতো রক্ষা করে। তাই ওজোন স্তরকে প্রাকৃতিক সৌরপর্দা বা ন্যাচারাল সানস্ক্রিন বলে। ওজোন গ্যাস সূর্যের তাপ ও অতিবেগুনিরশ্মি শোষণ করে, ফলে এই স্তরের তাপমাত্রা খুব বেশি হয়। সূর্যের অতিবেগুনিরশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দুরারোগ্য ত্বকের ক্যানসার, ব্লাড ক্যানসার প্রভৃতি প্রাণঘাতী রোগব্যাধি ও চোখে ছানি পড়া, প্রজনন ক্ষমতার হ্রাস প্রভৃতি সমস্যা থেকে জীবকুলকে রক্ষা করে। ওজোন স্তর সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনিরশ্মিকে শোষণ করে পৃথিবীকে জীবকুলের বসবাসের উপযোগী করে তোলে ও জীবজগৎকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে।
ওজোন স্তরের সৃষ্টি ও বিনাশ একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু হিমঘর, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার প্রভৃতিতে ব্যবহৃত ক্লোরোফ্লুরো কার্বন বা সিএফসি অগ্নিনির্বাপক হিসেবে ব্যবহৃত ব্রোমিনসমৃদ্ধ হ্যালন গ্যাস, মিথাইল ক্লোরোফর্ম, সালফেট যৌগ প্রভৃতির সংস্পর্শে ওজোন অণু চিরস্থায়ীভাবে ভেঙে অক্সিজেন অণু ও পরমাণুর সৃষ্টি করে। এর ফলে ওজোন স্তরের বিনাশ ঘটে। ওজোন বিনাশনের কারণগুলো মূলত দুই প্রকার। যথা- প্রাকৃতিক কারণ ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণ। ওজোন স্তর বিনাশনের জন্য দায়ী প্রাকৃতিক কারণগুলো হলো, বজ্রপাত, অগ্ন্যুদগম, আলোক-রাসায়নিক বিক্রিয়া, অতিবেগুনিরশ্মির প্রভাব প্রভৃতি। এই কারণগুলো মূলত নিম্নলিখিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ওজোন গ্যাসের অণুকে ভেঙে দিয়ে ওজোন স্তর বিনাশন ঘটায়। তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, প্রাকৃতিক কারণে ওজোন স্তর যেমন ধ্বংস হয়, তেমনই প্রাকৃতিক কারণে এটি গড়েও ওঠে। তাই ওজোন স্তর বিনাশনের পেছনে প্রাকৃতিক কারণগুলো তেমন মারাত্মক প্রভাব ফেলে না।
ওজোন স্তরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মূলত মানুষ সৃষ্টি রাসায়নিক ক্লোরোফ্লোরো-কার্বনের কারণে, যার সংক্ষিপ্ত নাম সিএফসি। ক্লোরোফ্লোরোকার্বন বা ফ্রেয়ন একটি বিশেষ যৌগ, যা ওজোন স্তর বিনাশনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী। এটি আবার তিন ধরনের। ১৯৯৫ সালের পর থেকে বিশেষজ্ঞরা এটি থেকে নির্গত ক্লোরিনকে ওজোন স্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী করেন। একটি ক্লোরিন পরমাণু প্রায় এক লাখ ওজোন অণুকে ভেঙে দেওয়ার পরও অপরিবর্তিত থাকে। রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, ফোমশিল্প, রংশিল্প, প্লাস্টিকশিল্প, সুগন্ধিশিল্প, কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রের সার্কিট পরিষ্কার প্রভৃতি ক্ষেত্র থেকে সিএফসি নির্গত হয়। এ ছাড়া কলকারখানা-যানবাহনের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, ট্যানারি কারখানার বর্জ্যপদার্থ, যা পরে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে ক্লোরিন গ্যাস তৈরিতে ভূমিকা রাখে। নাইট্রাস অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ব্রোমিন পরমাণু, সালফারের কণা ছাড়াও মিথেন, মিথাইল ব্রোমাইড, মিথাইল ক্লোরাইড প্রভৃতিও ওজোন ধ্বংস করছে, সেই সঙ্গে অন্যান্য মনুষ্যসৃষ্ট কারণ।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ওজোন স্তর ক্ষয়ের কারণে অতি বেগুনিরশ্মি পৃথিবী পৃষ্ঠে চলে এলে যে ক্ষতিগুলো হতে পারে এগুলোর মধ্যে অন্যতম- প্রাণিদেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। চোখে ছানি পড়বে। ত্বকের ক্যানসার এবং অন্য রোগব্যাধির সূচনা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, ৫ শতাংশ ওজোন স্তরের ক্ষয়ের জন্য বিশ্বে ৫ লাখ লোক স্কিন ক্যানসারে ভুগবে। একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১ শতাংশ অতি বেগুনিরশ্মি বৃদ্ধির ফলে সাদা চামড়ার লোকদের মধ্যে নন-মেলোনোমা ত্বকের ক্যানসার বৃদ্ধি পাবে চার গুণ। অতি বেগুনিরশ্মি খাদ্যশস্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। প্রাণিজগতের অনেক প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে। বৃক্ষাদি এবং অরণ্যসমূহ নির্মূল হয়ে যাবে। উদ্ভিদের পাতাগুলো আকারে ছোট হয়ে যাবে। বীজের উৎকর্ষ নষ্ট হবে। ফসলের আগাছা, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যাবে। অতি বেগুনিরশ্মির প্রভাব জীবকোষের ওপর খুবই ক্ষতিকারক। এটা জীবকোষের সৃষ্টি এবং বৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে কোষগুলোকে ভেঙে ফেলতে পারে। ক্ষুদ্র মাইক্রো অর্গানিজম, সমুদ্র শৈবাল এবং প্লাংকটন অতি বেগুনিরশ্মির প্রভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে প্রাকৃতিক খাদ্যচক্রকে প্রভাবিত করে ক্ষতি সাধন করবে।
বর্তমানে পরিবেশমিত্র গ্যাসের ব্যবহার, ওজোন ক্ষয়কারী পদার্থের পুনর্ব্যবহার ও উৎপাদনে নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি ব্যবস্থা গ্রহণের সাহায্যে ওজোন স্তর ক্ষয়রোধের চেষ্টা চলছে। ক্লোরোফ্লোরো কার্বন বা ফ্রেয়ন একটি বিশেষ যৌগ, যা ওজোন স্তর বিনাশের জন্য বিশেষভাবে দায়ী। এই সিএফসি প্রধানত রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, ফোমশিল্প, রংশিল্প, প্লাস্টিকশিল্প, সুগন্ধিশিল্প, কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রের সার্কিট পরিষ্কার প্রভৃতি ক্ষেত্র থেকে নির্গত হয়। সিএফসি নির্গমনের এসব উৎসগুলোকে ক্ষেত্রবিশেষে বন্ধ অথবা সর্বোচ্চমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
নাইট্রাস অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফারের কণা নিয়ন্ত্রণ : কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, যানবাহন, নাইলনশিল্প প্রভৃতি কলকারখানা-যানবাহনের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, ট্যানারি কারখানার বর্জ্য পদার্থ, জেট বিমান, রকেট উৎক্ষেপণ, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র প্রভৃতি থেকে নাইট্রাস অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফারের কণা নির্গত হয়, যেগুলো ভীষণভাবে এক-একটি গুরুত্বপূর্ণ ওজোন বিনাশক। এদের উৎসগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশে এদের পরিমাণ কমাতে হবে।
মন্ট্রিল চুক্তির ওজোন স্তর সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৮৭ সালে কানাডার মন্ট্রিলে স্বাক্ষরিত মন্দ্রিল চুক্তি যাতে বাস্তবে সবাই মেনে চলে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ১৯৯২ সালের জুন মাসে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত বসুন্ধরা সম্মেলনে গৃহীত এজেন্ডা ২১-এর অন্তর্ভুক্ত সব পালনীয় বিষয়গুলোকে সবাইকেই মেনে চলতে হবে।
ওজোন বিনাশক উপাদানগুলোর বিকল্প ও পরিবেশবান্ধব দ্রব্যগুলো ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। পরিবেশ রক্ষা নাগরিকদের মৌলিক দায়িত্ব। সর্বোপরি শিল্পায়ন বিশ্বকে করেছে অনেক উন্নত ও আধুনিক। তাই শিল্পায়নের অগ্রগতি বজায় রেখেই বিশ্ববাসীকে দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়তে সবাইকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। তাই সিএফসিসহ অন্যান্য ওজোন বিনাশক উপাদানগুলো যাতে পরিবেশে কম পরিমাণে উৎপাদিত হয়, সে বিষয়ে সবাইকেই দায়িত্বশীল হতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
"