রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৬ জুন, ২০২৩

বিশ্লেষণ

দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্কে মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশ

উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের মানচিত্রে নিজের জায়গা করে নিতে কঠোর পরিশ্রম করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অন্যদের মতো বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অত্যাবশ্যকীয় জ্বালানির অভাবে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার জন্য বৈদেশিক অর্ডার হারাতে পারে এমন ধারণাও করা হয়েছিল। এমনকি অন্য শিল্পেও উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে- এমন ধারণাও ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল ও নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর তাই মধ্যপ্রাচ্যসহ সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। তাই উন্নয়ন ও শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে বর্তমান জ্বালানি সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরো জোরালো ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

ভ্রাতৃপ্রতিম সৌদি আরব ও বাংলাদেশের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব থাকলেও উভয় রাষ্ট্রের অধিবাসীরা মুসলমান হওয়ায় তাদের মধ্যে এক ধরনের আত্মিক যোগাযোগ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের নানা সংকটকালে সৌদি আরবের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। দুর্যোগকালে তারা শর্তহীন সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। ১৯৭৪ সালে জেদ্দা সফরকালে বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের বন্যাদুর্গতদের সহায়তার জন্য সৌদি সরকারকে অনুরোধ করলে তারা এক কোটি ডলার সাহায্য ঘোষণা করে ভ্রাতৃপ্রতিম এ দেশের জনগণের জন্য তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছে। বাংলাদেশ-সৌদি আরব তথা বাংলা ও আরব অঞ্চলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের বিচার করলে অপূর্ণ ইতিহাসই শুধু নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হবে। পাশাপাশি ওই সম্পর্ক যে সুপ্রাচীনকাল থেকেই বহমান সে বিষয়টিও অস্বীকার করা হবে। প্রকৃতপক্ষে, প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশের সঙ্গে আরব অঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ভৌগোলিকভাবে উভয় অঞ্চলের মধ্যে পাঁচ হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব হলেও ইসলামণ্ডপূর্ব যুগেও উভয় অঞ্চলের মধ্যে স্থল ও জলপথে যোগাযোগ ছিল।

তখন বাংলাদেশ ও সৌদি আরব নামে স্বতন্ত্র কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব না থাকলেও উভয় অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইসলামণ্ডপূর্ব যুগে আরব বণিকদের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, আরব বণিকরা পশ্চিম এশিয়া, ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং চীন পর্যন্ত তাদের ব্যবসায়িক পণ্য বিনিময় করত। ওই সময় বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে আরব বণিকরা বাণিজ্যিক রুট হিসেবে বঙ্গোপসাগরকে ব্যবহার করত। তারা চট্টগ্রাম বন্দরে যাত্রাবিরতি করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাড়ি জমাত। ওই সময়ের প্রামাণ্য কোনো ইতিহাস গ্রন্থে এ বিষয়ের উল্লেখ না থাকলেও পরবর্তীকালে অর্থাৎ অষ্টম থেকে দশম শতকের আরব মুসলিম ভূগোলবিদদের গ্রন্থে ভারত মহাসাগর তথা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় এবং বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলের সমুদ্রবন্দর, বাণিজ্য এলাকা ও পণ্যসামগ্রী সম্পর্কে অতি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকায়ই প্রমাণ করে যে তারা বাংলা সম্পর্কে জানত।

মধ্যযুগে মুসলিম বাংলার সঙ্গে ওই সম্পর্ক আরো নিবিড় হয়। আরব অঞ্চল থেকে বহু সুফি-সাধক আগমন করেন বাংলায়। যারা ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারে নিজেদের উৎসর্গ করেন। প্রাচীনকালে বাংলার সঙ্গে আরব অঞ্চলের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম বাংলায় তা আরো ঘনিষ্ঠ হয়। এ অঞ্চলের মানুষেরা ধর্মীয় তীর্থস্থান মক্কা ও মদিনায় হজ উপলক্ষে গমন করায় বাণিজ্যের পাশাপাশি আর একটি নতুন সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এ ছাড়া তৎকালীন সময়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিশালী বাংলার শাসকরা আরব অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় বাংলা ও আরবের মধ্যে বাণিজ্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

ঔপনিবেশিক শাসনামলেও বাংলার সঙ্গে আরব অঞ্চলের সুসম্পর্ক ছিল। ওই সময়ও বাংলা থেকে মুসলমানরা হজে গমন করতেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ওই সময় আরবের প্রভাব না থাকলেও হাজি শরীয়তুল্লাহর মতো অনেক সমাজ সংস্কারকই আরব অঞ্চলের ধর্মগুরুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলায় সমাজ সংস্কারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। আর ওই সংস্কার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করলে তা এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলে সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের পাকিস্তানের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করা যায়। সৌদি আরবই প্রথম রাষ্ট্র যে পাকিস্তানকে স্বীকৃতি প্রদান এবং কূটনৈতিক যোগাযোগ স্থাপন করে। তাই পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার সঙ্গেও সৌদি আরবের সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সৌদি সরকারের সমর্থন পাকিস্তানের প্রতি থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয় এবং এ দেশের মানুষের নানা সংকটে বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়িয়ে সৌদি আরব স্বাধীন বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে হজকে কেন্দ্র করে প্রথম বাংলাদেশ সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়।

ওই যোগাযোগে বাংলাদেশের আহ্বানে সৌদি আরব সাড়া দেওয়ায় নতুন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রও তৈরি হয়। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সৌদি আরব বাংলাদেশের বন্যাদুর্গতদের জন্য এক কোটি ডলার সাহায্য ঘোষণা করলে ওই সম্পর্ক নতুন মাত্রা পায়। বাংলাদেশে তেল আমদানিতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হতো। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে সাহায্য ও সহজ শর্তে তেল পাওয়ার আবেদন করা হয়। ওই আবেদনে সাড়া দিয়ে সৌদি আরব ১৯৭৬ সালের ৫ অক্টোবর ১০ লাখ অপরিশোধিত তেল সরবরাহের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। অর্থনৈতিক সাহায্য-সহযোগিতার পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্যের সৌদি আরবের বাজারে কম চাহিদা থাকায় ওই বাণিজ্য গতি পায়নি। কিন্তু বাংলাদেশ সৌদি আরব সম্পর্ক আরো দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ থেকে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক প্রেরণকে কেন্দ্র করে।

১৯৭৬ সালে ২১৭ জন শ্রমিক প্রেরণের মাধ্যমে ওই সম্পর্কের সূচনা হয়। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবই সবচেয়ে বেশি শ্রমিক আমদানি করে। সামরিক শাসন-পরবর্তী গণতান্ত্রিক শাসনামলে বাংলা দেশের সঙ্গে সৌদি আরবের সুসম্পর্ক আরো দৃঢ় হয়। সৌদি আরবে বর্তমানে বিশ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মরত থাকলেও নানা কারণে ২০০৮ সালের দিকে তারা বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের কূটনৈতিক দক্ষতা ও প্রজ্ঞায় সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ-সৌদি আরবের মধ্যে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক পুনরায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, যা এ দেশের অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বর্তমান ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এবং কোভিড-১৯-পরবর্তী বিশ্বে বিভিন্ন দেশ যেভাবে এর ভয়াবহ প্রভাব থেকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে তার প্রেক্ষাপটে এই সহযোগিতা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে শুধু আর্থিক সহযোগিতাই গুরুত্বপূর্ণ নয়, আন্তর্জাতিক বাজারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অধিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, এসব দেশের সক্ষমতা বাড়াতে প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং উন্নত বিশ্বে কর্মরত এসব দেশের মানবসম্পদের কাজের আরো কার্যকর মূল্যায়ন ইত্যাদি সামনে নিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা বাড়ানোর কথা বলেন। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বাংলাদেশ-কাতার সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। আমরা জানি, বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে গত এক দশকে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। যদিও কাতার ও বাংলাদেশ বরাবরই বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু ইদানীং এই সম্পর্ক আরো মজবুত হচ্ছে। বাংলাদেশ ও কাতার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যু, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলোকে অভিন্ন অবস্থান থেকে দেখছে। স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কাতার আরো বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ।

সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ ও কাতার পারস্পরিক বিশ্বাস এবং নির্ভরতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাতার যেমন শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করতেও বাংলাদেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। কারণ, জনশক্তি রপ্তানি আমাদের উন্নয়নে অন্যতম গুরুত্ব বহন করছে। তাই মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানির বাজার সৃষ্টি আমাদের পররাষ্ট্র সম্পর্কের অন্যতম বিবেচ্য বিষয় হোক- এটাই বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close