জাহিদুল ইসলাম ও অধ্যাপক ড. মল্লিক আকরাম হোসেন
দৃষ্টিপাত
প্লাস্টিক দূষণ বন্ধে সামাজিক সচেতনতা জরুরি
আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। বিশ্বব্যাপী এবারের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘বিট প্লাস্টিক পলিউশন’ অর্থাৎ ‘প্লাস্টিক দূষণকে পরাজিত করুন’। বিশ্বব্যাপী যেভাবে প্লাস্টিক ও পাস্টিক পণ্যের ব্যবহার যেভাবে বেড়ে চলছে; এই প্রতিপাদ্য তারই প্রতিফলন। প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার সীমিত না করলে আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে এই পণ্যটি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ ১২ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক পরিবেশে জমা হবে। প্রতি বছর ১৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে। সমুদ্র যে ধরনের বর্জ্য রয়েছে, তার শতকরা ৮০ ভাগই প্লাস্টিক বর্জ্য। প্লাস্টিকের দূষণ এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের উপস্থিতি বেড়ে যাবে।
প্লাস্টিক দূষণ : প্লাস্টিক দূষণ হলো নির্দিষ্ট স্থানে পলিথিন ও সিন্থেটিক প্লাস্টিক পণ্যের জমে থাকা। চারপাশে প্রতিনিয়ত প্লাস্টিক পণ্যের সিঙ্গেল ব্যবহারের ফলে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। পলিথিন ব্যাগ, কসমেটিক প্লাস্টিক, গৃহস্থালির প্লাস্টিক, বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশির ভাগই পুনরায় ব্যবহার করা হয় না। এগুলোকে সাধারণত একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। পরে এগুলো পরিবেশে থেকে বর্জ্যরে আকার ধারণ করে। প্লাস্টিক এমন এক রাসায়নিক পদার্থ, যা স্বাভাবিক পরিবেশে পৌঁছাতে অথবা কারখানায় পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করতে প্রায় ৪০০ বছরের বেশি সময় লাগে। তাই একে ‘অপচ্য পদার্থ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। এতে বন্যপ্রাণী এবং তাদের আবাসস্থলের পাশাপাশি মানুষের জন্য বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে।
প্লাস্টিক দূষণ ও বাংলাদেশ : বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন করা হলেও, বর্তমানে কার্যকর প্রয়োগের অভাবে এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের সমীক্ষা অনুসারে, বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর ক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে গত ১৫ বছরে (২০০৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে) প্লাস্টিকের ব্যবহার ৩ গুণ বেড়েছে। ২০২০ সালে ৯ লাখ ৭৭ হাজার টন প্লাস্টিকের ব্যবহার হলেও তার মধ্যে মাত্র ৩১ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে। বাকিগুলো ভাগাড়, নদী, খাল, ড্রেন ও যত্রতত্র ফেলা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ টন প্লাস্টিক বাংলাদেশ থেকে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। যার ফলে আমাদের বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশের কারণে শুধু সামুদ্রিক জীবন নয়, মানবস্বাস্থ্যের ওপরও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে।
প্লাস্টিক দূষণ ও ঢাকা : গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। আমাদের এ প্রিয় শহরে আমরা ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে অবচেতন মনে অন্যান্য বর্জ্যরে সঙ্গে ফেলে দিচ্ছি। একশোর বেশি ফ্যাক্টরিতে এসব পলিথিন ব্যাগ তৈরি হয়। পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে দেশে আইন হয়েছে এক দশকের বেশি আগে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আইনের প্রয়োগের অভাব। পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ার পর গত এক দশকে ঢাকা শহরে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বেড়েছে তিন গুণ।
বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক দূষণ : পরিবেশকে বিপন্নকারী পৃথিবীর শতকরা ৫১ ভাগ প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে শুধু এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে যোগ হচ্ছে, যা সব ধরনের বর্জ্যরে শতকরা ৮ ভাগ।
প্লাস্টিক দূষণের প্রধান কারণ : যদিও এটা মনে হতে পারে যে, প্লাস্টিক দূষণের সমস্যা সমাধান করা রিসাইক্লিং বা খালি বোতল পরিষ্কার করার মতোই সহজ। কিন্তু সত্য হলো যে, প্লাস্টিক দূষণ সৃষ্টি করে তা বড় বা ছোট হতে পারে। প্লাস্টিক দূষণের প্রধান কারণগুলো হলো : প্লাস্টিক প্রায় সর্বত্র ব্যবহৃত হয় এবং সহজ লভ্য, নগরায়ণ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে চাহিদা বেশি, প্লাস্টিক সস্তা এবং উৎপাদন সাশ্রয়ী মূল্যের, প্লাস্টিক এবং আবর্জনা পরিষ্কার করা সহজ, ধীর পচন হার, মাছ ধরার জাল তৈরি এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব প্লাস্টিক একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়।
প্রতিকারে আইন কী বলে : বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর শুরুতে ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আইন অনুসারে ‘ঝুঁকপূর্ণ বর্জ্য হলো, যেকোনো বর্জ্য, যা নিজস্ব ভৌত বা রাসায়নিক গুণগত কারণে অথবা অন্য কোনো বর্জ্য বা পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণে বিষক্রিয়া, জীবাণু-সংক্রমণ, দহন, বিস্ফোরণ ক্রিয়া, তেজষ্ক্রিয়া, ক্ষয়ক্রিয়া বা অন্য কোনো ক্ষতিকর ক্রিয়া দ্বারা পরিবেশের ক্ষতি করতে সক্ষম। এই সংজ্ঞা অনুসারে পলিথিন, প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাতগুলো ক্ষতিকর বর্জ্যরে অন্তর্ভুক্ত।’ আইনের ৬-এর ‘গ’ ধারা অনুসারে অপরাধ হিসেবে এসব বর্জ্য পদার্থ তথা ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য উৎপাদন, আমদানি, মওজুদকরণ, বোঝাইকরণ, পরিবহন, ইত্যাদি-সংক্রান্ত বাধা-নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরিবেশের ক্ষতিরোধকল্পে সরকার, অন্যান্য আইনের বিধান সাপেক্ষে, বিধি দ্বারা ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য উৎপাদন,
প্রক্রিয়াকরণ, ধারণ, মজুদকরণ, বোঝাইকরণ, সরবরাহ, পরিবহন, আমদানি, রপ্তানি, পরিত্যাগকরণ ডাম্পিং ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করিতে পারবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশের সুরক্ষার জন্য এবং দূষণমুক্ত রাখার জন্য বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করেছে। এরই মধ্যে রয়েছে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭, ওজোনস্তর ক্ষয়কারী দ্রব্য (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৪, পরিবেশ আদালত আইন-২০১০, বাংলাদেশ জীবন নিরাপত্তা বিধিমালা-২০১২, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭, জাতীয় পরিবেশ নীতি-২০১৮, ঝুঁকিপূর্ণ ই-বর্জ্য বিধিমালা-২০২১, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০২১। তবে শঙ্কার কথা হলো- এসব নীতিমালা মহান সংসদে পাস হলেও এটি প্রয়োগে কর্তৃপক্ষের যথাযথ তৎপরতা দেখা যায়নি। ফলে বন্ধ করা যায়নি অবাধে পলিথিন ও প্লাস্টিকজাত দ্রব্যের ব্যবহার।
যেসব পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে : ১. প্লাস্টিকের বেআইনি উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং ব্যবহার রোধে দূষণ ‘কর’ প্রয়োগ করতে হবে। ২. বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ, প্রয়োজনে বিদ্যমান আইন সংস্কার করে শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি এবং তার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ৩. পাশাপাশি অনুকরণযোগ্য ইতিবাচক অবদানের জন্য পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. বিশ্বব্যাপী ও আঞ্চলিক পর্যায়ে প্লাস্টিকদূষণ ব্যবস্থাপনা প্রণীত আইন ও নীতিমালাকে হালনাগাদ করতে হবে। ৫. যদিও আমাদের জীবনে প্লাস্টিকের দ্রব্যের ভূমিকা স্বীকার্য, তবে তা ব্যবহারে সতর্কতা এবং পরিমিতি আবশ্যক। ৬. প্লাস্টিকের দ্রব্যকে বারবার ব্যবহার ও পুনর্চক্রায়ণকে (রিসাইক্লিং) উৎসাহিত করতে হবে। ৭. প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক সব অংশীজনের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কমিউনিটিভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ৮. প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে সরকার ও বেসরকারি খাত কর্তৃক বিভিন্ন প্রণোদনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। ৯. সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ/সীমিত করতে হবে এবং প্লাস্টিকের পরিবেশবান্ধব বিকল্প উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা করতে হবে। ১০. টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ১৪-এর অর্জন নিশ্চিতে সমুদ্রদূষণ রোধের পাশাপাশি সমুদ্রসম্পদের সংরক্ষণ নিশ্চিতে নিয়মিত তদারকি এবং দূষণ আইনের ব্যবহারে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহায়তা নিতে হবে। ১১. ‘প্যারিস চুক্তি’ বাস্তবায়নে সব শিল্পোন্নত দেশের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হবে। ১২. পরিবেশে সহজে পচনশীল (বায়োডিগ্রেডেবল) প্লাস্টিকের ব্যবহারকে উৎসাহিতকরণ এবং পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ ও অন্যান্য পাটজাত দ্রব্যকে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারে প্রণোদনা প্রদান করতে হবে। ১৩. বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য প্রতিশ্রুত তহবিল দ্রুত ও সহজতর পদ্ধতিতে ছাড় করতে হবে। ১৪. পরিবেশ সুরক্ষানীতি ও প্লাস্টিকদূষণ নীতিমালাকে সমন্বয় করে আধুনিক জ্ঞানের ভিত্তিতে তা হালনাগাদ করতে হবে। ১৫. পরিবেশবিদ হিসেবে আমরা মনে করি, মানুষের অসচেতনতাই ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঠিক পদক্ষেপের অভাব প্লাস্টিক দূষণের প্রধান কারণ।
লেখকদ্বয় : সাবেক সভাপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাব
ও অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা
"