ইসরাত জাহান

  ০৪ জুন, ২০২৩

মুক্তমত

উচ্চশিক্ষায় নারীদের বাধা দূর হোক

‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই রেশ ধরেই বলতে হয়- মহান স্রষ্টা নারী ও পুরুষের মধ্য দিয়ে তার সৃষ্টিকর্মের পূর্ণতা দান করেছেন। কী রাজনীতি, কী অর্থনীতি, সমাজ-সভ্যতা ও বিজ্ঞান থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সভ্যতার যে বিকাশ ঘটেছে, এর স্থপতি শুধু পুরুষই নয়, নারীও বটে। মানবসমাজ অধিকাংশই পুরুষশাসিত। বলতে গেলে সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই পুরুষজাতি সমাজ শাসন করে আসছে। আর

পুরুষশাসিত এ সমাজে নারীকে অন্তঃপুরে আবদ্ধ রাখা হয়। নগর এলাকার চেয়েও গ্রাম অঞ্চলে নারীদের উন্নয়নে বাধা বেশি। নারীদের অগ্রগতির জন্য শিক্ষাগ্রহণ কার্যক্রম সবার আগে জরুরি।

নারীদের মেধার বিকাশ, মনুষ্যত্ব জাগানো, দেশের জন্য অবদান রাখা, দেশকে উপস্থাপন করা সবকিছুই সম্ভব যখন তারা শিক্ষিত হবে। কিন্তু গ্রামীণ সমাজে নারীদের স্বাক্ষর দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করিয়েই পড়ালেখা বন্ধ করে দেওয়া, বাল্যবিবাহ, পড়ালেখায় বাধা সৃষ্টি- এসব চিত্র অহরহ দেখা যায়, যা কুসংস্কার এবং অভিভাবকদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতার ফসল। দরিদ্রতার বিষক্রিয়াও মেয়েদের উচ্চশিক্ষা থেকে দূরে রাখার আরেকটি অন্যতম কারণ, যা শিক্ষাঙ্গনে নারীদের অনুপস্থিতি বাড়িয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।

এ ছাড়া নারী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নামক অগ্রযাত্রায় শামিল হতে না পারার পেছনে বহু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেমন : গ্রামীণ সমাজে নারী বৈষম্যমূলক প্রগাঢ় চিন্তাভাবনা। প্রান্তিক সমাজে বেশির ভাগ পরিবারে ভাবা হয় মেয়েরা ঘরের শোভা। শুধু স্বাক্ষর কিংবা সন্তানাদিগকে অক্ষরজ্ঞান দিতে পারার সক্ষমতাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। এ ক্ষেত্রে নারীর শিক্ষা অর্জন মাধ্যমিকেই সমাপ্ত হয়, মাঝেমাঝে তারও নিচে, যা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান কুসংস্কারের প্রভাব। কিছু পরিবারের আর্থিক সংগতি থাকলেও ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার, অবরোধপ্রথা ইত্যাদির জন্য মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় উৎসাহী করা থেকে বিরত রাখে।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের কথায়- ‘উড়তে শেখার আগেই পিঞ্জিরাবদ্ধ এই নারীদের ডানা কেটে দেওয়া হয় এবং তারপর সামাজিক রীতিনীতির জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয় তাদের।’ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এসব চিত্র দেখা যায়। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নারীকে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ গ্রামের নারীদের উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রতিবন্ধকতার নাম। গ্রামে মেয়েদের দৈহিক বৃদ্ধি দেখতে পেলেই পরিবার তার ১৮ বছর হওয়ার অপেক্ষা করে না, তার মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের গুরুত্ব না রেখেই বাল্যবিবাহ দিয়ে দেয়। বিয়ের পর দায়িত্বের বোঝা আর স্বামীদের অসচেতনতা এবং উদার মানসিকতার অভাবে পড়াশোনা চলমান রাখা সম্ভব হয় না মেয়েদের। উচ্চশিক্ষায় নারীদের সুযোগ সম্পর্কেও অনেকে অজ্ঞ, তারা জানেই না উচ্চশিক্ষার সুপ্রস্থতা। এ ছাড়া আরো কিছু কারণ রয়েছে, যেমন- উচ্চশিক্ষায় নারীদের জন্য সরকারি সহায়তার অভাব। যার ফলে বাসাভাড়া করে থাকা, খাওয়া-দাওয়া ও পড়াশোনার খরচ বহন করা তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিকে ছাত্রীর হার (একাদশ-দ্বাদশ) ৪৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ডিগ্রিতে ৪১ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ৩৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। অন্যদিকে বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের চেয়েও বেশি। কিন্তু উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও চাকরিতে অনেক পিছিয়ে নারীরা। সরকারি চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ মাত্র ২৮ শতাংশ। আর বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী মাত্র ৩৬ শতাংশ। বিজ্ঞান ও গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ ২৮ শতাংশ হলেও গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাত্র ১৭ শতাংশ নারী। তাহলে একবিংশ শতাব্দীর প্রতিযোগিতার সমাজ-কাঠামোয় পরিমাণগত অগ্রগতিকে পাশ কাটিয়ে কতটা গুণগত অগ্রগতিতে এগিয়েছে দেশের নারী সমাজ?

ধীরে ধীরে উচ্চশিক্ষায় নারীর অবনতি বা অনুপস্থিতি বাড়ছে, যা দেশের উন্নয়ন বা অগ্রগতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। শিক্ষা ও নারী উন্নয়ন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামাজিক কাঠামোয় এখনো শৃঙ্খলিত নয় নারীরা। পারিবারিক এবং আর্থিক কাঠামোয় নারীকে নির্ভর করতে হয় পুরুষের ওপর। সামনে এগিয়ে যেতে নানা কটুকথার পাশাপাশি নারীদের শিকার হতে হয় সহিংসতার মতো ঘটনারও। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও দৃষ্টান্তমূলক ন্যায়বিচারের উদাহরণ সৃষ্টি করতে না পারায় এখনো নারীদের সমাজ কাঠামোয় বাস করতে হয় অনেকটা সীমাবদ্ধ গণ্ডিতেই, যা নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ব্যাপক বাধা সৃষ্টি করছে।

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে একটি শিক্ষিত জাতি দেব’। একটি পরিবারকে সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল ও সুরক্ষিত রাখতে নারী কাজ করে বহুমাত্রিক সক্ষমতায়। একজন শিক্ষিত নারী পরিবারের পাশাপাশি সমাজ ও দেশের উন্নয়নেও রাখে অনবদ্য ভূমিকা। গ্রামের একজন শিক্ষার্থীর মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা বিকাশের অনিবার্য ধাপ উচ্চশিক্ষা অর্জন। তাই গ্রামে নারী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় উৎসাহী করা এবং উপস্থিতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। নারীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে প্রচলিত ধ্যানধারণা থেকে বের হয়ে একটি সুস্থ ও অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ দূর করার লক্ষ্যে কঠোর আইন বাস্তবায়িত করতে হবে। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষায় সরকারি সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে, তবেই উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ সর্বোচ্চ হবে, যা দেশ ও জাতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

লেখক : লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close