জুনায়েদ মাসুদ
মতামত
জ্ঞানার্জনে বই পড়ার বিকল্প নেই
জ্ঞানর্জনের বহু পন্থা রয়েছে। আমরা নিয়মিত কোনো না কোনোভাবে শিখন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছি। বন্ধুবান্ধব থেকে, পরিবার থেকে, সমাজ থেকে, কোনো ঘটনা থেকে আবার হয়তো কখনো ভুল করে সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছি। এগুলো সবই অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় আমাদের অবচেতন মনে হচ্ছে, যা সাধারণত মায়ের কোল থেকে নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত চলমান থাকে।
তবে, এ শিখন প্রক্রিয়ার আমাদের মনোজগৎকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করে না। আমাদের মধ্য থেকে কোনো নতুনত্বের জন্ম হয় না। আমাদের মধ্যে থাকা বহুমুখী বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রকাশ পায় না। বরং নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হয় পুরোনো জ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে। আর সেই পুরোনো জ্ঞান মেলে বইতে। আমাদের চিন্তার প্রসারণ ঘটে যখন মস্তিষ্কের ওপর জোর প্রয়োগ করে কিছু শেখা হয়। আমরা যখন বই পড়ি তখন তা আমরা করি এক রকম আমাদের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে গিয়ে। কারণ যখন বই পড়া হয় তখন আমাদের ব্রেণে অন্যান্য উত্তেজনামূলক কাজের তুলনায় ডোপামিন কম নিঃসরণ হয়। আর আমাদের প্রবৃত্তি আমাদের সেসব কাজের দিকে বেশি ধাবিত করে যাতে ডোপামিন নিঃসরণ বেশি হয়।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষ বর্তমানে গড়ে ১৬ মিনিট পড়াশোনা করে। আর যারা খুব বেশি বই পড়ে তারা গড়ে ৪৮ মিনিট পড়াশোনা করে। গবেষণার এই রিপোর্ট আপনাকে হয়তো হতাশ করবে। সমাজে বইপড়ুয়া লোকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আর এটাও বলা ভুল হবে না যে, প্রকৃতপক্ষে এটাও একটা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ। এ বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে বই পড়ার উপকারিতা কি তা জানলে।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে কেউ চাইলে এ প্রশ্ন তুলতেই পারে, আমরা এখন প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত। বর্তমান সরকারের বদৌলতে সবার হাতে স্মার্টফোন। টাকা খরচা করে বই কিনতে হয় না। চাইলেই যেকোনো সময় যা কিছু জানা প্রয়োজন জেনে নিতে পারছি। তাহলে আবার কষ্ট করে বই পড়া কেন? জি অবশ্যই এর উত্তর আছে। সেজন্য আপনাকে একটু কষ্ট করে সামনে পর্যন্ত পড়তে হবে। জানাতে হবে বই পড়লে কী কী উপকার হয়?
গবেষণায় দেখা গেছে, বই পড়ার বহুমুখী উপকারিতা রয়েছে। তার মধ্যে প্রথমটি হলো-
১. বই পড়লে বুদ্ধি বাড়ে। ২. শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি পায়। গবেষণায় এটাও পাওয়া গেছে যার শব্দভাণ্ডার যত বেশি সমৃদ্ধ তার আইকিউ তত বেশি। ৩. কোনো কিছুতে ফোকাস করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। যেকোনো কাজে অন্যদের তুলনায় বেশি মনোযোগী হতে পারে। ৪. বই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে। নেতিবাচক চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে। মানসিক চাপ কমে। ৫. বই আমাদের ধৈর্যশক্তি বাড়ায়। আমাদের শৃঙ্খলিত করে। কারণ, একটি বই যখন আমরা পড়ি তখন আমরা সেটা ধারাবাহিকভাবে পড়ে শেষ করি। ৬. বই পড়লে সৃজনশীলতা বাড়ে। সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা বাড়ে। চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়তে থাকে। মস্তিষ্ক সব সময় সক্রিয় থাকে। ৭. বই পড়লে অন্যের প্রতি দয়া বা সহানুভূতির বৃদ্ধি হয়। কারণ যারা বই পড়ে তারা অন্যের চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখার চেষ্টা করে। অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করে, যা কারো মধ্যে থাকা সহানুভূতিশীলতা বৃদ্ধি করে এবং এর ফলে সামাজিক আন্তসম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। ৮. আবার যারা কাগজের বই পড়ে তাদের বোধগম্য শক্তি খুব বেশি হয়। তারা বই পড়ার পর তা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে ই-বুকপড়ুয়াদের তুলনায়।
তা ছাড়া, বই পড়ার আধুনিক ধারণা বলে, আমাদের বই পড়া উচিত পৃথিবী কীভাবে চলে তা জানার জন্য। অর্থাৎ, পৃথিবীর আর্থসামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি বিষয় কীভাবে কাজ করে তা বোঝার জন্য। ইতিহাসে যারা আমাদের কাছে মহানায়ক হিসেবে পরিচিত তারাও ‘বই পড়া’কে অগ্রাহ্য করেননি বরং বই পড়ার ব্যাপারে তারা অগ্রগামী ছিল। নেপোলিয়ন বলতেন, ‘অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে’ জীবন অচল। মাও সেতুং বলতেন, ‘পড়, পড় এবং পড়।’ প্রমথ চৌধুরী তার বই পড়া প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘দেহের মৃত্যুর রেজিস্টারি রাখা হয়, আত্মার মৃত্যু হয় না।’
বই পড়ার মাধ্যমে আমাদের আত্মা তৃপ্ত হয়। এটা তার চাহিদা। যখন আত্মার এই চাহিদা না মেটে তখনই তার মৃত্যু হয়। এজন্যই হয়তো স্পিনোজা বলেছেন, ‘ভালো খাদ্যবস্তু পেট ভরে কিন্তু ভালো বই মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে।’ ফ্রাৎস কাফকা বলেছেন, ‘আমাদের আত্মার মাঝে যে জমাটবাঁধা সমুদ্র সেই সমুদ্রের বরফ ভাঙার কুঠার হলো বই।’ বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই এবং বই।’
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে ‘বই পড়া’ নিয়ে একটা সুপরিচিত ধারণা বিদ্যমান যে, বই পড়তে হয় চাকরির জন্য। আর বাস্তবতাও তাই, শিশু ছোটবেলা থেকে এটা শুনে বড় হয় যে, তাকে বড় হয়ে ডাক্তার, পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে তাই তাকে বই পড়তে হবে। পরীক্ষার খাতায় ভালো নম্বর পেতে হবে। এতে করে সেই শিশুটির মধ্যে এ ধারণা গেথে যায় যে, তাকে ভালো নম্বরের জন্য বই পড়তে হবে। একটা সময় গিয়ে সে মেশিনের মতো একের পর এক বই গলাধঃকরণ করলেও তা তার মেধা ও মননকে পরিশুদ্ধ করে না। বইয়ের শিক্ষা তার আচরণে ফুটে ওঠে না। আর তার মধ্যে অ্যাকাডেমিক কারিকুলামের বাইরে গিয়ে সাহিত্যচর্চা করার আগ্রহ জাগে না।
যার কারণেই হয়তো আজ আমাদের তরুণসমাজ বই পড়ার ব্যাপারে উদাসীন। তাদের মনোযোগের সক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। তারা সৃজনশীল চিন্তায় পিছিয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে সহানুভূতিশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। যাদের নিয়ে আগামীর সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখা হচ্ছে, তারাই হয়তো হতে চলেছে জ্ঞানহীন, অজ্ঞ এক প্রজন্ম। এর পেছনে অনেকগুলো বাহ্যিক কারণকে দায়ী করা যায়। যার মধ্যে একটি বিকৃত সামাজিক মাধ্যমগুলোর প্রতি আসক্তি। আজ তরুণ, যুবসমাজ জাতির প্রতি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে এক অন্ধ প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
তরুণ-যুবসমাজের এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলায় তাদের বই পড়ানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করার কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক বই পড়ার চাপ কমিয়ে এর পাশাপাশি অন্যান্য বই (ফিকশন অথবা নন-ফিকশন হতে পারে) পড়ানোর জন্য সাপ্তাহিক, মাসিক পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে প্রতিটি গ্রামে-মহল্লায় একটি করে লাইব্রেরি তৈরি করে তাদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ তৈরি করা যেতে পারে। এলাকাভিত্তিক সংগঠন তৈরি করা যেতে পারে, যা তরুণ ও যুবকদের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার বিকাশ ঘটাবে। দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করবে।
পরিশেষে বলা যায়, আগামীর বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন আমরা দেখি, সে স্বপ্নপূরণে অবশ্যই প্রয়োজন একদল জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন তরুণ, যারা মেধা ও মননে হবে নৈতিকতাসম্পন্ন, দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ ও অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই, বই পড়ার মাধ্যমেই হতে পারে তাদের নৈতিক চিন্তার বিকাশ। যার রেশ ধরেই হয়তো তারা আগামী দিনে জাতির জন্য সুফল বয়ে আনবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
"