ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

  ০৪ জুন, ২০২৩

জাতীয় চা দিবস

চা-শিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার অবদান

আজ জাতীয় চা দিবস ২০২৩। জাতীয় বোর্ডের উদ্যোগে দেশে তৃতীয়বারের মতো এই দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে। আর চা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আরেকটি দিবসও উদযাপন করা হয়। সেটির নাম ‘আন্তর্জাতিক চা দিবস’। এটি ২১ মে পালন করা হয়। যদিও প্রথমে ১৫ ডিসেম্বর ছিল বিশ্ব চা দিবস। বিশ্বের এই দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত পানীয়ের পুষ্টিগত গুরুত্বের প্রতি সচেতনতা বাড়াতে জাতিসংঘের উদ্যোগে এই দিবসটি পালিত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই দিবসটি উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে চা-শিল্পে জাতির পিতার অবদান এবং চা বোর্ডে যোগদানের তারিখকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে। ১৯৫৭ সালের ৪ জুন প্রথম বাঙালি হিসেবে তৎকালীন চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালে এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চা-শিল্পে বঙ্গবন্ধু অবদান রাখেন। চা-শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। চাগাছের জন্য অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত ও তাপের প্রয়োজন হয় বলে বাংলাদেশের বৃষ্টিবহুল পাহাড়ি অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চায়ের চাষ হয়।

জাতীয় চা দিবস পালনের পেছনে এ দিনটির গুরুত্ব কী? তা হয়তো অনেকেরই অজানা। আসুন জানি এর ইতিহাস- জাতীয় চা দিবস সর্বপ্রথম ২০২১ সালে পালিত হয়। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালে এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চা-শিল্পে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর ৪ জুন চা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয় এবং গত ২০২১ সালে সর্বপ্রথম জাতীয় চা দিবস পালিত হয়।

বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালে ১১১-১১৩, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকায় সরকার কর্তৃক বরাদ্দ করা দশমিক ৩৭১২ একর ভূমির ওপর চা বোর্ডের প্রধান কার্যালয়ের নির্মাণকাজ ত্বরান্বিত হয়। তিনি ১৯৫৭ সালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে টি-রিসার্চ স্টেশনের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করে উচ্চফলনশীল জাতের চাগাছ উদ্ভাবনের নির্দেশনা দেন। চায়ের উচ্চফলন নিশ্চিত করতে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানে উচ্চফলনশীল জাতের চারা রোপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তিনি ‘টি অ্যাক্ট-১৯৫০’ সংশোধনের মাধ্যমে চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড (সিপিএফ) চালু করেছিলেন, যা এখনো চালু রয়েছে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় চা বাগানগুলো প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ শিল্পকে টেকসই খাতের ওপর দাঁড় করানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। তিনি স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ গঠন করে যুদ্ধোত্তর পরিত্যক্ত চা বাগান পুনর্বাসন করার পদক্ষেপ নেন। এ ছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিত্যক্ত বাগানগুলোকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে বাগান মালিকদের কাছে পুনরায় হস্তান্তর করেন।

স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত চা কারখানাগুলো পুনর্বাসনের জন্য ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ থেকে ঋণগ্রহণ করে চা-শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির ব্যবস্থা নেন। চা-শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় বঙ্গবন্ধু সরকার চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি দেওয়ার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। ওই সার সরবরাহ কার্যক্রম এখনো অব্যাহত আছে। তিনি চা-শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ নিশ্চিত করেন। যেমন বিনা মূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা, চিকিৎসা ও রেশনপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ টি রিসার্চ স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে উন্নীত করেন বঙ্গবন্ধু। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে বাংলাদেশের চা উৎপাদনশিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে ১৬৭টি চা বাগান রয়েছে। এই ১৬৭টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯১টি, হবিগঞ্জে ২৫টি, সিলেটে ১৯টি বাগান রয়েছে। তা ছাড়া চট্টগ্রামে ২২টি, রাঙামাটিতে ২টি এবং ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি চা বাগান রয়েছে। বাংলাদেশে চায়ের ভূমির পরিমাণ ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪২২ দশমিক ৬৯ হেক্টর। চা বাগানে চাষযোগ্য ভূমির পরিমাণ ১ লাখ ১৮৩ হাজার ৫৯৪ দশমিক ৪৩ একর। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, চা বাগানের শ্রমিকের পরিমাণ ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯৭ জন। এদের মধ্যে অধিকাংশই নারীশ্রমিক। চা বাংলাদেশের একটি অতি পুরাতন ও ঐতিহ্যবাহী শিল্প। এই চা-শিল্পের সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের চা-শিল্প ও চায়ের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

জাতীয় অর্থনীতিতে চা-শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম ও সুদূরপ্রসারী। জিডিপিতে এই খাতের অবদান শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ। তাই পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরি ও তারই তনয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশের চা-শিল্পের উন্নয়নের পাশাপাশি চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করে এই দেশের মূল জনস্রোতের সঙ্গে তাদের একত্রিভূত করার জন্য নানামুখী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যার কার্যক্রম এখনো অব্যাহত আছে এবং চা-শ্রমিকরা তার সুফল ভোগ করছে। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ক্রমাগত নগরায়ণ জনগণের শহরমুখিতা, গ্রামপর্যায়ে শহরের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি গ্রামীণ মানুষের রুচি ও অভ্যাসের পরিবর্তন, তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ইত্যাদির কারণে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তবতার আলোকে চায়ের গুণগত মান বৃদ্ধি ও নতুন নতুন জায়গা চা চাষের আওতায় এনে চায়ের উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এই উদ্দেশ্যে দেশে চা আবাদের সম্ভাব্য সমীক্ষা পরিচালনা করে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর, লালমনির হাট, জামালপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় ১০,১৭২ হেক্টর ক্ষুদ্রায়তনের চাষযোগ্য জমি চিহ্নিত করা হয়।

পরে এই প্রকল্পের আওতায় ২০০০ সালে উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ২০০৫ সালে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০০৭ সালে, ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী ও লালমনিরহাটের হাতিয়াবান্দায়, ২০১৪ সালে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে ও দিনাজপুরের বীরগঞ্জে ক্ষুদ্রপর্যায়ে চায়ের চাষ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের আন্তরিকতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রয়োজনীয় নীতি ও কৌশল প্রণয়ন, সর্বোপরি তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের ফলে দেশের উত্তর জনপদের পঞ্চগড়ে চা চাষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। চট্টগ্রাম ও সিলেটের পরে পঞ্চগড় দেশের অন্যতম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ১৯৯৯ সালে উত্তরবঙ্গে চা চাষের পরিকল্পনা করা হয়। পরে ২০০০ সালে সেখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চায়ের চাষ শুরু হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই মূলত চা-শিল্পের উন্নয়ন, চায়ের গুণগত মানের পরিবর্তন এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। বর্তমান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ও ধারাবাহিক রাষ্ট্র পরিচালনায় চা-শিল্পের উন্নয়নে গতি আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। বর্তমানে চায়ের উৎপাদন ৩১.৩৮ মিলিয়ন কেজি থেকে বেড়ে ৬৭ মিলিয়ন কেজিতে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে ২০১২ সালে যেখানে চা উৎপাদন হয়েছিল ৬২ দশমিক ৫২ মিলিয়ন কেজি, সেখানে ২০২১ সালে রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হয় ৯৬ দশমিক ৫১ মিলিয়ন কেজি। বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের চায়ের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। সূত্র মতে, বিশ্বে ২৩টি দেশে বাংলাদেশের চা রপ্তানি হয়ে থাকে। গত পাঁচ বছরে দেশ থেকে ১৫০ কোটি ২৪ লাখ ৭০০ কোটি টাকার চা বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। এ সময় দেশ থেকে গড়ে চা রপ্তানি হয় ২২ কোটি ৫৬ লাখ টাকার। এতে বাড়ছে রপ্তানি আয় এবং সমৃদ্ধ হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি।

সরকার চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য ইতিমধ্যে ১৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছে। বিভিন্ন এনজিও শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকার শিশুদের শতভাগ ভর্তির ওপর জোর দিচ্ছে। চা-শ্রমিক ও তাদের সন্তানদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সরকার একটি রোড ম্যাপও প্রণয়ন করেছে এবং সেই অনুপাতে কাজ করছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ৫০ হাজার শ্রমিককে বছরে ৫ হাজার টাকা করে ভাতা দিচ্ছে। তা ছাড়া সরকার তাদের প্রতি মাসে বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, স্বামী নিগৃহীত ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও শিক্ষা উপবৃত্তিও দিচ্ছে। সম্প্রতি চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ থেকে ১৭০ টাকা করা হয়েছে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের তৈরি ঘর দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আশা করি, এতে চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত হবে, চা-শিল্পের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটবে এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

drmazed96@gmail com

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close