মোহাম্মদ অংকন

  ০৩ জুন, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

সার্টিফিকেট পোড়ালেই কি চাকরি মিলছে

শিক্ষাজীবনের চূড়ান্ত সফলতার নাম হচ্ছে চাকরি পাওয়া। আর তা যদি হয় সরকারি, তবে তো কথাই নেই। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে লেখাপড়া করার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে চাকরি পাওয়া। লেখাপড়া করে যদি চাকরি না পাওয়া যায়, তবে সে লেখাপড়ার কোনো দাম নেই বলেই বিবেচনা করা হয় এবং এই চাকরিনামক মরীচিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে রীতিমতো ঘাম ঝরাতে হয় সার্র্টিফিকেটধারী তরুণ জনগোষ্ঠীকে। কারো সার্টিফিকেটের দাম বেড়ে যায় চাকরি পাওয়ার মধ্য দিয়ে। আবার কারো সার্টিফিকেটের কোনোই দাম থাকে না চাকরি না পাওয়ার কারণে। তখন নাম উঠে আসে বেকারের খাতায়। বর্তমানে এই বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও কম নয়। ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন বা তারও বেশি। বিপুল এই জনগোষ্ঠী যখন লেখাপড়া শেষ করেও কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাচ্ছে না, যখন হতাশার চরম শেখরে, যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে, যখন সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, নিজেকে প্রমাণ করতে পারছে না যে সে যা শিখেছে তা যথোপযুক্ত, কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তাকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করছে না, বিপুল চাকরি প্রার্থীর সঙ্গে কোনোমতেই পেরে উঠছে না, চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো একই দিনে অনেক পরীক্ষার আয়োজন করে পরীক্ষা থেকে বঞ্চিত করে সুযোগ নষ্ট করছে, কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লাগাতার সেশনজটের কবলে পড়ায় চাকরির পরীক্ষা বা প্রস্তুতির যথেষ্ট সময় না পাওয়ায় হেরে যেতে হচ্ছে, তখন উপায় কী? তবে উপায় একটি তৈরি হয়ে গেছে আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে। তা হচ্ছে অর্জিত সার্টিফিকেট পুড়িয়ে সে দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে রাতারাতি ভাইরাল হওয়া।

এই পন্থা অবলম্বন করে অনেকেই চাকরি পাচ্ছে বলে ইদানীং দেখা যাচ্ছে। দেশে যেখানে ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন বেকার, সেখানে এক বা দুজন সার্টিফিকেট পোড়ানোর বিনিময়ে চাকরি পাওয়াতে দেখা দিচ্ছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেকেই বলছে, এটি এখন একটা বাজে ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। সার্টিফিকেট পোড়ানোর ভিডিও ভাইরাল করলেই মিলছে চাকরি এবং এটাও সত্য এ-জাতীয় যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, তার প্রত্যেকেই কোনো না কোনো দপ্তরে চাকরি পেয়েছে। এভাবে না হয় গুটিকয় মানুষের চাকরি হচ্ছে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক চাকরিপ্রার্থী চাকরি পাচ্ছে না, এই সার্টিফিকেট পোড়ানোর কৌশল তাদের কী বার্তা দিচ্ছে? তবে কি সবাই সার্টিফিকেট পুড়িয়ে চাকরিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করবে? এটা কি আদৌ সম্ভব? সার্টিফিকেট পোড়ালেই যদি চাকরি মেলে, তবে এর চেয়ে ভালো আর কী-বা হতে পারে! তবে এটা মোটেও ভালো দেখায় না। এই বাজে ট্রেন্ড হতাশ করছে সংগ্রামী, পরিশ্রমী ও মেধাবী চাকরিপ্রার্থীদের। তারা ভাবছে, ভাইরালপ্রথার কাছে হেরে যাচ্ছে তাদের মেধা, পরিশ্রম ও অর্জিত সার্টিফিকেট। সার্টিফিকেট পুড়িয়ে চাকরি পাওয়ার বিষয়টি একই সঙ্গে লজ্জার ও মেধাবীদের জন্য বিব্রতকর বটে এবং এটা নিয়ে সমালোচনা হওয়ারই কথা এবং হচ্ছেও।

বর্তমানে চাকরির বাজারে প্রার্থীদের আধিক্য থাকলেও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যথেচ্ছ স্বচ্ছতা ও জবাদিহির জায়গা তৈরি হয়েছে। সরকারি চাকরিতে অনলাইনে আবেদন সিস্টেম চালু হওয়ায় এসেছে নিয়োগবিধিতে স্বচ্ছতা। এখন ঘুষ দিয়ে চাকরি নিতে যাওয়া মানে চাকরি না পেয়ে প্রতারিত হয়ে ফিরে আসা। যারা চাকরি পাচ্ছে, তারা অবশ্যই মেধা ও দক্ষতায় পাচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে যে পরিমাণ চাকরিপ্রার্থী একটি চাকরির জন্য আবেদন করে থাকে, সে পরিমাণ কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ নেই, থাকার কথাও না। তাই চাকরিতে মোট আবেদনের ১ শতাংশেরও কম মানুষের চাকরি হয়ে থাকে এবং এই মানুষগুলো অবশ্যই ভাগ্যবান। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়, একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া হলেও কিছু মানুষের চাকরি হচ্ছে, আর বেশির ভাগ মানুষ সেই মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারছে না কেন? এর থেকে বোঝা যায়, বিভিন্নজনের চেষ্টা বা পরিশ্রমের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একই সার্কুলারে আবেদন করে কেউ কাঙ্ক্ষিত নম্বর পেয়ে চাকরি পাচ্ছে আর কেউ নির্ধারিত নম্বর পাচ্ছেই না। বারবার হার মানতে হচ্ছে। এই হার মানার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে।

এরই মধ্যে আমি যে কারণটাকে চিহ্নিত করতে পেরেছি, তা হচ্ছে- নিজে যেটার জন্য যোগ্য না বা যেটার জন্য পরিশ্রম করার সক্ষমতা নেই, সেটার পেছনে সময় নষ্ট না করা। আমি যেখানে দেখছি, আমার মেধা বা পরিশ্রমের দৌড় একটা নির্দিষ্ট লেবেল পর্যন্ত; কিন্তু সে লেবেলের ওপরে গিয়ে চেষ্টা করছি। আর এতেই বারবার ছিটকে পড়তে হচ্ছে। হতাশ হয়ে সার্টিফিকেট পুড়িয়ে দোষ চাপানো হচ্ছে সরকারকে যে এ সরকারই চাকরি না দিয়ে লাখ লাখ বেকার তৈরি করছে। সরকার কখনো বেকার তৈরি করে না। আমাদের বুঝতে হবে সরকারেরও চাকরিক্ষেত্র তৈরির একটা সীমাবদ্ধতা আছে। চাইলেই আঠারো কোটি মানুষকে তো আর সরকার চাকরির ব্যবস্থা করতে পারবে না। কিন্তু সেই বোধটা আমাদের তৈরি হচ্ছে না। আমরা মরীচিকার মতো একই দিকে ছুটে চলেছি সবাই। মেধা, দক্ষতা ও পরিশ্রমকে সঠিকভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে না লাগিয়ে শুধু চাকরির পেছনে ছুটে দিনশেষে চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেলছি।

এই শ্রেণির মানুষ বুঝতে পারছে যে নিজের যোগ্যতায় সফল হওয়া মোটেও সম্ভব না। তাই ইদানীং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে ভাইরাল হয়ে চাকরিপ্রাপ্তির ভিন্ন কৌশল রপ্ত করতে শুরু করেছে। নিজের বিবেক, বুদ্ধি, বিবেচনা, মানবিকতা বিসর্জন দিয়ে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভাইরাল হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামছে। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশের কিছু মানুষ আবার এসব ভাইরাল চাকরিপ্রার্থীর অসুস্থ প্রতিযোগিতার পাশে দাঁড়াচ্ছে যার মানে হচ্ছে সার্টিফিকেট পোড়ানোকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এই অসুস্থ ট্রেন্ডকে সমর্থন করার মধ্য দিয়ে বৃহৎ বেকারসমাজকে হতাশায় নিমজ্জিত করা হচ্ছে। তাই সার্টিফিকেট পোড়ানোর দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করে যে বা যারা চাকরির আশা করছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো মোটেও শুভ লক্ষণ নয়।

দেশে লাখ লাখ বেকার রয়েছে, যাদের চোখ শুধু একমুুখী, উদ্দেশ্য শুধুই সরকারি চাকরি পাওয়া। কেন দেশে আর চাকরিক্ষেত্র নেই? বেসরকারি খাতে চাকরির যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তা বেকার নির্মূলকরণে যথেষ্ট সহায়ক। কিন্তু আমাদের অধিকাংশের চোখ শুধু ঊর্ধ্বমুখী। আমরা শিক্ষিত হচ্ছি, সার্টিফিকেট পাচ্ছি, কিন্তু ইনোভেটিভ কিছুই করতে পারছি না। ব্যবসার দিকে নজর নেই শিক্ষিতসমাজের। অথচ এই সেক্টরে যৌবনের শুরুর দিক থেকেই নিজেকে ইনভেস্ট করলে নিজেই বরং হাজার হাজার মানুষকে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারবে। এমন অসংখ্য তরুণের ব্যবসায়িক সফলতার উদাহরণ হয়েছে। আমরা সেদিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না।

যাই হোক, লেখাপড়ার আসল উদ্দেশ্য যখন শুধু চাকরিপ্রাপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেখানে কোনো মোটিভেশনই কাজ করার কথা না। আমাদের সমাজব্যবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে কম বেতনের একজন সরকারি চাকরিজীবীকে যে সম্মান করে, লাখ টাকার ব্যবসায়ী তরুণকে সে চোখে দেখে না। তাই তরুণরাও সোনার হরিণনামক চাকরির পেছনে ছোটে। এসব তরুণের মেধা-মননকে কাজে লাগাতে পারিবারিক ও সামাজিক সমর্থন জরুরি। (এ ক্ষেত্রে আমরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠাপোষকতা আশা করতে পারি) এবং প্রতিটি শিশুকে ছোট থেকেই এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় চতুর্মুখী। বুদ্ধি বিকাশের স্বাধীনতা প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেকে শুরু থেকেই বিভিন্ন উপায়ে বা বিকল্পভাবে তৈরি করতে শিখতে পারার জন্য তৈরি করতে হবে। চাকরি পেতেই হবে- এমন মনমাসকিতা নিয়ে বড় হওয়া প্রতিটি শিক্ষিত ব্যক্তিই চাকরি না পেয়ে দিনশেষে হতাশ হয়ে সার্টিফিকেট পোড়ানোর মতো অযৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হবে।

মনে রাখতে হবে, সার্টিফিকেট পুড়িয়ে এক বা দুজনের কর্মসংস্থান হলেও একটা বিরাট গোষ্ঠীকে পরিশ্রমের মাধ্যমেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। তাই যে বা যারা সার্টিফিকেট পুড়িয়ে চাকরি পেয়ে সফলতার সিঁড়িতে পা রাখছে, তাদের বিষয়টাকে আমরা নিছক দুর্ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করব। এটা থেকে উৎসাহী হয়ে নিজেকে বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণির মানুষ হিসেবে প্রমাণ করার মধ্য দিয়ে নিজের অর্জিত সার্টিফিকেট তথা শিক্ষাকে ছোট করার কোনো মানেই হয় না। অর্জিত জ্ঞান, শিক্ষা ও মেধা যদি যথোপযুক্ত হয়, তবে এক দিন না এক দিন তা কাজে লাগবেই। হয়তো কারো দ্রুত কাজে লাগে, কারো-বা একটু ধীরে। তার মানে এই নয় যে সে সফল আর আমি ব্যর্থ। প্রত্যেক মানুষই কোনো না কোনোভাবে সফল আবার কোনো না কোনোভাবে ব্যর্থ। তাই কারো সঙ্গে নিজেকে তুলনা না করে নিজের লক্ষ্যকে অটুট রেখে পরিশ্রম ও চেষ্টা করে যেতে হবে।

লেখক : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close