মো. সাখাওয়াত হোসেন

  ০১ জুন, ২০২৩

বিশ্লেষণ

মার্কিন ভিসানীতি ও রাজনীতি

বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পলিসি সরকারের জন্য কোনো চাপ নয়। অবশ্য সরকারবিরোধী গ্রুপের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রেশার তাদের নিজ নিজ দলের রাজনীতিতে ভিন্নমাত্রা আনয়ন করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পলিসিতে পরিস্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে; নির্বাচন সামনে রেখে কেউ যদি অগ্নিসহিংসতা, অগ্নিসন্ত্রাস করে তাহলে তাদেরও ভিসা দেওয়া হবে না। অর্থাৎ যারা সরকারের নির্বাচন আয়োজনে বাধা-বিপত্তির সৃষ্টি করবে তাদের ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞার প্রলেপ আঁকা হবে। তবু এই ভিসানীতির অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে; অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাকগলানো; আর এগুলো হলো মূলত কর্তৃত্ববাদের হাতিয়ার এককথায় সাম্রাজ্যবাদের পরিপূরক।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে. ব্লিংকেন বলেছেন, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাদানকারীদের আর ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। যাদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করা হতে পারে তাদের মধ্যে বাংলাদেশে কর্মরত কিংবা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, সরকারি বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগের কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরাও রয়েছেন। এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর টুইটের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন; মার্কিন সরকার ঘোষিত নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশ সরকারকে মোটেও বিচলিত করছে না, কারণ সরকার জনগণকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা-সংক্রান্তে ঘোষণা আসার পর থেকে বিশ্লেষকরা পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন। সরকার যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের ঘোষণাকে সাধুবাদ জানিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সব সময়ই বলা হয়েছে; দেশের প্রচলিত সংবিধান মোতাবেক সরকার নির্বাচন আয়োজনের সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে কমিশনকে সহযোগিতা করবে। কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব আয়োজন সম্পন্ন করবে। এখন এ ক্ষেত্রে যদি কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে এর দায় কি সরকারের ওপর এসে পড়বে? সম্প্রতি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, এ নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশ কটি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেনি। এ নির্বাচনের বিশ্লেষণে নির্বাচনে নিরপেক্ষতার বিষয়টি উঠে এসেছে এবং সবাই নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রশংসা করেছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে তার দায় কি নির্বাচন কমিশনের কিংবা সরকারের?

প্রকৃত অর্থে নির্বাচনের প্রাক্কালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভিসা-সংক্রান্ত এ ধরনের ঘোষণা সব পক্ষের কাছে এক ধরনের বার্তা হতে পারে। সরকারের কাছে বার্তাটি হচ্ছে; যেকোনো উপায়ে নির্বাচন আয়োজনে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করতে হবে। এ কাজটি না করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দায়ীদের ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানাবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীলরা যদি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে প্রো-অ্যাকটিভ ভূমিকা পালন করে সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্ষেত্রে কোনোরূপ বাধা-বিপত্তি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে সব জায়গায় বলছেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজনের স্বার্থে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা-সংক্রান্তে এ ধরনের ঘোষণা আসার পরই অনুষ্ঠিত হলো গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। এ নির্বাচন প্রায় প্রত্যেকেই সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং সরকার নির্বাচন-সংক্রান্ত একটি সুস্পষ্ট বার্তা এর মাধ্যমেই বিশ্বনেতৃত্বের কাছে পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছে। অর্থাৎ সরকারও চায় দেশের নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পাদিত হোক এবং নির্বাচনে জনগণের রায়ের প্রতিফলন ঘটুক।

অন্যদিকে বিএনপিসহ বেশ কটি রাজনৈতিক দল দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অপারগতা জানিয়ে আসছে। তাদের দাবি- দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারে না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে তাদের অব্যাহত আলোচনা চলছে। আবার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নিয়মানুযায়ী, সংবিধান সংশোধনের জন্য জাতীয় সংসদে দু-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের বাইরে অন্যান্য দলের পক্ষে এ বিষয়ে দালিলিক কোনোরূপ ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ নেই। এর ধারাবাহিকতায় যদি ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় যে ধরনের জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি, অগ্নিসন্ত্রাস, ভয়ের সংস্কৃতি দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটেছিল; এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যদি কেউ করার দুঃসাহস দেখায় অর্থাৎ সাধারণ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, যেখানে ভয়ের কারণে মানুষ ভোট দিতে বিরত থাকে; এমন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যে বা যারাই জড়িত থাকুক না কেন তাদের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে অপারগতা দেখাবে। কাজেই যে পক্ষটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করবে তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হবে।

আবার অনেকেই মনে করছেন, ঘোষিত মার্কিন ভিসানীতি সরকারের ক্ষেত্রে অনেকাংশে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। বিশেষত, সরকার নিয়মানুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে অন্য দলগুলো এর বিরোধিতা করছে। সরকারের পক্ষে যুক্তি দেখানোর অন্যতম একটি উপায় হচ্ছে; সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনায় সরকার বদ্ধপরিকর। আর সংবিধান হচ্ছে আইনত রাষ্ট্রের পথনির্দেশক। সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন পরিচালনা করলে কোনো পক্ষই সরকারকে দোষারোপ করতে পারবে না। এদিক বিবেচনায় সরকার নিরাপদ জায়গায় অবস্থান করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের নির্বাচনিক সংস্কৃতিতে কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনে বাধা সৃষ্টির সব ধরনের অনুঘটককে কাজে লাগিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিতে কাজ করবে। ঘোষণানুযায়ী এ শ্রেণিটির ওপর মূলত যুক্তরাষ্ট্রের খড়্গ নেমে আসবে।

বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে চমৎকার মূল্যায়ন করেছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র জানে যে বাংলাদেশে চীন অনেক প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতাও অনেক এবং যুক্তরাষ্ট্র সচেতন যে বাংলাদেশ-দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের মতোই- ভারত ও চীন উভয়ের সঙ্গেই ভারসাম্য রেখে চলতে চায়। তবে যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায় এবং এটাও দেখতে চায় যেন তারা চীনের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে।’

তার কথায়- ‘ওয়াশিংটনে আজকাল স্ট্র্যাটেজির কথা বললেই তা চীনের সঙ্গে জটিলতার লেন্স দিয়ে দেখা হয়। আমার তো মনে হয় অনেকেই যুক্তি দেবেন যে এ ধরনের (ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের মতো) নীতি নিলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, কারণ তা ঢাকাকে চীনের আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে বা এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বেইজিং ঢাকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকূল হবে না। বরং বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতিতে বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটানোর যে কথা আছে- তার আলোকে একে দেখাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়’- বলেন মি. কুগেলম্যান।

মাইকেল কুগেলম্যান কূটনৈতিক দক্ষতায় উল্লেখ করেন, ‘সম্ভবত বাংলাদেশকে ওয়াশিংটন এটা বোঝাতে চাইছে যে তারা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায়- এমন ধারণা ঠিক নয়। কারণ বাংলাদেশে এমন একটা ধারণা অনেকের আছে যে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারের বিরোধী, যেহেতু তারা এ সরকারের অনেক সমালোচনা করেছে। কিন্তু এই নতুন ভিসানীতিতে এটা পরিষ্কার যে এর আওতায় সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের লোকরাই পড়বেন- যদি তারা অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনে বিঘ্ন সৃষ্টি করেন। ফলে এটা হয়তো যুক্তরাষ্ট্র যে একটি নিরপেক্ষ ভূমিকা নিচ্ছে এ ধারণা জোরদার করার জন্যই নেওয়া হয়েছে।’

সবশেষে আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যাশা রাখি, দেশের প্রচলিত সংবিধান মোতাবেক সরকার নির্বাচন আয়োজনের সব ধরনের প্রস্তুতিতে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার নতুন উদ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশগড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বেশ কটি নির্বাচনে স্বচ্ছতার মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনায় মুনশিয়ানা দেখিয়েছে এবং কমিশনের সব থেকে বড় দায়িত্ব হচ্ছে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা।

লেখক : চেয়ারম্যান

ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close