ধন রঞ্জন ত্রিপুরা

  ২৭ মে, ২০২৩

অভিমত

অর্থনৈতিক সংকটের মুখে বিশ্ব

মহামারি কোভিড-১৯-এর ধাক্কায় বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা ও সংকট সৃষ্টি হয়েছিল সেটা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের প্রায় সব দেশের চলমান অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। দিন দিন অস্ত্রের চাহিদা বাড়ছে। নিরাপত্তাহীনতা ও আগ্রাসনের ভয়ে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়াচ্ছে বিশ্বের ছোট-বড় প্রায় সব রাষ্ট্র। চলছে জমজমাট অস্ত্র বিক্রির ব্যবসা। আর এর প্রভাব পড়ছে বিশ্ববাসীর ওপর। একদিকে জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি ও মার্কিন ডলারের সংকট হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে সাধারণ মানুষকে।

নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার জটিল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অস্থিরতা দেখা দিয়েছে মুদ্রাবাজারে, বাড়ছে জাতীয় ঋণের মাত্রা এবং অনেক দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। আমদানিনির্ভর দেশগুলোকে আমদানিব্যয় মেটাতে খরচ করতে হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। ফলে বর্তমানে বিশ্বের ৮২টি দেশের প্রায় সাড়ে ৩৪ কোটি মানুষ খাদ্য নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। পৃথিবীব্যাপী মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে বিশ্ববাসীকে। চলমান সশস্ত্র সংঘাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও চোখে পড়ার মতো। এর ফলে চরমভাবে দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব। বাড়ছে দারিদ্র্যের হারও। সেই সঙ্গে বাড়ছে উদ্বাস্তু ও বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা। কোন পথে হাঁটছে বৈশ্বিক অর্থনীতি? বিশ্ব অর্থনীতি কি আবারও ২০০৮ সালের মন্দা কিংবা ১৯৩০ দশকের মহামন্দার মুখোমুখি হতে চলেছে? এমন জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে চলছে মতভেদ। এক কথায় বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনীতির চিত্র যেন জলে কুমির ডাঙায় বাঘ পরিস্থিতি।

অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় বিশ্ব যখন টালমাতাল অবস্থায়, ঠিক সে সময় বিশ্বজুড়ে ঊর্ধ্বমুখী সামরিক ব্যয় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটকে অনেকখানি বাড়িয়ে তুলেছে। ২০২২ সালে বিশ্বের সামরিক ব্যয় সর্বকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড ছুঁয়ে পৌঁছেছে ২ দশমিক ২৪ ট্রিলিয়নে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) ২৪ এপ্রিল বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সামরিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে বরাবরের মতো শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ সালে আমেরিকার সামরিক ব্যয় শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭৭ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের সামরিক ব্যয়ের ৩৯ শতাংশের সমান। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক ব্যয়কারী হিসেবে তার অবস্থান ধরে রেখেছে। ২০২২ সালে এই খাতে চীনের ব্যয়ের পরিমাণ ২৯২ বিলিয়ন ডলার। চীনের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে আঞ্চলিক প্রতিবেশী দেশগুলোতে। জাপান ২০২২ সালে সামরিক খাতে ৪৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। ১৯৬০ সালের পর থেকে এ খাতে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেছে জাপান। একই সঙ্গে তাইওয়ান তাদের ব্যয় বাড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সাউথ কোরিয়া বাড়িয়েছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। অস্ট্রেলিয়ার সামরিক ব্যয় ৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ১৮০ কোটি ডলার।

ইউরোপের দেশগুলোর সামরিক খাতে ব্যয় বেড়েছে ১৩ শতাংশ, যা গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে চলমান রুশ-ইউক্রেন সংঘাত সম্পর্কিত বলে মনে করছেন অনেকে। এর প্রভাব পড়ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ওপর। পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার হুমকির প্রতিক্রিয়ায় নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও আত্মরক্ষার তাগিদে বিগত বছরের তুলনায় সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে। বিশ্ব সামরিক খাতে ব্যয়ের তালিকায় ফিনল্যান্ড ৩৬ শতাংশ, লিথুয়ানিয়া ২৭ শতাংশ, সুইডেন ১২ শতাংশ এবং পোল্যান্ডে ১১ শতাংশ সামরিক ব্যয় বাড়িয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো ন্যাটো জোটে যুক্ত হচ্ছে। ফিনল্যান্ড এপ্রিলে ন্যাটোর ৩১তম সদস্য হয়েছে। বলা হচ্ছে, পাশাপাশি সুইডেনও এখন ন্যাটো জোটে যুক্ত হতে আগ্রহী। এ ছাড়া নেদারল্যান্ডস, স্পেন, ইতালির মতো ইউরোপীয় দেশগুলোও গত দশকে সামরিক খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে।

২০২২ সালে রাশিয়ার সামরিক ব্যয় বাড়িয়েছে ৯ দশমিক ২ শতাংশ (৮৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার), যা বৈশ্বিক সামরিক ব্যয়ের ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। সামরিক ব্যয়ে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ভারত। ২০২২ সালে ভারত এই খাতে ব্যয় করেছে ৭ হাজার ৬৬০ কোটি ডলার, যা সামরিক খাতে বিশ্বের মোট খরচের ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০২২ সালে সামরিক খাতে সৌদি আরবের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ১৬ শতাংশ, যার পরিমাণ ছিল আনুমানিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, সামরিক ব্যয়ের দিক থেকে সৌদি আরব পঞ্চম বৃহত্তম সামরিক ব্যয়কারী দেশ।

২০২২ সালে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সামরিক ব্যয় ছিল ১২৩২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১ সালের তুলনায় শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। বৈশ্বিক সামরিক খাতে ব্যয়ের তালিকায় ৩ দশমিক ১ শতাংশ নিয়ে যুক্তরাজ্যের অবস্থান ষষ্ঠ, যার পরিমাণ ৬৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সামরিক খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে যুক্তরাজ্য। এরপরই মোট ব্যয়ের আড়াই শতাংশ জার্মানির আর ২ দশমিক ৪ শতাংশ ফ্রান্সের। ইউক্রেনে সামরিক ব্যয় ২০২২ সালে ছয় গুণের বেশি বেড়ে হয়েছে ৪৪ বিলিয়ন ডলার, জাতীয় প্রবৃদ্ধির শতকরা হিসাবে সামরিক খাতে খরচ ২০২২ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৩৪ ভাগ। বৈশ্বিক সামরিক ব্যয়ের এই ক্রমাগত বৃদ্ধি প্রমাণ করে আমরা বর্তমানে একটি অনিরাপদ বিশ্বে বসবাস করছি। এতে করে দুর্ভোগ পোহাতে হবে সাধারণ মানুষকে। হুমকির মুখে পড়বে গোটা বিশ্ব।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close