তানজিব রহমান

  ২৬ মে, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তায় আন্তর্জাতিক রীতি

ঢাকায় নিযুক্ত ব্র্রিটেন, আমেরিকা, সৌদি আরব ও ভারতের কূটনীতিকদের জন্য পুলিশের বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহারের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এরপর থেকেই মূলত শুরু হয় চুলচেরা বিশ্লেষণ, যে রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য রীতিনীতি কী? দেশে দেশে বিদেশি কূটনৈতিকদের নিরাপত্তায় কোন দেশ কেমন আচরণ করে। রাষ্ট্রদূতদের বিষয়ে কোনো ঘটনা সামনে এলেই ভিয়েনা কনভেনশনের কথা বলা হয় কারণ ভিয়েনা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী বিশ্বের সব কূটনৈতিক মিশন তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। দেশে দেশে কূটনীতিকদের বিভিন্ন ধরনের সুবিধা, নিরাপত্তা, বাসস্থান, আইন প্রয়োগসহ নানা বিষয় নিশ্চিত করে থাকে স্বাগতিক দেশ। এ লক্ষ্যেই কূটনীতিকদের আচরণ বিষয়ে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় যে চুক্তিটি ১৯৬১ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণে সই করা হয়েছিল সেটি ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপলোম্যাটিক রিলেশন নামে পরিচিত। এই কনভেনশনে ৫৩টি ধারা রয়েছে। সে সময় স্বাধীন দেশগুলো চুক্তিতে সই করেছিল। পরে ধাপে ধাপে যেসব দেশ স্বাধীন হতে থাকে তারাও এই চুক্তিতে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে এই চুক্তিতে সই করে।

বাংলাদেশে কূটনৈতিকদের অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাতিল সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য হচ্ছে, বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং সৌজন্যমূলক আচরণের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের বাড়তি প্রোটকল হিসেবে পুলিশি এসকোর্ট সুবিধা দেওয়া হতো। এসকোর্ট সুবিধা হচ্ছে, রাষ্ট্রদূত বা কূটনীতিকরা যাতে দ্রুত চলাচল করতে পারেন, এজন্য একটি গাড়িতে পাঁচ থেকে আটজন পুলিশের মাধ্যমে রাস্তা ট্রাফিকমুক্ত রাখার বাড়তি সুবিধা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতির মাধ্যমে এই বাড়তি নিরাপত্তা সুবিধা প্রত্যাহার করার সঙ্গে সঙ্গে তাও জানায়, কোনো দূতাবাস এই বাড়তি সুবিধা নিতে চাইলে অর্থের বিনিময়ে নিতে পারবেন, যা আন্তর্জাতিক অনেক দেশে প্রচলিত আছে। অর্থাৎ যে এসকোর্ট সুবিধা বাংলাদেশ বিদেশি কূটনীতিকদের সৌজন্যতার খাতিরে বিনা খরচে দিত তা অন্যান্য দেশে টাকা খরচ করে নিতে হয়।

মূলত বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া হলি আর্টিসান বেকারিতে জঙ্গি হামলার প্রেক্ষাপটেই কূটনীতিকদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সে বিবেচনায় এখন বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে সম্প্রতি সিডনিভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক অ্যান্ড পিস সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ২০২২ সালের সূচক প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশ এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি শান্তিপূর্ণ দেশ; এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও অনেক গুণ ভালো। এই সূচকে আফগানিস্তান ১ম, পাকিস্তান ৬ষ্ঠ, ভারত ১৩তম, যুক্তরাষ্ট্র ৩০তম, যুক্তরাজ্য ৪২তম আর বাংলাদেশ ৪৩তম। বাংলাদেশে ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ীই কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়। এসকোর্ট প্রত্যাহার করা হলেও যদি তারা চান তাদের নিরাপত্তায় আনসারের স্পেশাল ব্যাটালিয়ন তৈরি থাকবে।

প্রশ্ন উঠছে, বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহারের বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না? উত্তর হচ্ছে, না। কারণ বিশ্বের অন্যান্য দেশে এমনটাই প্রচলিত আছে। অর্থাৎ ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী স্বাগতিক দেশ বিদেশি দূতদের যে নিয়মিত নিরপত্তা প্রদান করেন অন্যান্য দেশের মতো তা বাংলাদেশ করে আসছে বহু আগে থেকেই এবং তা বলবৎ আছে। শুধু অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশি সাবেক রাষ্ট্রদূত সোহরাব হেসেন বলেছেন, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, উজবেকিস্তানসহ আরো অন্তত দশটি দেশে তিনি কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ স্বাগতিক দেশ হিসেবে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের যে নিরাপত্তা দেয় তা আর কোথাও তিনি দেখেননি। কখনো কোথাও তিনি বিশেষ এসকোর্ট সুবিধা পাননি, এমনকি পশ্চিমা দেশে গাড়িতে পতাকা ওড়াতেও পারতেন না। তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত বাংলাদেশের দূতাবাসের বাইরে বা রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে কোনো নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরা থাকে না। বাড়তি নিরাপত্তারক্ষী বা গানম্যান থাকা দূরের কথা। গাড়িতে শুধু চালক ও কূটনীতিক থাকেন। কোনো দেশের কূটনীতিক স্বাগতিক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফোন দিয়ে তাদের চলাচলের কথা জানালে পররাষ্ট্র দপ্তর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো বাড়তি নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয় না। তবে টাকার বিনিময়ে নিরাপত্তা প্রোটকল পাওয়া যায়। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে সোহরাব হোসেন বলেন, একবার তিনি ইসলামাবাদ থেকে আরেক শহরে যাওয়ার আগে নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। কিন্তু এজন্য তার কাছে পয়সা দাবি করা হয়। তখন তিনি তা নেননি। বাংলাদেশ ও বিষয়টা এখন এভাবে দেখতে শুরু করেছে। তবে বিশেষ কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে তা নিয়েও বাংলাদেশ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

কূটনীতিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে ভিয়েনা কনভেনশনে কী বলা আছে? ভিয়েনা কনভেনশনের ২০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রদূত তার বাড়িতে, অফিসে, গাড়িতে সেই দেশের পতাকা ওড়াতে পারবেন এবং তাদের মনোগ্রাম বা এমব্লেম ব্যবহার করতে পারবে। এগুলো ব্যবহার করা না করার ব্যাপারে কূটনীতিকরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু এ বিষয়ে গ্রাহক দেশ কোনো বাধা দিতে পারবে না এবং সনদের ৪৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এসব নিরাপত্তা ও সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। তবে বাংলাদেশের সাবেক কূটনৈতিকদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় পতাকা ওড়ানোর ক্ষেত্রে তারা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন যেমন : এশিয়ার দেশগুলোয় তারা গাড়িতে পতাকা ওড়াতে পারলেও, পশ্চিমা দেশে তা পারেননি। কূটনীতিকদের গাড়িতে পতাকা ওড়ানো বন্ধ হচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নেরও স্পষ্ট জবাব দেন পররাষ্ট্র সচিব নিউ ইয়র্ক বা জেনেভায় কখনোই পতাকা ওড়ানোর কোনো পদ্ধতি নেই। অনেক দেশে আছে, রাষ্ট্রীয় যত মিটিং হয় তখন পতাকা উড়িয়ে যাওয়া যায়, যা মিশন প্রধানদের নিজেদের ওপর থাকে। স্বাগতিক দেশকে অবশ্যই সব কূটনৈতিক মিশন ও কূটনীতিকদের সুরক্ষার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের তরফ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিটি দূতাবাস, কূটনীতিকদের বাসভবন এবং ক্লাবে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা অব্যাহত থাকবে সেই সঙ্গে রাষ্ট্রদূতদের পুলিশ প্রদত্ত গানম্যান নিয়োজিত থাকবে। এই সশস্ত্র সদস্যদের বিশেষ পরিস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া আছে। ঢাকায় কূটনৈতিক জোনে ৫৩টি দেশসহ প্রায় ৭২টি আন্তর্জাতিক সংস্থা রয়েছে। প্রতিটি দেশের কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দিতে বিশালসংখ্যক নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন থাকে। সৌদি আরবের ক্লাব, দূতাবাস, বাসভবনসহ কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় ৪৮ জন পুলিশ মোতায়েন আছে। ব্রিটিশ হাইকমিশনের নিরাপত্তায় ২৯ জন দায়িত্ব পালন করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ১৫৮ জন নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছেন। তাদের এসব নিরাপত্তা অব্যাহত থাকবে। শুধু ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে পুলিশের বাড়তি সুবিধা প্রত্যাহার হবে, যা পেতে ‘ফি’ দিতে হবে। কিন্তু বিএনপি নেতারা স্বভাবসুলভ ভাবে এ নিয়েও জল ঘোলা করা বক্তব্য দিচ্ছেন, মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন, যা নিজেদের বা দেশের জন্য কোনো কাজে আসছে বলে মনে হয় না।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close