ফারহান ইশরাক

  ২৬ মে, ২০২৩

বিশ্লেষণ

‘বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু’

‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’- এটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির মূলকথা। যে সিংহপুরুষ হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করে বহুল প্রতীক্ষিত স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিয়েছিলেন, তার পররাষ্ট্রনীতি যে চমকপ্রদ হবে, সেটি বলাই বাহুল্য। ইংরেজ-পরবর্তী ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে সৌহার্দ্যরে অনুপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নিয়মিত বিরোধ লেগেই থাকত। এমনকি তা যুদ্ধের রূপও ধারণ করেছিল একাধিকবার। অন্যদিকে চীন-ভারতের মধ্যেও সম্পর্ক ছিল বেশ শীতল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র ছিল সীমিত। ছিল না কোনো আঞ্চলিক জোট কিংবা সংস্থা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রতিবেশী দেশের প্রতি এক ধরনের সহজাত বৈরী মনোভাব দীর্ঘদিন ধরেই বিরাজমান ছিল। এমনই এক প্রতিকূল কূটনৈতিক পরিবেশে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। তাই নতুন দেশের রাষ্ট্রীয় নীতি, বিশেষ করে কূটনৈতিক গতিপথ ছিল সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশের সীমানার তিন দিকজুড়ে ভারতের মতো বিশাল একটি দেশ। সেই দেশটি-ই আবার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই পররাষ্ট্রবিদ ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা ভেবেছিলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের নীতির প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা হতে দেননি। সদ্য স্বাধীন একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান সবাইকে অবাক করে দিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে ঘোষণা দিলেন, বাংলাদেশ হবে সবার বন্ধু। পৃথিবীর মানচিত্রের নতুন একটি দেশের এমন বার্তা বিশ্ববাসীকে অভিভূত করল, বঙ্গবন্ধুর উদারতা ও সৌহার্দ্যরে সঙ্গে পরিচয় ঘটল সবার। আর তার এই ঘোষণা থেকেই গৃহীত হলো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি।

বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি তার ব্যক্তিজীবন, আদর্শ ও দর্শনেরই নামান্তর। তিনি ছিলেন আগাগোড়া শান্তিকামী একজন মানুষ। বাংলার অসহায়, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য বছরের পর বছর ধরে তিনি আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। ছাত্রাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি ছাত্রত্ব হারিয়েছিলেন। তবুও মানুষের কল্যাণের জন্য, দুঃখ, দুর্দশা লাঘবের জন্য আন্দোলন করতে তিনি পিছপা হননি। আর এর জন্য তাকে ভোগ করতে হয়েছিল অবর্ণনীয় নির্যাতন, জেল, জুলুম ও অত্যাচার। যতবারই শাসকগোষ্ঠী তাকে আঘাত করেছে, ততবারই তিনি সূর্যের মতো আপন মহিমায় জ্বলে উঠেছেন। বঞ্চিত মানুষের জন্য এই ত্যাগ তাকে বাঙালি জাতির প্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত করেছিল। আর সে কারণেই তিনি ‘শেখ মুজিব’ থেকে হয়ে উঠেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’; বাংলার বন্ধু, বাঙালির বন্ধু।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দীর্ঘ কারাবাস শেষে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এসেই শুরু করেন দেশ পুনর্গঠনের কাজ। বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে বহির্বিশ্বের প্রতিটি দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। তাই তিনি দেশে এসেই বিশ্বের সব দেশের কাছে শান্তির বার্তা পাঠিয়ে দিলেন। গণতন্ত্র, জনগণের অধিকার, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে আজীবন লড়াই করে গেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এসেও তিনি বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জীবনভর আন্দোলন ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনের স্বীকৃতি স্বরূপ বিশ্বশান্তি পরিষদ তাকে জুলিও কুরি পদকে ভূষিত করে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মাননা ছিল এই পদক। বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পদকপ্রাপ্তি সে সময় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিল। এই সম্মাননা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। যার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, যারা আগে এ দেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, তারাও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদকপ্রাপ্তি জাতিসংঘসহ বহু আন্তর্জাতিক সংগঠনে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল। বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর এই পদক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের জন্য এক প্রশস্ত দুয়ার খুলে দেয়।

বিশ্বে যে কটি সম্মানজনক পুরস্কার রয়েছে, তার মধ্যে জুলিও কুরি শান্তি পদক অন্যতম। বিশ্বশান্তির সংগ্রামে বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী দম্পতি মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরির অসামান্য অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯৫০ সাল থেকে প্রতি বছর সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায়, মানবতার কল্যাণে ও বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করার সপক্ষে অবদানের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি ও সংগঠনকে এই পদক দেওয়া হয়ে থাকে। বিশ্বশান্তি পরিষদ জুলিও কুরি পদক প্রদান করে। ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর বিশ্বের ১৪০টি দেশের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি পদক’-এ সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বরেণ্য ব্যক্তি, বিশ্ববিখ্যাত নেতা, বিজ্ঞানী, চিকিৎসকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষেত্রের সেরা ব্যক্তিরা এই পদক লাভ করেছেন। তাদের মধ্যে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, ভিয়েতনামের অবিসংবাদিত নেতা হো চি মিন, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্বনন্দিত নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী, কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ট্রো, বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের আপসহীন নেতা দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্টিন লুথার কিং অন্যতম।

জুলিও কুরি পদক বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়। এত দিন তিনি ছিলেন বাংলার আপামর জনগণের প্রাণের নেতা। জুলিও কুরি শান্তি পদক তাকে স্বীকৃতি প্রদান করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার এক অগ্রনায়ক হিসেবে। যার ফলে তিনি পরিচিত হন, ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ছাত্রজনতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। তার ঠিক চার বছর তিন মাস পর ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক প্রদান করে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশ্বশান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে এ পদক হস্তান্তর করার সময় বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’ এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর শান্তিপ্রিয়তার বার্তা পৌঁছে যায় বিশ্বের দরবারে। এ বিরল সম্মাননা বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গৌরবের।

বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদকপ্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে এ বছর। ৫০ বছর পরেও বিশ্বশান্তির প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু সমান প্রাসঙ্গিক। কয়েক মাস আগেই ফিলিস্তিনের নিরীহ জনগণের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায় ইসরায়েল। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা যখন এ হামলার ব্যাপারে নিশ্চুপ, তখন বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদ জানানোর মতো সৎসাহস প্রদর্শন করেন। এটি সহজেই অনুমেয় যে, ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা তার বাবার আদর্শেই এই অবস্থানে এসেছেন। বঙ্গবন্ধু আজীবন ছিলেন শান্তিকামী মানুষের পক্ষে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফিলিস্তিনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু। তার সিদ্ধান্তেই ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন থেকে বিরত থাকে বাংলাদেশ। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে বিভিন্ন সময়ে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহায়তার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়া হলেও বঙ্গবন্ধু তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অনড়। তিনি সব সময়ই ছিলেন মজলুম, নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের পক্ষে; অন্যায়ের বিপক্ষে।

আমাদের বর্তমান পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে যুদ্ধ, সংঘাত, হানাহানির ওপর। বিশ্বের সব মানুষের মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি, বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্য স্থাপনের যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, আজকের পৃথিবীতে সেটিরই প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদকপ্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তির সন্ধিক্ষণে আমরা আশা রাখি, পৃথিবীর সব অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। একটি সুস্থ-সুন্দর পৃথিবীতে বাস করবে সবাই।

লেখক : শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close