হাসি ইকবাল

  ২২ মে, ২০২৩

বিশ্লেষণ

বেড়েই চলেছে শিশুর প্রতি সহিংসতা

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, একই সঙ্গে সমাজের একটি দুর্বল অংশও বটে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিশু নির্যাতন। বাড়ছে শিশুর প্রতি সহিংসতা, অমানবিক বর্বরোচিত ঘটনার মধ্য দিয়ে শিশুকে নির্মম ও বিকৃত মধ্যযুগীয় পন্থায় হত্যা করা হচ্ছে। সম্প্রতি একসঙ্গে চার শিশুকে মেরে লাশ বালুচাপা দেওয়ার ঘটনাটি জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ে একের পর এক শিশুর ওপর নির্মম ও বর্বরোচিত কায়দায় নির্যাতনের পর হত্যা এবং সহিংসতাকে বিশ্লেষকরা দেখছেন সমাজের ভয়াবহ চরিত্রের এক একটি দিক হিসেবে। বলাবাহুল্য, এই নির্মম ঘটনার শিকার দেশের নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশু ও গৃহকর্মী শিশুরাও। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এখনো যেন আমাদের সমাজ সভ্য হয়ে ওঠেনি। শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। রাষ্ট্রের সবস্তরের মানুষকে শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। একটি শিশুর কান্না কি আমাদের মানবাত্মাকে হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি করে না? কতটা নির্মমভাবে শিশু রাজনের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে, ভাবলে সভ্য সমাজে মুখ ঢাকারও জায়গা নেই যেন। অতঃপর শিশু রবিউল এবং সর্বশেষ শিশু রাকিবকে মলদ্বারে কমপ্রেশার মেশিন ঢুকিয়ে পেটে বাতাস ভরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভাবতে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সত্যি কি আমরা মানুষ! এভাবে একের পর এক শিশুহত্যা আমাদের সমাজব্যবস্থার ওপর শুধু নেতিবাচক প্রভাবই নয় বরং ভয়াবহ চরিত্রের একটি দিক হিসেবে দেখছে অভিজ্ঞ মহল।

আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে সরকার এ দায় কোনোভাবে এড়াতে পারে না। মানুষের ভেতরে আজ চাপা ক্ষোপ, নীরব আন্দোলন, কোথাও থিতু হতে পারছে না। তাই হয়তো মানুষ ভেতরে ভেতরে মানসিকভাবে পঙ্গু, অস্থির, দিশাহারা। আর এই অস্থিরতা ও মানসিকভাবে পঙ্গুত্বের কারণে মানুষ আজ সংগঠিত হতে পারছে না। প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলছে। কোথায় যাবে, কোন পথে যাবে বুঝতে পারছে না। এভাবে একের পর এক বিকৃতভাবে শিশুহত্যা সাধারণ মানুষের বিবেককে করেছে স্তব্ধ। সুশীলসমাজের বিবেককে করেছে কলুষিত।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে ১ হাজার ৭৩০টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। তবে কতজন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, তার হিসাব এই মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব মতে, ২০১৩ সালে অন্তত ১০০ জন গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৮ জন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যাদের বয়স ৭-১২ বছরের মধ্যে। শারীরিক নির্যাতনের পর মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। অন্যান্য নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে ৩২ জনের। শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুছ সহিদ মাহমুদের তথ্য মতে, এ বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই- এই সাত মাসে দেশে ১৯১ জন শিশু খুন ও ২৮০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শুধু জুলাই মাসে খুন হয়েছে ৩৭ শিশু এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫০টি। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬-এর প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ২০৯ জন শিশু, ২০১৩ সালে ২১৮ জন শিশু, ২০১৪ সালে ৩৬৬, ২০১৫ সালে ২৯২ জন এবং শুধু ২০১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৭ জন শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে।

২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে শিশু হত্যার খবর প্রায় তিন গুণ প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেছে, ২০২১ সালে ১৮০টি শিশু হত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছে, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১৯টি। তবে এ বছর পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার বেশি। আবার সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯৬টি শিশু মারা গেছে, যা প্রায় গত বছরের চাইতে তিন গুণ ছিল। তবে এ সময় বাল্যবিয়ে ও ধর্ষণের ঘটনার উল্লেখযোগ্যভাবে কম প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) পক্ষ থেকে আটটি জাতীয় সংবাদপত্রের শিশুবিষয়ক খবরে এক তথ্যে জানিয়েছে- যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যা, নির্যাতন, আত্মহত্যা, নিখোঁজ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ২০২১ সালে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪২৬টি। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৯৮টি। অর্থাৎ এক বছরে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর হার বেড়েছে ২৮ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২১ সালে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছিল ৪১ হাজার ৯৫টি শিশু। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩০১টি। আগের বছরের চেয়ে যা প্রায় ৯৪ শতাংশ কম। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মর্যাদা এবং জাতিসংঘ নীতিমালা ও ঘোষণা অনুযায়ী সমণ্ডঅধিকারের স্বীকৃতিই হচ্ছে স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও শান্তির ভিত্তি। জাতিসংঘের সার্বিক ঘোষণা অনুযায়ী, সব শিশুর প্রাপ্য হচ্ছে বিশেষ যত্ন ও সহায়তা। প্রতিটি শিশুকে রক্ষা ও তাদের স্বাভাবিক বিকাশের স্বার্থে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে আরো বলা হয়েছে, প্রতিটি শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার রাষ্ট্রগুলো স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশের শিশুরা এমনিতেই রোগে-শোকে বিভিন্ন অপুষ্টিতে ভুগে মারা যাচ্ছে, তার ওপর এখন শুরু হয়েছে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা নামক নারকীয় কায়দায় শিশু নির্যাতন করে হত্যা করা। প্রতিদিন বহুমাত্রিক যৌন সন্ত্রাসের বলি হচ্ছে অনেক নারী ও শিশু। এর মধ্যে বেশির ভাগই পথশিশু ও শ্রমজীবী শিশু। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও পরিবর্তিত আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা শিশুদের অনেকাংশে অনিরাপদ জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাবা-মা কাজের সন্ধানে বাইরে গেলে তাদের শিশুদের দেখভাল করার মতো কেউ থাকে না। ফলে নিপীড়নকারীরা সুযোগটির সদ্ব্যবহার করে।

বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দেশে শিশু নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড বেড়েই চলছে। যখন পাঁচজন একটি শিশুকে নির্যাতন করে, তখন পাশে দাঁড়ানো আরো পাঁচজন প্রতিবাদ না করে চুপ করে থাকে। যেকোনো অপরাধ দেখে চুপ করে থাকার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা ভুলে যাচ্ছি, এ দায় একা সরকারের নয়। এ দায় পুরো জাতির। আমাদের প্রতিরোধের ইচ্ছা মরে গেছে। বোধের দেয়ালে কালিমা পড়েছে। সাহসে পচন ধরেছে। এ কারণে অপ্রতিরোধ্যভাবে চোখের সামনে ঘটছে ঘটনাগুলো। এই বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে শিশু নির্যাতন আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলবে। পাশাপাশি যারা এসব ঘটাচ্ছে, তাদের খুব একটা জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে অবক্ষয়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাবে দেশ।

সুতরাং আর দেরি নয়, এখনই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। একের পর এক শিশু হত্যার কারণ খতিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে প্রচলিত আইনের সংস্কার করে বিচারব্যবস্থাকে

আরো কঠোর করতে হবে। অপরাধী যেই হোক,

তার বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা চাই না, দেশের ভবিষ্যৎ প্রতিনিয়ত হায়েনার করাল গ্রাসে

অকালে ঝরে যাক। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে এ দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে চলবে না। মানবতাবাদের পৃষ্ঠাতে

অপেক্ষারত আর একটি মৃত্যু দেখার আগেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক : নাট্যকার ও কবি

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close