অলোক আচার্য

  ০২ এপ্রিল, ২০২৩

মতামত

টিউশন ফি নীতিমালা দ্রুত চূড়ান্ত হোক

শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার এবং আমাদের দেশে বহু ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে। বর্তমানে অন্যসব খরচের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপকহারে বেড়েছে শিক্ষা উপকরণের মূল্য। এর সঙ্গে সন্তানের প্রাইভেট, কোচিং ইত্যাদি খরচ সামলাতে একটি সাধারণ পরিবারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেশে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা গ্রহণ করছে। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার প্রসারে, মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আর এই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আছে বলেই প্রচুরসংখ্যক শিক্ষার্থী স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ পরিবেশে লেখাপড়া করতে পারছে। বেসরকারি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ফি, বেতন ইত্যাদি আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।

বছরের শুরুতেই সেশন ফি, বেতন সব মিলিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা পরিশোধ করতে হয়। এটা এক ধরনের বাণিজ্য। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ৩৬ হাজার ৭১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৪ হাজার ৮১৬টি বেসরকারি। এই টাকা পরিশোধ করতে রীতিমতো নাজেহাল হতে হয় নিম্নআয়ের পরিবারের কর্তাদের। এই বাণিজ্য বন্ধে টিউশন ফি নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাসিক বেতন, ভর্তি, সেশন, বোর্ড পরীক্ষার ফরম পূরণসহ মোট ২৬ ধরনের ফি নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বাইরে কোনো খাতে ফি আদায় করতে পারবে না তারা। আদায়কৃত অর্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ তহবিলে জমা রাখতে হবে। মহানগর ও মফস্বলের জন্য আলাদা টিউশন ফির প্রস্তাব রয়েছে। খসড়া নীতিমালায় একটি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য ও অন্যটি নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য টিউশন ফি নির্ধারণের প্রস্তাব আছে। এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে মাসিক বেতন সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে। নবমণ্ডদশম শ্রেণিতে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। আর নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে মাসিক বেতন সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ও নবমণ্ডদশম শ্রেণিতে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকার প্রস্তাব। এ ছাড়া নীতিমালার খসড়ায় স্কুল-কলেজের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা, টিফিন, ম্যাগাজিন, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক উৎসব, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, লাইব্রেরি, পরিচয়পত্র ইত্যাদি খাতে কত টাকা নেওয়া যাবে তারও নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এ ফি সর্বনিম্ন ৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২০০ টাকা। নীতিমালা চূড়ান্ত এবং বাস্তবায়িত হলে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করার যে অভিযোগ তা বন্ধ হবে।

শিক্ষা একটি সেবা এবং এই দৃষ্টিকোণেই তা পরিচালিত হতে হবে। কারণ প্রতি বছর অসংখ্য স্কুল মাধ্যমিক শাখা, কলেজ শাখা নিয়ে গড়ে ওঠে। ভালো মান হলেও খরচের চিন্তায় সেখানে লেখাপড়া করানো কঠিন হয়ে যায় অভিভাবকের জন্য। অথচ বছরের শুরুতেই সেই চাপ নিতে হয়। বছর বছর ফির পরিমাণ যেমন বৃদ্ধি পায় তার সঙ্গে বৃদ্ধি পায় ফির আওতা। নানা ধরনের ফি যোগ হচ্ছে। তবে সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে সমানভাবে ভালো পরিবেশ বজায় রাখতে পারছে তা নয়। আবার দক্ষ শিক্ষকেরও অভাব রয়েছে। কিন্তু শিক্ষা প্রসারের কাজটি ভালোভাবেই করে চলেছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শিক্ষা খাত এগিয়ে নিতে মানসম্মত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কর্মরত রয়েছে লাখ লাখ শিক্ষক। এর সঙ্গে রয়েছে কর্মচারী। শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি দেশের কর্মসংস্থানেরও একটি বড় উৎস এসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করেই বহু পরিবার চলছে। গত দুই বছর করোনার সময় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মরত মানুষগুলোই ছিল সবচেয়ে বেশি দুর্দশায়। শিক্ষার মূল কাজটি তারা নিরলসভাবে করছেন। দেশে অলিগলিতে গড়ে উঠছে কিন্ডারগার্টেন। তাদের সবার শিক্ষা মান যে সমান তা নয়। সব প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি এবং অন্যান্য ফি আদায়ের পরিমাণও সমান নয়। দেশের এসব বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একই সঙ্গে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু রয়েছে। অনেক বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন, পরীক্ষার ফি ও অন্যান্য ফি প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্ন নেওয়া হয়। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি অনেক বেশি। যে ব্যয় বহন করা সাধারণ পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে শিক্ষা দিতে সব অভিভাবকই চায়। এ ক্ষেত্রে নামিদামি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে ভর্তি করান।

কিন্তু ব্যয় বেশি হওয়ায় অনেকের পক্ষেই তা অতিরিক্ত চাপ হয়ে দেখা দেয়। শিক্ষা প্রদান একটি সেবামূলক কাজ হলেও বিষয়টি আজ রীতিমতো বাণিজ্যিক একটা ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা এবং বাণিজ্য পাশাপাশি চলতে পারে না। এখান থেকে শিক্ষাকে বের করে আনতে হবে। শিক্ষা একটি সেবা। এর মধ্যেই শিক্ষাকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। শিক্ষা মূল উদ্দেশ্য অর্জনে ব্রতী হতে হবে। আমাদের দেশে কয়েক বছর আগে থেকেই শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ভালো ফলাফল করার আশ্বাসেই অনেক প্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রী ভর্তি করছে। মূলত মানসম্মত শিক্ষার চেয়ে ভালো ফল করানোই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য তাদের। এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। দেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। একটা প্রতিষ্ঠানের গা-ঘেঁষে আরেকটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেই শুধু একটি বিশাল বিল্ডিং ভাড়া করে গড়ে উঠছে। সেখানেই রয়েছে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শাখাও!

এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটাই লক্ষ ভালো ফল করানো। ভালো ফলের জন্য অভিভাবকদের কাছেও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চাহিদা রয়েছে। তারা যেকোনোভাবে সন্তানকে এখানে পড়াতে চান। ভালো ফলের জন্য রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানেই আবার রয়েছে আলাদা কোচিংয়ের ব্যবস্থা। সেখানেও রয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়। টিউশন ফি, কোচিং ফি এবং অন্যান্য ফি মিলিয়ে মাসে মোটা টাকা গুনতে হয় অভিভাবককে। এখন যারা সেখানে পড়ছে তারা চাপ হলেও ভালো পড়ার জন্য পড়তে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে ইচ্ছামতো ফি আদায় না হয়ে যদি সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই টিউশন ফি দিতে হতো অর্থাৎ এসব ইচ্ছেমতো ফি আদায় বন্ধে বহুদিন থেকেই অভিভাবকদের একটা আশা ছিল। অবশেষে এ বিষয়ে একটি আশার আলো দেখা গেছে। দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের অনিয়মের লাগাম টানতে উদ্যোগী হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে নতুন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

দেশের বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত টিউশন ফি ও অন্যান্য ফি বন্ধে এমন উদ্যোগ অভিভাবকদের জন্য মঙ্গলজনক হবে এবং সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের একটি নীতিমালায় আনা সম্ভব হবে। বিভিন্ন সময় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত বেতনসহ অন্যান্য ফি আদায় বন্ধে নির্দেশনা জারি করে সরকার। কিন্তু তাতে খুব বেশি ফল হয়নি। যেমন চলছিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তেমনই চলছে। এ কারণে শিক্ষা আইনের খসড়াতেও প্রতিষ্ঠানের ফি আদায়ে লাগাম টেনে ধরার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। নতুন নীতিমালায় সব ধরনের শিক্ষাব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। সব ধরনের শিক্ষাব্যয় নির্ধারণ করে দেওয়া হবে এবং লেনদেন করতে হবে ব্যাংকের মাধ্যমে, যা স্বচ্ছতা বজায় রাখবে। মোটকথা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ফি আদায় সব প্রতিষ্ঠানে একই হবে অর্থাৎ নির্ধারিত হারেই নিতে হবে। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মারাত্মক।

শিক্ষা যদি কোনো ইতিবাচক মানসিকতা গড়ে তুলতে না পারে তাহলে ধরে নিতে হবে সেই শিক্ষা শুধু বিষ ঢেলেছে অমৃত নয়। আজ যারা বড় বড় পদে থেকেও বড় বড় চুরি করছে তারাও তো শিক্ষিত। তাহলে এই অন্যায় তারা করছে কীভাবে। এটা সম্ভব হচ্ছে কারণ তারা শিক্ষা অর্জন করলেও তা সার্টিফিকেট অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। আর তাই শিক্ষা বিষয়টা আজ এতটা প্রশ্নবিদ্ধ। বেসরকারি মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ কারণেই অভিভাবকদের একটি অংশের আগ্রহে থাকে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিত্তশালী মানুষের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ আয়ের পরিবারের সন্তানরাও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়া করে শুধু ভালো লেখাপড়া, উন্নত মান এবং ভালো ফলাফলের আশায়। কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি ও অন্যান্য ফি আদায় অনেক বেশি হওয়ায় অভিভাবকদের জন্য মানসিক চাপের কারণ হয়। যদি একটি নিয়মের মধ্যে আসে অর্থাৎ নির্ধারিত ফির আওতায় আসে তখন এই চাপ কমবে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি নীতিমালা দ্রুত চূড়ান্ত করে অভিভাবকদের চাপ কমিয়ে শিক্ষা খাত এগিয়ে নিয়ে সমস্যার সমাধান করতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close