আবদুর রশীদ
মুক্তমত
ইসলামে প্রতারণার কুফল

মানুষের মধ্যে যেমন রয়েছে এক প্রকার হিতাকাক্সক্ষী, তেমনি রয়েছে প্রতারক। মানুষ কখনো খারাপ হয় না। খারাপ থাকে মানুষের গুণাবলিতে। মানুষের ইচ্ছাশক্তি থাকার কারণেই চারিত্রিক গুণাবলিতে ভিন্নতর পরিলক্ষিত হয়। আর ইচ্ছাশক্তি হলো পরীক্ষার কারণ। আল্লাহতায়ালা গাইডলাইন দিয়েছেন মানুষ যেন নিজেদের সংশোধন করতে পারে এবং পরকালীন সাফল্য লাভে সহজ হয়। কিন্তু এক শ্রেণির মানুষ যারা নিজেদের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে রেখেছে। আর জড়িয়ে রাখা শত অপকর্মের মধ্যে প্রতারণা হলো অন্যতম। আল্লাহতায়ালা প্রতারকদের মুনাফিক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। সাধারণত, প্রতারক বা ধোঁকাবাজরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধোঁকা দিয়ে থাকে। যেমন : ইবাদত, পারস্পরিক লেনদেন, কথাবার্তা, আমানত রক্ষা, ছদ্মবেশ ধারণ ইত্যাদি।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয়। আর তিনি তাদের ধোঁকায় ফেলেন। আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন অলসভাবে দাঁড়ায়, তারা লোকদের দেখায় এবং তারা আল্লাহকে কমই স্মরণ করে।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৪২) ওই আয়াতে বিশেষ করে সেই মুনাফিক প্রতারকদের কথা উল্লেখ করেছেন যারা ইবাদত পালনে অলসতা করে, অজুহাত দাঁড় করিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নেয় এবং ভালো সাজার চেষ্টা করে। কিন্তু সেসব প্রতারক প্রকৃতপক্ষে অন্যদের ক্ষতির চেয়ে নিজেদেরই বেশি ক্ষতির দিকে ধাবিত করে। বাহ্যিকতায় যতই ভালো ফলাফল তারা উপভোগ করুক না কেন সবটুকু বিফলে যায় নিজেদের অজান্তে। এ জন্য আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা আল্লাহকে এবং যারা ইমান এনেছে তাদের ধোঁকা দিচ্ছে। অথচ তারা নিজদেরই ধোঁকা দিচ্ছে এবং তারা তা অনুধাবন করে না।’ (সুরা বাকারাহ, আয়াত : ৯)
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রতারণার শিকার সাধারণ লোক। বিশেষ করে, অনলাইন সাইটে এর মাত্রা আরো অত্যধিক। মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করার লক্ষ্যে নিত্যনৈমিত্তিক নতুন কিছুর উদ্ভাবন হয়ে চলছে। এর মধ্যে অনলাইন শফিং সাইট, বিকাশ সেবার মতো নানা সাইট, এজেন্সি ট্রাভেল সাইট ইত্যাদি। শফিং সাইটে প্রয়োজনীয় পণ্য অর্ডার করলে ডুপলিকেট পণ্য দেওয়া, বিকাশ সেবার মতো বিভিন্ন সেবার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে প্রতারণা করা, ব্যবসায়িক পণ্য লেনদেনের ক্ষেত্রে ওজনে কম দেওয়া, সম্পত্তি বণ্টনে গরমিল করা ইত্যাদি। এ ছাড়া বিভিন্ন গেমিং সাইট ও অ্যাপসের মাধ্যমেও প্রতারণা করা হয়। এক কথায় প্রতারণার কোনো শেষ নেই। অথচ যাবতীয় প্রতারণামূলক কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ২৯) অন্য আয়াতে বলেন, ‘সুতরাং, তোমরা পরিমাণে ও ওজনে পরিপূর্ণ দাও এবং মানুষকে তাদের পণ্যে কম দেবে না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৮৫) আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘হে রাসুলরা! পাক-পবিত্র হালাল রুজি খাও এবং নেক আমল করো।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৫১)
যারা প্রতারণা করে মানুষের সঙ্গে এবং কষ্ট দেয় তারা কখনো মুমিন হতে পারে না। মুমিন কখনো ধোঁকা দেয় না। প্রতারণার ফলে কতজনের অশ্রু নীরবে ঝরে পড়ে, প্রতারিত হওয়া জিনিস নিয়ে হয়তো কত আশা ও স্মৃতি জড়িয়ে থাকে, হয়তো কোনো স্বপ্নপূরণেও মানুষ পারস্পরিক লেনদেন ও বাণিজ্যের কাজে লিপ্ত থাকে। কিন্তু তা অশ্রুর কারণ হয়ে যায় যখন তা কোনো প্রতারণার শিকার হয়। এ জন্য মহানবী (সা.) কঠোর ভাষায় বলেছেন, ‘যে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর : ১৬৪)
রাসুল (সা.) বলেছেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি- ১. যখন কথা বলে মিথ্যা বলে। ২. আমানত রাখলে খেয়ানত করে এবং ৩. প্রতিশ্রুতি দিলে তা ভঙ্গ করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর : ২৫৬২) আর মুনাফিকের এই আলামতগুলো প্রতারকের মধ্যে পুরোপুরি বিদ্যমান। তাই, প্রতারণা ও ঠকানোর মাধ্যমে যারা অন্যের সম্পদ ও অর্থ আত্মসাতে নিজেদের উদর ভর্তি করে তারা শুধু হারাম খেয়ে থাকে। আর যারা হারাম খায় তাদের ব্যাপারে রাসুল (সা.) স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘হারাম খাদ্য দিয়ে প্রতিপালিত দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (শুয়াবুল ইমান, হাদিস নম্বর : ৫৭৫৯) হাদিসে এসেছে, ‘কেয়ামতের দিন বান্দার পা দুখানি সরবে না। (অর্থাৎ আল্লাহর সামনে থেকে যাওয়ার তাকে অনুমতি দেওয়া হবে না) যতক্ষণ না তাকে প্রশ্ন করা হবে; তার আয়ু সম্পর্কে, সে তা কীসে ক্ষয় করেছে? তার বিদ্যা সম্পর্কে, সে তাতে কী আমল করেছে? তার মাল সম্পর্কে, কী উপায়ে তা উপার্জন করেছে এবং তা কোন পথে ব্যয় করেছে? আর তার দেহ সম্পর্কে, কোন কাজে সে তা ক্ষয় করেছে?’ (জামে তিরমিজি, হাদিস নম্বর : ২৪১৭) সুতরাং, প্রতারণা করে অর্জন করা অর্থ-সম্পদ জবাবদিহি ছাড়া আল্লাহর কাছে থেকে পার পাবে না। অবশ্যই তাদের জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ঘিরে ফেলবে। আর তাদের কোনো সাহায্যকারী বলতে কেউ পাশে থাকবে না।
অতএব, আমাদের মাঝে যারা এমনটি আচরণের প্রতি একটু দুর্বল তারা যেন খুব দ্রুত নিজেদের সংশোধন করে ফেলি। আল্লাহর আজাবকে একটু স্মরণ করি। মৃত্যু যে সন্নিকটে সেটার প্রতি একটু মনোনিবেশ করি। মনে রাখবেন, আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তার কাছে সব সময় তওবার দরজা উন্মুক্ত। তওবা করে ফিরে আসা প্রকৃত মুমিনের গুণাবলি। আল্লাহতায়ালা সবাইকে সঠিক বোঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
সদস্য, বাংলাদেশ নবীন লেখক ফোরাম
"