ড. আবদুল আলীম তালুকদার

  ৩১ মার্চ, ২০২৩

ধর্মচিন্তা

সাহরি খাওয়ার উপকারিতা

‘সাহরি’ শব্দটি আরবি ‘সাহর’ বা ‘সুহুর’ শব্দ থেকে উৎকলিত। যার অর্থ রাতের শেষাংশ। আবার সাহরি উর্দু ভাষাতেও ব্যবহৃত হওয়া একটি শব্দ, যা পরে বাংলা ভাষাতেও প্রচলিত হয়ে গেছে। এর শাব্দিক অর্থ ঘুম থেকে জেগে ওঠা, নিদ্রাভঙ্গ, রাত্রি জাগরণ ইত্যাদি। মুসলমানরা আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের আশায় রোজা রাখার উদ্দেশ্যে রাতের শেষ অংশের নির্দিষ্ট সময়ে পানাহার এবং খাবার গ্রহণ করে থাকেন আর এই খাবার গ্রহণ এবং পানাহার পর্বই হলো সাহরি। এক কথায় রোজার উদ্দেশ্যে ভোর রাতের খাবারকে আরবিতে সুহুর বা সাহর বলা হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে রোজার নিয়তে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নাম রোজা। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমাদের ও আহলে কিতাবের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া। (সহিহ মুসলিম : ১০৯৬)

সাহরি খাওয়ার সময়সীমা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা পানাহার করো, যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্ররেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রাত পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করো। (সুরা আল বাকারা : ১৮৭)

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, সাহরি খাওয়ার মাধ্যমে দিনের রোজা পূর্ণ করার জন্য সাহায্য নাও এবং দুপুরে ঘুমের মাধ্যমে রাতের নামাজের জন্য সাহায্য নাও।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৬৯৩)

সারা দিন রোজার উদ্দেশ্যে উপবাস থাকার জন্য শেষ রাতে পানাহার জরুরি। এতে করে পানাহার থেকে বিরত থাকার পরিমাণের মাত্রা হ্রাস করা হয়। শেষ রাতে না খেয়ে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানের কারণে শরীর অত্যধিক দুর্বল হয়ে পড়বে। রোজার মাধ্যমে মানুষকে এত বেশি দুর্বল করা আল্লাহর উদ্দেশ্য নয়। এ কারণেই আল্লাহতায়ালা দিনে আহার-পানাহার নিষিদ্ধ করেছেন। তাই রাতে প্রয়োজনীয় খাবার খাওয়া খুবই যুক্তিসংগত। সাহরি গ্রহণ করা সুন্নত। রাসুল (সা.) শেষ রাতে পানাহার করতেন এবং সুবহে সাদিক থেকে রোজা রাখতেন। সাহরি খাওয়ার মধ্যে যথেষ্ট সওয়াব, কল্যাণ ও বরকত রয়েছে। (সহিহ মুসলিম : ২৬০৩)

সাহরি খাওয়াতে বরকত থাকার বিষয়টি অতি সুস্পষ্ট। কারণ এতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নতের অনুসরণ করা হয় এবং সাহরি খাওয়াতে রোজাদার সারা দিন শক্তিশালী থাকে। রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর সুন্নাত হলো ফজরের কিছু পূর্বে সাহরি খাওয়া অর্থাৎ দেরিতে খাওয়া। রাসুলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, শেষ রাতের খাদ্যগ্রহণ করো তাতে বরকত রয়েছে। (বুখারি ও মুসলিম)

হালাল হওয়ার শর্তে সাহরি খাওয়ার কোনো হিসাব নেই। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী করিম (সা.) বলেছেন, তিন ব্যক্তির খাবার গ্রহণের কোনো হিসাব হবে না, শর্ত হলো খাবার হালাল হতে হবে। ব্যক্তি তিনজন হলেন ১. রোজাদার, ২. সাহরি গ্রহণকারী ও ৩. মুজাহিদ। (তাবরানি শরিফ, আল মু’জামুল কাবির : ১২০১২)

সাহরি খাওয়া ফরজবা ওয়াজিব নয় বরং সুন্নত (সুন্নতে মুয়াক্কাদা)। কোনো কারণে সাহরি খেতে না পারলে সিয়াম পালনে কোনো ধরনের অসুবিধা বা আপত্তি নেই। কেউ যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে সাহরি খাওয়া থেকে বিরত থাকে তবু সে রোজার নিয়ত করে তা পালন করতে পারেন। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে সাহরি না খাওয়া অনুচিত।

তাই তো মহানবী (সা.) বলেন, আমাদের ও ইহুদি-নাসারাদের রোজার পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া। (সহিহ মুসলিম : ২৬০৪) নবী করিম (সা.) সব সময় রোজা পালনের উদ্দেশ্যে সাহরি খেতেন। সেই সঙ্গে তিনি তার প্রিয় উম্মতকেও সাহরি খেতে উৎসাহিত করেছেন।

সাহরি খাওয়ার মধ্যে অফুরন্ত রহমত, বরকত, নিয়ামত ও কল্যাণ আছে। সাহরি খাওয়ার মাধ্যমে রোজা রাখার শক্তি অর্জিত হয়। সাহরি খেলে রোজাদার সহজে দুর্বল ও মনোবলহীন হয়ে পড়েন না, সারা দিন দীর্ঘ সময়ের উপবাস বা অনাহারে থাকলেও কর্মঠ থাকার প্রাণশক্তি আসে এবং সিয়াম পালন সহ্যসীমার মধ্যে থাকে। রমজান মাসে রোজাদার ব্যক্তি যদি নিয়মিত সাহরি না খান, তাহলে অত্যন্ত ক্লান্ত-শ্রান্ত-অবসন্ন হয়ে পড়বেন। ফলে পরের দিন রোজা রাখার সাহস হারিয়ে ফেলবেন এবং কাহিল হয়ে পড়তে পারেন। দৈনন্দিন ইবাদতেও অলসতা কাজ করতে পারে। অতিরিক্ত ক্ষুধায় কর্মশক্তি লোপ পাবে। পক্ষান্তরে ওই রোজাদার ব্যক্তি যদি শেষরাতে পরিমাণমতো সাহরি খেয়ে পুরো দিন না খেয়ে থাকার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন, তবে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে মজবুত থাকেন এবং অতিশয় ক্ষুধায় তেমন কষ্ট পাবেন না। এখানে সাহরি খাওয়ার গুরুত্ব ও উপকারিতা খুঁজে পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহরি ও ইফতারের সীমা নির্ধারণ করে উম্মতের জন্য রোজা পালন সহজ করে দিয়েছেন।

রমজান মাসে সাহরি যথাসম্ভব দেরি করে খাওয়া ভালো। তবে সুবহে সাদিকের আগে রাতের শেষভাগে সাহরি খাওয়া মুস্তাহাব বা পছন্দনীয়। তবে যদি নিদ্রা বা অন্য কোনো কারণে কেউ সাহরি খেতে না পারেন এমতাবস্থায়ও রোজা রাখা দুরস্ত আছে। এতে তার রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। সাহরি না খাওয়ার কারণে রোজা ছেড়ে দেওয়া অত্যন্ত গুনাহের কাজ। যতক্ষণ পর্যন্ত সুবহে সাদিক না হয় অর্থাৎ পূর্বদিগন্তে সাদা বর্ণ না দেখা যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত সাহরি খাওয়া দুরস্ত আছে। সাহরি খাওয়ার সময়সীমা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে কারিমায় আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা পানাহার করো, যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্ররেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রাত পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৭)

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close