তানজিব রহমান

  ৩০ মার্চ, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

মানবাধিকার এখন মার্কিন রাজনৈতিক নাটাই

আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক লি কুয়ানের একটা কথা দিয়ে শুরু করছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, আমেরিকার ভয়াবহ মাদক সমস্যা আছে। যার সমাধানে সে সারা দুনিয়ায় মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর কাছে যাচ্ছে এবং জোগান বন্ধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সিঙ্গাপুরের সেই সুযোগ নেই। আমরা যা করতে পারি তা হলো একটি আইন পাস করা। যাতে বলা হচ্ছে, যেকোনো কাস্টমস কিংবা পুলিশ কর্মকর্তা সিঙ্গাপুরে কাউকে সন্দেহজনক আচরণ করতে দেখলে, তারা ওই ব্যক্তির প্রস্রাব পরীক্ষা করাবে। যদি মাদকের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই তার চিকিৎসাব্যবস্থা করা হবে। আমেরিকায় আপনি এটা করলে তার অর্থ দাঁড়াবে আপনি ব্যক্তি অধিকারে হস্তক্ষেপ করছেন এবং আপনার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। আমেরিকা ও সিঙ্গাপুরের বাস্তবতা বোঝাতে তিনি এমন মন্তব্য করেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর প্রতি বছরের মতো এবারও বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২১ মার্চ প্রকাশিত ‘২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’ শীর্ষক বার্ষিক এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা, মিডিয়ায় সেল্ফসেন্সরশিপসহ, ২০১৮ সালের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি কিংবা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বিষয়ে এ প্রতিবেদনে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে রিপোর্টটি তৈরি করা হয়। প্রতি বছর মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের এ প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করে বার্ষিক রিপোর্টের ভিত্তিতে। এ বছরও তারা তাই করেছে তবে বাংলাদেশের বিষয়ে এ রিপোর্ট প্রকাশের পর পেশাদার কূটনীতিকসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ রিপোর্টকে অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন। কারণ বার্ষিক প্রতিবেদনে চার বছর আগের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করাটা সন্দেহের উদ্রেক ঘটায় এবং রিপোর্টের কথাগুলো হুবহু বিরোধীদের মুখের কথা বলে মনে করছেন তারা। আর বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন এই প্রতিবেদনকে ‘অযৌক্তিক’ বলে উল্লেখ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ত্রুটিমুক্ত নয় উল্লেখ করে ওবায়েদুল কাদের বলেন, ‘কীভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজ দেশের নির্বাচনের বিরুদ্ধে ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গা বাঁধিয়েছেন, কটি প্রাণ ঝরে গেছে সেই ইতিহাস আমরা ভুলিনি। আমরা তো বলছি না আমরা পারফেক্ট। আমরা ত্রুটিমুক্ত করছি। ক্রমান্বয়ে আমরা রিফর্ম করছি। নির্বাচন কমিশনে এর আগে কখনো আইন ছিল না। সেই নির্বাচন কমিশনকে শেখ হাসিনা আইন করে স্বাধীনতা দিয়েছেন।’

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ে প্রতিবেদনে যে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে, সেটাকে ‘খুবই দুঃখজনক’ বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানান, ‘একজন প্রধানমন্ত্রীর যেটুকু ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই আছে। এটা ডিগ্রি অব অ্যাপ্লিকেশন বা অন্য কিছু নিয়ে একটা বন্ধুরাষ্ট্রের উদ্বেগ প্রকাশ করার বা সংশয় প্রকাশ করার বা প্রশ্ন উত্থাপন করার কোনো নৈতিক অধিকারই নেই; প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রীর পদ ও তার দপ্তরকে খাটো করা হয়েছে।’ ‘একটি বন্ধুরাষ্ট্র নিয়ে রিপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে। আমরা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বলে থাকি, এ ধরনের রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার আগে আমরা যাতে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারি। বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় এবং বরাবরের মতো এবারও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। আমি মনে করি, এটি একটি বড় ধরনের দুর্বলতা।’

বাস্তবতা হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের সরকার ব্যবস্থা চালু আছে। যুক্তরাজ্যে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা চালু আছে। এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ইত্যাদির আলোকে একটা শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে। আমরা যেহেতু ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থা অনুসরণ করি, সেহেতু আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থায় তো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা থাকবেই। ব্রিটেনে এটাকে ‘প্রাইম মিনিস্ট্রি সিস্টেম’ বলা হয়। অর্থাৎ প্রাইম মিনিস্টারকে কেন্দ্র করে সরকার আবর্তিত হয়। বিট্রিশ কলোনির শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিক হিসেবে বা ঐতিহ্য হিসেবে আমরা সেটাই অনুসরণ করি। সুতরাং মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ বা নৈতিক অধিকার নেই। কূটনীতির সম্পর্কের জায়গায় অন্য একটি দেশ আমাদের কোনো ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের মতামত দিতে পারে কিন্তু আমাদের শাসনতন্ত্র নিয়ে কথা বলার অধিকার রাখে না। কারণ শাসনতন্ত্র কীঢভাবে চলবে সেটি ঠিক করবে এ দেশের জনগণ। আমাদের শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, লাখো শহীদের রক্তে। কাজেই এই শাসনব্যবস্থা নিয়ে কারো কথা বলার অধিকার নেই। এটা নিয়ে কথা বলার অধিকার রাখে এ দেশের জনগণ। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে দেশে কী ধরনের শাসনতন্ত্র কায়েম হবে। কার ক্ষমতা কী হবে।

জর্জ বুশ কিংবা টনি ব্লেয়ার পশ্চিমা দেশের একজন রাষ্ট্রপ্রধান যখন অন্য দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন হাজার হাজার সামরিক বেসামরিক নাগরিক হত্যা করতে পারেন, তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার-বিষয়ক উদ্বেগ বা ক্ষমতার ভারসাম্য প্রশ্নে কখনো চোখ কপালে উঠতে আমরা দেখি না। তখনই তা প্রশ্ন তৈরি করে মানবাধিকারকে কেন তারা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। মানবাধিকার এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতের রাজনৈতিক নাটাই তারা যাকে খুশি যেভাবে খুশি সেভাবেই এ অজুহাতে ঘোরাতে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যখন মার্কিন নীতির কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, তখন তারা কথা বলেন না কেন? ইসরায়েল-ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইয়েমেন যুদ্ধের ব্যাপারেও তারা নিজেদের ঘারে দায় নিতে চান না। কারণ এতে করে নিজেদের আগ্রাসননীতি থমকে যাবে। তেলের বাণিজ্য ভাটা পড়বে, অস্ত্র ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। নিজ দেশে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের হত্যার পর ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস আন্দোলন পৃথিবীর সবাইকে হতবাক করেছিল। কদিন আগে মার্কিন পুলিশ বাংলাদেশি যুবক ফয়সালকে হত্যা করেছিল নির্মমভাবে। তখন মানবতার কান্না মার্কিন স্টেস ডিপার্টমেন্টের কর্ন কুহরে পৌঁছায়নি।

মানবাধিকার নিয়ে পশ্চিমাদের রাজনৈতিক কূটচাল নতুন নয়। আমরা আমাদের ভাগ্য গড়ব কী তা নিয়ে আমাদের কেউ ভাবতে হবে আপাতত পশ্চিমাদের রাজনৈতিক মানবাধিকার ফাঁদে আমাদের পা না দিলেও চলবে। যেমনটা করেছিলেন লি কুয়ান তিনি জেলে পল্লী থেকে আধুনিক সিঙ্গাপুর তৈরিতে প্রায় চল্লিশ বছর টানা কাজ করেছিলেন তাকেও শুনতে হয়েছিল গণতন্ত্রের সবক। প্রশ্ন উঠেছিল মানবাধিকারের। বিরোধী দল নেই, সরকার সমর্থক সীমিত মিডিয়া চারটি। বিশ্ব সমালোচনাকে তিনি পাত্তা দিতেন না। লি কুয়ান বলতেন, ‘পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র দিয়ে আমার কাজ হবে না। আমাকে চলতে হবে আমার মতো করে।’ যেমন : কথা তেমন কাজ। তিনি শৃঙ্খলার প্রশ্নে কঠোর ছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতেন। সুশাসনও প্রতিষ্ঠা করেন। আইন ভঙ্গ করলে জরিমানা, বেত্রাঘাত সবই আছে এখনো। আইনের প্রতি কঠোর ছিলেন। উন্নয়নে সারা বিশ্বের মেধাবীদের মিলনমেলা বানালেন সিঙ্গাপুরকে। একই কাজ করেও এশিয়াতে চমক দেখিয়েছিলেন মাহাথির বিন মোহাম্মদ টানা ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। মাহাথির বদলে দিলেন মালয়েশিয়াকে। এখানেও পশ্চিমাদের মাথাব্যথার অন্ত ছিল না তাতে কি! মালয়েশিয়া তো আজ বিশ্বের রোল মডেল। একইভাবে শেখ হাসিনার উন্নয়নের গণতন্ত্র হয়তো অনেকেরই সহ্যসীমা অতিক্রম করার উপক্রম হয়েছে, তাই মানবাধিকারসহ অন্যান্য ইস্যুকে সামনে এনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের নতুন নতুন দৃশ্যপট তৈরির ব্যর্থ চেষ্টা চলছে। জাতির পিতার খুনিদের যারা আশ্রয়দাতা তাদের মুখে মানবাধিকারের কথা বেমানান। তারা শুধু রাজনৈতিক নাটাই ঘোরাতে পারবে ঘুড়ির রং বদলাতে চেষ্ট করতে পারবে তাতে এগিয়ে চলা এশিয়ান টাইগারকে কেউ থামাতে পারবে না।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close