মিশন রায়

  ২৯ মার্চ, ২০২৩

মুক্তমত

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গুরুত্ব

বাংলাদেশ দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার একটি দেশ। সাম্প্রতিক সময়ে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক, পরিবেশ, অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। যদি আমরা সুয়েজ খালের কথা কল্পনা করি, অসংখ্য জাহাজ বিভিন্ন কারণে সুয়েজ খাল দিয়ে বের হয়ে বঙ্গোপসাগর তারপর মালাক্কা প্রণালি দিয়ে দক্ষিণ চীন সাগর হয়ে জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া বা রাশিয়ার বন্দরে যাতায়াত করে।

প্রথমত, যেসব দেশ এই রুট দিয়ে বাণিজ্য করে তাদের ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা খুবই জরুরি। দ্বিতীয়ত, ভারত কখনো চাইবে না ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে চায়না তার উপস্থিতি নিশ্চিত করুক। কারণ চীন এ অঞ্চলে ঢুকতে পারলে ভারতের জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। যদি বঙ্গোপসাগরে ভারত ও চীন প্রতিপত্তি বিরাজ করতে চায় তাহলে বাংলাদেশকে অবশ্যই লাগবে। তা ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক বলয়কে কেন্দ্র করে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে রুখতে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটিজি (আইপিএস) ও কোয়াডের (ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে) মতো সামরিক নিরাপত্তাবিষয়ক জোট গঠন করেছে। সে হিসেবে ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশকে দলে বেড়াতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সাম্প্রতিক তাইওয়ান ইস্যুতে চীনের উত্তেজনার পটভূমিতেই চীন এক দেশ এক নীতির পক্ষে বাংলাদেশকে পাশে চায়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশকে নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কূটনৈতিক তৎপরতা দেখতে পাই। আগামী ২০-২৫ বছর পরে ১০০ ট্রিলিয়ন ডলারের যে ইকোনমি তার চেয়েও বেশি মূলত বাংলাদেশকে ঘিরেই আগামী ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্র পরিচালিত হবে। এটি খুবই ইতিবাচক বাংলাদেশের জন্য।

আবার একে ঘিরে প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে গেছে। এই প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবচেয়ে বড় প্রেক্ষাপট। আর দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে ভারত ও চীনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হচ্ছে। এদিকে চায়না দক্ষিণ-চীন সাগরে বেশির ভাগ অংশ নিজেদের বলে দাবি করে। আর এই এরিয়ায় চায়নাকে ঠেকানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তারই ফলে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে সম্প্রতি আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি মারাত্মকভবে লক্ষ করছি। এই দুই স্তরের প্রতিযোগিতায় আমরা কীভাবে কাজ করব। আমরা ভারত ও চীন থেকে আমদানি করি। আবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে রপ্তানি করি। কাজেই কাউকে ছাড়া আমাদের চলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ যে ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ তা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। আমাদের তিন দিকে ভারত। কাজেই আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রশ্ন ছাড়াও শিলিগুড়ি করিডর (চিকেন নেক নামে পরিচিত), যা ভারতের সেভেন সিস্টার্সে প্রবেশের একমাত্র রাস্তা। এজন্যই বাংলাদেশকে ভারতের খুবই প্রয়োজন।

একইভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ঠেকাতে বাংলাদেশকে চীনেরও খুবই প্রয়োজন। অন্যদিকে কোয়াডের মতো সামরিক জোটে ঢাকাকে দেখতে চায় না চীন। এশিয়ান হাইওয়ের গেটওয়ে হবে বাংলাদেশ, যদি এর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ৩টি রাস্তা হবে। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে যে দেশ সুসম্পর্ক বজায় রাখবে সে দেশ বাণিজ্যিক দিক দিয়ে উপকৃত হবে। যদি বঙ্গোপসাগরে ভারত ও চীন প্রতিপত্তি বিরাজ করতে চায় তাহলে বাংলাদেশকে অবশ্যই লাগবে। এ ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্যে বাংলাদেশের কোনো সামরিক জোটে প্রবেশ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের স্বার্থরক্ষা করেই নীতিনির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, তা আগামী ২০ বছরে বৈশ্বিক রাজনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এ ক্ষেত্রে আমরা রোহিঙ্গা ইস্যুটি কাজে লাগাতে পারি। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে এরই মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ১০০০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নাগরিকের তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে জান্তা সরকারের হাতে এবং যাচাই-বাছাই ও দ্রুত সময়ে হচ্ছে। এই রোহিঙ্গা সমস্যাসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফ্ল্যাটফরমে বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর জোরালো করতে শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সহাবস্থান বজায় রাখার ওপরই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বঙ্গোপসাগরের পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশ, যা ভূ-রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কথা মাথায় রেখে আমাদের দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা ছাড়া আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গভীরতাও থাকা দরকার। এই জায়গায় যদি আমাদের দুর্বলতা থাকে তাহলে বাইরে যতই পরিবর্তন হোক আমরা বেশি ভূমিকা পালন করতে পারব না। কার্যকর সিদ্ধান্ত না নিয়ে যদি আমরা প্রতিক্রিয়াশীল হই তাহলে আমাদের কোনো সমস্যাই সমাধান হবে না। তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চায়নাকে পাশে চায় বাংলাদেশ। কিন্তু চায়নার এসব অবকাঠামোগত উন্নয়ন (ভারতসংলগ্ন) এ নিয়ে ভারত খুবই উদ্বিগ্ন। অথচ ভারত এই তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের মধ্যে চোর-পুলিশ খেলা খেলছে। অন্যদিকে মিয়ানমারের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী আমাদের সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। ফলে আমাদের ভূখণ্ডে পর্যন্ত মর্টার শেল আঘাত করেছে। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বকে মাথায় রেখে আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রশ্ন ও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি বৈশ্বিক প্রক্ষাপটে আমাদের যে পররাষ্ট্রনীতি (সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়) এই নীতি মাথায় রেখেই আমাদের সঠিক ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close