এম খান

  ২৬ মার্চ, ২০২৩

মুক্তমত

দেশপ্রেমিক শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা

মুক্তিযুদ্ধের দামামা না দেখলেও এমন এক পরিবারে জন্ম, যার দরুন নানা অনুভূতি সামনে ভেসে ওঠে বারবার। উনসত্তরের (গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে) নভেম্বরে তার জন্ম। গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার মোক্তারপুর ইউনিয়নে। ভূপৃষ্ঠে আবির্ভাবের পর বেশ ক-বছর ঢাকা জেলার নাগরিকত্ব থাকলেও পরে নরসিংদী মহকুমা এবং বর্তমানে গাজীপুর জেলা। গ্রামটি রাজধানী থেকে নিকটবর্তী হলেও যোগাযোগব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলের প্রথম দিকে সরকারের কোনো জরুরি পরিষেবায় তদন্তকারী টিম ঢাকা বা গাজীপুর থেকে একবার এ গাঁয়ে এলে দ্বিতীয়বার চরম অনাগ্রহ প্রদর্শন করত। দুস্তর পথঘাট হলেও, শুধু স্থানীয়দের কাছে গ্রামটির অবস্থান দৃশ্যত শান্ত নদী ও পথঘাটের দুধার ঘন পল্লববেষ্টিত চির সবুজের সমারোহ। শীতলক্ষ্যার হিমশীতল অববাহিকার বিশুদ্ধ পরশ, যা শরীরের ক্লান্তি নিবারণের এক অতুলনীয় ফ্যাক্টরি। তদুপরি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বয়োবৃদ্ধি ও বোধবুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার রক্তের শিরায় শিরায় মিশে আছে।

তার বড় মামা (আরমান মিয়া) ও জেঠাতো ভাই (হাসান আলী) ১৯৬৬ সালে উভয়েই এসএসসি পাস করে। দুজনেই ১৯৬৭ সালে ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) বাহিনীতে যোগ দেন। আরমান মিয়া ও হাসান আলী আত্মীয়ের দিক দিয়ে মামা-ভাগিনা হলেও তারা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুও। বাংলার ভূমি তখন ২৫ মার্চ কালরাতে পাক-হানাদারদের তর্জনগর্জন ও আতর্কিত আক্রমণে আক্রান্ত, তখন দেশমাতৃকার মহাশঙ্ক সমাসন্ন দেখে নিজেরা স্বেচ্ছায় সকাতরে, সদর্পে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পিলখানা থেকে গ্রামে ফিরে এসে পরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও প্রশিক্ষণের অংশীজন হিসেবে আত্মনিয়োজিত করেন। তারা দুজনেই প্রথমে গ্রামে আসেন, পরে আরমান মিয়া নাটোর ও হাসান আলী সিলেট অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। প্রিয় দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু ত্যাগেও দ্বিধা করেননি।

শহীদ হন দুজনই- তারা অমর, সব শহীদের প্রতি স্যালুট। দেশপ্রেমিক এসব সূর্যসন্তান এক দেহাবরণে কত দিন ছিল, অনাহারে-অর্ধাহারে কত দিবানিশি কাটিয়েছিল, বিরতিহীনভাবে একটানা কত ঘণ্টা যুদ্ধ চালিয়েছিল, এসব প্রশ্নোত্তর আজও অজ্ঞাত কারণে অজানা। তাদের আত্মত্যাগের কথা তৎকালীন একাধিক জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত খবরে তাদের নাম এসেছে। তার নানা ভাই ছিলেন সে সময়ের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য। সমাজ ও সংসারে তার অবদান অপরিসীম। খবরের বিশেষ তথ্যাবলি তিনি পরিবারের সদস্যদের মাঝে প্রেসরিলিজ করতেন।

এপ্রিল/১৯৭১ সালে কোনো এক দিন তার মামার পেছনে সারিবদ্ধভাবে মা, বড় খালা, ছোট খালা, ছোট মামা, নানা-নানিসহ গ্রামের অন্যান্য প্রতিবেশী শুভাকাক্সক্ষীর পদচারণার মধ্য দিয়ে নিস্তব্ধ হয় মামার জীবনের বিদায়ের শেষ যাত্রা। শুভাকাক্সক্ষীদের শেষ গন্তব্য সেগুনতলার লঞ্চঘাট। আরমান মিয়ার গন্তব্য সবাই জ্ঞাত কর্মস্থল; বস্তুত অনন্তপুর। সেগুনতলা স্টেশন ত্যাগের পর দীর্ঘ পদচারণার অংশীজনদের নিস্তব্ধতা শেষ বিদায়ের জানান দিলেও বোঝার জ্ঞান ছিল না কারোরই। সেদিনই তাকে কোল আরোহণ করে সেগুনতলা লঞ্চঘাট পর্যন্ত নিয়ে যায়, আবছা স্মৃতির কথা আজও মনে পড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি প্রশ্নের উদ্ভব হয়- ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ হওয়ার কারণে পরিপূর্ণ বোঝার পর বঞ্চিত হওয়া, পরিপূর্ণ বোঝার আগেই বঞ্চিত হওয়া এবং অবুঝকালেই বঞ্চিত হওয়ার পার্থক্যের তাৎপর্য ও মূল্যবোধের জবাব কে দেবে? ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ হওয়ার কারণে- যারা অবুঝকালেই বাবা, চাচা, মামা, ভ্রাতা ও ভগ্নিবিয়োগে হৃদয়ে বিরূপ প্রভাব পরায় প্রয়োজনীয় স্নেহ, প্রেরণা, উৎসাহ, সদোপদেশ না পাওয়ার ক্ষত ও ক্ষতি বহন করছে, তারা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বঞ্চিত হয়েছে অনেক কিছু- তাদের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার শব্দটা বাদ দিলেও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে ভাবনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, তাদের বর্তমান অবস্থান কোথায়।

এক দিন আনুষ্ঠানিকভাবে দেশ শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন হলো। কিছু সম্মুখসারির মুক্তিযোদ্ধা ঘরে ফিরল, কিছু ফিরল না, কিছু মিডফিল্ডের মুক্তিযোদ্ধা ঘরে ফিরল, কিছু ফিরল না। যুদ্ধপ্রান্থর থেকে স্থায়ীভাবে ঘরে ফেরা হলো না অধিকাংশ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে, চির প্রস্তান নিল, সুদূর না ফেরার দেশে। তাদের সারির এক সদস্য তার বড় মামা আরেকজন জেঠাতো ভাই। দুঃখিনী মা-বোনের করুণ আর্তনাদ- সবার সন্তান ঘরে আসে আবার ফিরে যায়, কিন্তু তাদের (গরিবের) মানিক-রতন শুধু ফুরায়। প্রকৃতপক্ষে তারাই দেশপ্রেমিক, অমর এবং মহাপবিত্র।

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় নির্বিঘ্ন এবং সর্বজনীন। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, সংস্কৃতিতে যে অর্জন তার মূলে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ। একান্তভাবে যদি বলি, পল্লী-গাঁয়ের কৃষক-কাম ব্যবসায়ী বাবার সন্তান হয়ে নীরব অন্ধকারাচ্ছন্ন পিছিয়ে পড়া জনপথ থেকে উঠে এসে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ, দেশি-বিদেশি চাকরি, কৃষি খামার উৎপাদান কিংবা ব্যবসা কোনোটাই হতো না, দেশ স্বাধীন না হলে। তবে একাত্তর-পরবর্তী সময়ে আমরা কী নিজ নিজ ক্ষেত্রে আমাদের অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করছি? এখানে দুটি প্রশ্নের উদ্ভব হয়- দেশপ্রেম ও দেশদ্রোহী। আমরা যেন দেশদ্রোহী দেশঘাতী না হই, অনাগত সময় ও প্রজন্মের কথা বিবেচনায় এনে দেশপ্রেমে নতুনভাবে জাগরিত হই। অন্যথায় মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের আত্মত্যাগ ব্যর্থ হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close