ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) নাজমা বেগম নাজু
বিশ্লেষণ
স্বাধীনতাযুদ্ধে শক্তিধর দেশগুলোর ভূমিকা

পাকিস্তানের ভয়াবহ আগ্রাসন ও নিষ্পেষণের হাত থেকে মুক্তির এই লড়াই অত্যন্ত ন্যায্য হলেও সে সময় বিশ্বের দেশগুলো দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি আমাদের পক্ষে, অন্যটি বিপক্ষে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর মাঝে অলিখিত এক ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সূচনা হয়েছিল। পাকিস্তানের পক্ষে ছিল আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। বাংলাদেশের পক্ষে শক্ত অবস্থানে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত। ডিসেম্বরের তিন তারিখে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়লে জাতিসংঘের সাধারণ এবং নিরাপত্তা পরিষদে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। এমনকি জাতিসংঘের বাইরেও আমেরিকা, চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তীব্র কূটনৈতিক বাদানুবাদ শুরু হয়। তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া আমেরিকার উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মাধ্যমে ভারতকে থামানো। ভারতের ওপর এক ধরনের সামরিক হুমকি তৈরি করতে বঙ্গোপসাগরে রণতরীও পাঠিয়েছিল আমেরিকা। ডিসেম্বরের ৬ তারিখে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল ভারত। পরিস্থিতি এমন একপর্যায়ে গিয়েছিল যে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে দেওয়া সব ধরনের সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ-সংক্রান্ত ইস্যুটি সাধারণ পরিষদে আলোচনার জন্য আহ্বান জানায়। কিন্তু এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো ক্ষমতা সাধারণ পরিষদের নেই। ফলে দুশ্চিন্তা এবং হতাশার আবর্তে পতিত হয় পাকিস্তান। ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আমেরিকাকে জানান, পূর্বপাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হতে যাচ্ছে। ৮ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতির ওপর ভোটাভুটি হলে ভারত তাতে ভেটো দেয়। তারা স্রেফ জানিয়ে দেয়, যুদ্ধবিরতির কোনো প্রস্তাব তারা কখনোই মেনে নেবে না। পূর্বপাকিস্তানে যুদ্ধবিরতি এবং ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের সাধারণ পরিষদের দেওয়া প্রস্তাবে পূর্ণ সমর্থন দেয় আমেরিকা। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা জানিয়েছিল, এ প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন দিয়েছিল ১০৪টি দেশ এবং বিপক্ষে ছিল ১১টি দেশ। এর পরদিন জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য নরেন্দ্র সিংয়ের উদ্ধৃতি প্রকাশ করেছিল নিউইয়র্ক টাইমস- ‘আমরা যুদ্ধবিরতি করব না। অবশ্যই না। আমরা বোকা নই।’
আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তার ‘হোয়াইট হাউস ইয়ারস’ বইয়ে লিখেছেন- পূর্বপাকিস্তান স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত জাতিসংঘের অন্য কোনো যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেবেন না ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সে সময় জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ, যিনি ১৯৮৯ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্দেশে জাতিসংঘে ভারতকে হামলাকারী দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। তখন ভারতকে থামানো একমাত্র উপায় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। এ লক্ষ্যে ৮ ডিসেম্বর মস্কোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে যে শীর্ষ বৈঠকের চূড়ান্ত তারিখ ছিল, তা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখন আমেরিকার মনে হয়েছিল- ভারত হয়তো পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করে বসতে পারে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তারা বৈঠকও করে। বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে আমেরিকাকে এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয় যে, ভারত পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করবে না। কিন্তু আজাদ কাশ্মীর আক্রমণ সম্পর্কে কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। আমেরিকার ভয় ছিল একই সঙ্গে পূর্বপাকিস্তান এবং কাশ্মীর হারালে রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান টিকবে না। আজাদ কাশ্মীর সম্পর্কে কোনো নিশ্চয়তা না পেয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। ৯ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের কৃষিমন্ত্রী এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ঘোষণা করেন, ভারত যদি পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে অগ্রসর হয় তবে আমেরিকা বসে থাকবে না। সেজন্য অতি দ্রুত একটি যুদ্ধবিরতি এবং রাজনৈতিক সমাধান অত্যন্ত জরুরি। প্রেসিডেন্ট নিক্সন যেভাবে ভারতের বিরোধিতা করেছিলেন, তা নিয়ে একসময় হোয়াইট হাউস এবং পররাষ্ট্র দপ্তর স্টেট ডিপার্টমেন্টের মাঝে বিরোধিতা এবং টানাপড়েন শুরু হয়। এদিকে আমেরিকার ক্রমাগত চাপের মুখে সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ প্রস্তাব করেন- ২৫ মার্চের আগে পাকিস্তানের সঙ্গে শেখ মুজিবের আলোচনা যেখানে ভেঙে গেছে, সেখান থেকেই আবার শুরু করা যাক। এর ভিত্তিতে ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করে আমেরিকা। তারা নতুন একটি প্রস্তাব করে। এ প্রস্তাবে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়। পাকিস্তান এবং আমেরিকা চেয়েছিল কোনোমতে আপাতত এ যুদ্ধ বন্ধ রাখা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১০ ডিসেম্বর এ প্রস্তাবে পাঠিয়ে দেন সোভিয়েত দূতাবাসে। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা অপেক্ষার পরও এর কোনো উত্তর আসে না। এর মধ্যে মার্কিন রণতরীর একটি বহরকে বঙ্গোপসাগরে দিকে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের লেখনী থেকে আমরা পাই- মূলত ভারত যাতে পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ না করে তারই সতর্কবার্তা হিসেবে এ রণতরী পাঠান হয়েছিল।
১০ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার চীনের রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়ার সঙ্গে একটি অফিশিয়াল বৈঠক করেন। সিদ্ধান্তে আসেন পশ্চিম পাকিস্তান আক্রান্ত হলে তারা দুই দেশ সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করবে। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে একটি সমন্বিত যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য আবারও সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আমেরিকা। সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতকে এ বলে সতর্ক করেন কিসিঞ্জার যে, তাদের প্রস্তাবের জবাব অতি দ্রুত না পেলে আমেরিকা কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে। ডিসেম্বরের ১১ তারিখে নিউইয়র্কে এক বৈঠকে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে কিসিঞ্জার জানান যে, আমেরিকা পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চায়। ১১ ডিসেম্বর সকালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন, কিসিঞ্জার এবং হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফের মধ্যে এক বৈঠক চলাকালীন রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত জানান, যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তর আসছে। কিন্তু উত্তর আসে না। আরো ৭২ ঘণ্টা অপেক্ষার পর নিক্সন হটলাইনে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে বার্তা পাঠান- ৭২ ঘণ্টা অপেক্ষার পরও পাকিস্তান-ভারত ইস্যুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে কোনো উত্তর না পাওয়ায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যেতে বাধ্য হবে আমেরিকা। আর সাধারণ পরিষদ এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা আর পরিবর্তন করা যাবে না। এর মধ্যে রণতরীকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হতে বলে নিক্সন আবারও সোভিয়েত ইউনিয়নে বার্তা পাঠান- সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। পরদিন অর্থাৎ ১২ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের বার্তা আসে, ভারত পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করবে কি-না তা নিশ্চিতভাবে এখনই বলা যাচ্ছে না। এরই মাঝে মাল্লাক্কা প্রণালি পেরিয়ে মার্কিন রণতরী বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করো। ১৪ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি নিয়ে আসে হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফের কাছে। চিঠিতে উল্লেখ ছিল- এ মর্মে নিশ্চিত করা হচ্ছে যে, পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণের কোনো পরিকল্পনা ভারতের নেই। তবে কাশ্মীর আক্রমণ করবে কি-না এ ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা তারা দিতে পারবে না। ১৪ ডিসেম্বর ফ্রান্স এবং ইতালি জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে আসে। সেদিন পোল্যান্ডও একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আসে। ১৫ ডিসেম্বর এ খসড়া প্রস্তাবটি জাতিসংঘের আলোচনায় আসে। এ প্রস্তাবের অন্যতম বিষয় ছিল যুদ্ধবিরতি এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা। কিন্তু তখন নিরাপত্তা পরিষদে ভুট্টো বলে বসেন, আমরা যুদ্ধ করব। আমার দেশ আমাকে ডাকছে। আপনাদের নিরাপত্তা পরিষদ এখানে পড়ে থাক, আমি চললাম। নিজের অজান্তেই বোকামি করেছিলেন ভুট্টো। পোল্যান্ডের প্রস্তাব মেনে নিলে তা হয়তো পাকিস্তানের পক্ষেই যেত।
এদিকে যুদ্ধ পরিস্থিতি তখন সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানের প্রতিকূলে। কোণঠাসা অবস্থায় পুরোপুরি শ্বাসরুদ্ধ জেনারেল এ কে নিয়াজী। জাতিসংঘের আলোচনার তোয়াক্কা না করেই তিনি ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল স্পিভাকের বাসায় যান যুদ্ধবিরতির আলোচনার উদ্দেশ্যে। যুদ্ধবিরতি বলা হলেও এটি ছিল আত্মসমর্পণের আলোচনা। প্রকৃত পক্ষে সে সময় পাকিস্তানের উচ্চপর্যায়ের সামরিক এবং অসামরিক নেতাদের মধ্যে প্রচণ্ড মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়েছিল। একে অন্যকে দুষছিলেন তারা। নিজেরাই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন এবং অস্থির এক পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছিলেন। তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও বিরাজ করছিল।
মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে জেনারেল নিয়াজীর লেখা যুদ্ধবিরতির (আত্মসমর্পণ) চিঠি পৌঁছে যায় ভারতের জেনারেল শ্যাম মানেকশের কাছে। জেনারেল মানেকশ উত্তর দেন- আমার অগ্রসরমান সৈনিকদের কাছে যদি পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে, তবে যুদ্ধবিরতি গ্রহণযোগ্য হবে এবং আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ১৬ ডিসেম্বর পশ্চিম সীমান্তে শর্তবিহীন যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। বিপক্ষের শক্তিধর দেশগুলো তখন বলার আর অন্য কিছু না পেয়ে বলতে থাকে- আমরা পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পেরেছি।
লেখক : চিকিৎসক, কথাশিল্পী ও গবেষক
"