মোনায়েম সরকার

  ২৬ মার্চ, ২০২৩

মতামত

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার নেপথ্য ইতিহাস

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা, তার আপসহীন ও দৃঢ় নেতৃত্ব শোষিত বাঙালি জাতিকে ধীরে ধীরে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে সাহস জোগায়। দীর্ঘ ২৩ বছর নিরীহ বাঙালি জাতিকে শাসনের নামে শোষণ করেছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।

এর ফলে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে পূর্ব বাংলা। কোনো দেশের অর্থনীতি যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন সে দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের জীবনে তখন উন্নতির কোনো আশা থাকে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি যখন পাকিস্তানিদের কূটকৌশলে পড়ে দিকভ্রান্ত হয়- তখনই বাংলার সিংহপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। এ কথা বলা অতিকথন নয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই প্রথম বাঙালি নেতা, যিনি বাঙালিদের জন্য একটি স্বায়ত্তশাসিত স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই লক্ষ্যেই তিনি ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে। বাঙালি জাতি শেখ মুজিবের পরীক্ষিত নেতৃত্বে আস্থা স্থাপন করে এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করে।

১৯৫২ সাল থেকেই পাকিস্তানিদের সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানুষের মতপার্থক্য তৈরি হয় রাষ্ট্রভাষাবিষয়ক বিতর্ককে কেন্দ্র করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সম্মুখসারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিব। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে বাংলা ভাষা সেদিন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। এরপর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় বাঙালি জাতির মনে আশার সঞ্চার করে। পাকিস্তান আমলে বাঙালির কোনো আন্দোলনই ব্যর্থ হয়নি। দেরিতে হলেও সব আন্দোলনের চূড়ান্ত ফলাফল বাঙালিদের অনুকূলে ছিল। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত নিপুণভাবে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম পর্যবেক্ষণ করেন এবং কৌশল প্রণয়ন করে স্বাধীনতার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরই পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দ্রুত বদলে যেতে থাকে। এ সময় পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্র শুরু করে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার জন্য। বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা গোপনে গোপনে পূর্ব বাংলায় সৈন্য-সমাবেশ ঘটিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষকে নির্বিচারে নিধন করার নীলনকশা আঁকে। কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, সে বিষয়টি স্পষ্ট হলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপটটি উপলব্ধি করা সহজ হবে।

১৯৭১ সালের মার্চজুড়েই পাকিস্তানের রাজনীতি জটিল আবর্তে পতিত হয়। পূর্ব বাংলায় এ সময় বেশকিছু ঘটনা ঘটে, যা ইতিহাসে আগে কখনো দেখা যায়নি। মার্চের ২ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এর ফলে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা দেখা যায়। ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এরপর বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা হয়।

অনেক পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাও তাদের লেখায় স্বীকার করেছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের গ্রিন সিগন্যাল। কার্যত ৭ মার্চ থেকেই পূর্ব বাংলা বঙ্গবন্ধুর আদেশ-নির্দেশে চলতে শুরু করে। এ সময় পাকিস্তানিদের কোনো শাসনই মানতে চায়নি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত বাঙালি জাতি। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে দিশেহারা হয়ে যায়

পাকিস্তানিরা। তারা অস্ত্রের ভাষা ব্যবহার করার ঘৃণ্য পথ অবলম্বন করে। ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাঙালি জাতির ওপর অতর্কিতভাবে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা।

জ্বালিয়ে দেওয়া হয় হাজার হাজার বাড়িঘর। ঢাকা শহর ২৫ মার্চ রাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। তার সেই ঘোষণা সেদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও দেশপ্রেমিক জনতার কাছে টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সেদিন মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিল। এই যুদ্ধ পরে ৯ মাস স্থায়ী হয়। তারপর বিজয় লাভ করে হার না মানা লড়াকু বাঙালি জাতি।

ঢাকায় জনরব শোনা যাচ্ছিল, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজপথে নেমে আসবে। সমগ্র শহর স্তব্ধ। শঙ্কা দেশবাসীর মনে। বঙ্গবন্ধু বাড়িতে আছেন, কিন্তু তার কী অবস্থা তা সরেজমিন পরখ করার জন্য সন্ধ্যার পরপর ৩২ নম্বর সড়কের দ্বিতীয় বাড়ি থেকে বের হয়ে জনশূন্যহীন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনের রাস্তায় অপেক্ষা করতে থাকি (ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের দ্বিতীয় বাড়িটি ছিল আমাদের আত্মীয় শোভা আপাদের)। আবদুর রাজ্জাক এবং শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান একটি লাল গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যান এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধু বাড়ি থেকে চলে গেলেন কী রয়ে গেলেন এ সম্পর্কে উৎসুক ও উদ্বিগ্ন আমি কিছুই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিলাম না।

অনেকটা হতাশ হয়ে ধানমন্ডির ২৪নং রোডে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের বাড়িতে যাই। সেখানে তার পরামর্শে শুটিং ক্লাবের কিছু অস্ত্র তার বাসা থেকে তার স্ত্রী বেবী আপার বড়ভাই কর্নেল নুরুজ্জামানের বাসায় গোপনে গাড়িতে করে পৌঁছে দিই। কারণ যদি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে এসব প্রয়োজন হবে বাঙালিদের। এমনই মানসিক প্রস্তুতি ছিল আমার। এ রাতেই শুরু হয়ে যায় বাঙালি নিধনের রক্তাক্ত অধ্যায়। দুদিনের নির্মম হত্যাযজ্ঞ শেষে পাকিস্তানিরা কারফিউ শিথিল করে শুক্রবার ২৭ মার্চ। এদিন বন্ধু অধ্যাপক গৌরাঙ্গ মিত্রের মোটরসাইকেলে শহরের বিভিন্ন স্থান পর্যবেক্ষণ করি। তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের হত্যাযজ্ঞ পরিদর্শন ছিল ভয়াবহ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এ নৃশংসতা ছিল স্মরণকালের সবচেয়ে নির্মম। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর মতোই ছিল এ নির্মমতা। চারদিকে শুধু ধ্বংসস্তূপ আর মানুষের লাশ।

বিভিন্ন জায়গায় রক্তের দাগ, গুলির চিহ্ন। এক জায়গায় দেখি মাটি ঢিপি দিয়ে রাখা। তখন গণকবর শব্দটি আমার মাথায় ছিল না। পরে জেনেছি যেটাকে আমি প্রথম মাটির ঢিপি ভেবেছিলাম সেটা ছিল জগন্নাথ হলের শহীদদের গণকবর। জগন্নাথ হল থেকে উত্তর পাশের গেট দিয়ে বের হয়ে দেখি নালার পাশে মোটাসোটা একজন মানুষের গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে আছে। তার লাশ অতিক্রম করে রোকেয়া হলের কাছে আসতেই কয়েকজন লোক আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে দূর থেকে। আমি তাদের ইঙ্গিত অনুসারে পেছনে তাকিয়ে দেখি পাকিস্তানি আর্মি জিপ। আমরা আর দেরি না করে সেখান থেকে দ্রুত সরে পড়ি।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী যখন ঘুমন্ত বাঙালি জাতির ওপর পরিকল্পিত গণহত্যা চালায়, সেই রাতে আমি উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সায়েন্স ল্যাবরেটরি (এলিফ্যান্ট রোড) এলাকায় আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। মধ্যরাতে গুলির আওয়াজ আর আগুনের আলোতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের বস্তিতে সেদিন কী তাণ্ডব চলছিল, তা বুঝে নিতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে অনেকেই চেনেন। পাকিস্তান আর্মিরা কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে বলেছিল-‘বল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। মোয়াজ্জেম বলেছিলেন, ‘জয় বাংলা’। যতবার তিনি ‘জয় বাংলা’ বলেছিলেন, ততবারই তাকে গুলি করা হয়। তারপর তার লাশ আর্মি জিপে তোলা হয়। আমি পাশের গলিতে রাস্তার ওপর কমান্ডার মোয়াজ্জেমের রক্তরঞ্জিত আল্পনা দেখেছি। দেখেছি সায়েন্স ল্যাবরেটরি মসজিদের মুয়াজ্জিনের লাশ পড়ে থাকতে। প্রিন্সিপাল ওয়াহিদ বকশের কাজের লোক কৌতূহলবশত বাড়ির দুই তলার জানালা দিয়ে দেখছিল পাকিস্তানিদের তাণ্ডবলীলা। পাকিস্তানিরা তাকে গুলি করে মেরে ফেলে। সেই কাজের লোকের লাশ দেখারও দুর্ভাগ্য হয় আমার।

২৫ মার্চ রাতে পুরো ঢাকা শহর এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। বিনা কারণে একটি ঘুমন্ত জাতির ওপর পৃথিবীর আর কোনো দেশে এ রকম পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয়েছে কি-না তা আমার অজানা। বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রথম যিনি দৃঢ় অবস্থান নেন, তার নাম পদগোর্নি। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতবর্ষের ঋণ মনে রেখেও বলা যায়- তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিমান নেতা যখন পাকিস্তানিদের উদ্দেশে বললেন- ‘Stop genoside’, তখন বিশ্ববাসী বাংলাদেশের গণহত্যাকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে।

বঙ্গবন্ধু একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হন। তবে তার আগেই তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি করেন, যারা তার অবর্তমানে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবেন। আমরা পরে দেখেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথেই ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর আড়াই লাখ মা-বোনের নির্যাতনের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

বাংলাদেশে এখন জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে এভাবেই যদি এগিয়ে যায় বাংলাদেশ, তাহলে বিশ্বের কেউই বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবে না এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব হবে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ-স্বাধীনতা দিবসে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এমনটাই প্রত্যাশা করি।

লেখক : রাজনীতিবিদ, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close