মো. জিল্লুর রহমান

  ২৫ মার্চ, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় বনজসম্পদ

২১ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক বন দিবস। বন রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশের মতো অন্যান্য দেশেও দিবসটি গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় বন ও বনভূমির নিরাপত্তা রক্ষার্থে ২১ মার্চকে আন্তর্জাতিক বন দিবস ঘোষণা করা হয় এবং তখন থেকেই ২১ মার্চকে আন্তর্জাতিক বন দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

আসলে মানুষ তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধপত্র প্রভৃতির জন্য সরাসরি প্রকৃতি ও বনজসম্পদের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে অক্সিজেনের অফুরন্ত ভাণ্ডার দরকার হয়, তা মানুষ বনের বৃক্ষ থেকেই পেয়ে থাকে। তা ছাড়া, মানুষ বনের উদ্ভিদ প্রজাতি থেকে শুধু খাদ্যসামগ্রী ও অক্সিজেনই পায় না; ওষুধ, কাঠ, কাগজ, তন্তু, রাবার, আঠা, রজন, ট্যানিন, ফুল-ফল ইত্যাদিও পায়। একইভাবে বনের নানা প্রাণিজ প্রজাতি থেকে মাংস, দুগ্ধসামগ্রী, চামড়া, পালক, উল, লাক্ষা, মধু ইত্যাদি সংগ্রহ করে। এক কথায় খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য মানুষ বনের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন উপায়ে নির্ভরশীল।

বর্তমানে পৃথিবীতে জলবায়ুর পরিবর্তন ও উষ্ণতার যে সংকট চলছে তার জন্য মূলত মানুষই দায়ী। তাই এ সংকট থেকে মুক্তির জন্য প্রত্যেকেরই কিছু করণীয় আছে। নগরায়ণ, শিল্পায়ন, কৃষির আধুনিকীকরণ ইত্যাদির ফলে পরিবেশ সংকট বেড়েই চলেছে। অথচ শিল্পায়ন-নগরায়ণের গতি থামানো বা কমানো মোটেই সম্ভব নয়। তাই দরকার উন্নয়ন ও সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা। এ ক্ষেত্রে বনায়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। উদ্ভিদের সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রত্যেক মানুষই কিছু অবদান রাখতে পারে। তাই প্রত্যেকের উচিত প্রতি বছর বৃক্ষরোপণের মৌসুমে বাড়ির আশপাশে কিংবা খোলা জায়গায় সাধ্যমতো গাছ লাগানো। তবেই ভালো থাকবে প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য।

অনেকেরই হয়তো স্মরণে আছে ২০২০ সালের মে মাসে সুপার সাইক্লোন ‘আম্পান’-এর আক্রমণে উপকূলে সম্পদের অনেক ক্ষতি হলেও সুন্দরবনের বৃক্ষের কারণে প্রাণহানির পরিমাণ খুবই কম হয়েছিল এবং এটা তখনকার স্বস্তিদায়ক ঘটনা ছিল। এটা শুধু ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ক্ষেত্রেই ঘটেনি, এর আগে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বরে বুলবুল, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা মারাত্মক বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়ে আছড়ে পড়লেও সুন্দরবনের বৃক্ষে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে অনেক কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল; প্রাণহানিও হয়েছিল আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় বর্মণ ও অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করেছিল সুন্দরবন।

বাংলাদেশের সেই সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। অনেকে বলেন, এটা বাংলাদেশের আমাজন বন। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর সুন্দরবন সারা বিশ্বের মানুষের কাছে অন্যতম এক আকর্ষণীয় স্থান। শৌর্য-বীর্যের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রিয় আবাসভূমি এটি। ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, ফনী ও বুলবুলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবিলা করে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরবন, যা দেশের অহংকার ও গৌরবের প্রতীক। অথচ এ বনের অস্তিত্ব ক্রমেই বিপন্ন হচ্ছে। এ বন নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তারা বলছেন জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার অন্যতম শক্তি সুন্দরবন। অথচ তেলের ট্যাংক ডুবে বনের অভ্যন্তরের পানি, পরিবেশ-প্রতিবেশ দূষিত হওয়া, চোরা শিকারি ও বনসংলগ্ন এলাকায় শিল্প-কারখানা নির্মাণের কারণে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলছে।

এ ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিকল্পিত বনায়ন খরা ও মরুময়তা রোধে সর্বাধিক কার্যকর উপায় ও পদক্ষেপ। বনায়ন আমাদের গ্রিন হাউসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে, প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান দেয়, অক্সিজেন সরবরাহ করে, বাতাসের অতিরিক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণের মাধ্যমে পরিবেশ নির্মল রাখে, ক্ষতিকর দূষিত বাতাস শোধন করে জীব জগৎকে রক্ষা করে, সুশীতল ছায়া দেয়, মাটির ক্ষয় রোধ করে, মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করে মাটির উর্বরতা রক্ষা করে, মাটিতে উপযুক্ত পরিমাণ পানি ধরে রাখে, জ্বালানি সরবরাহ করে, জীবন রক্ষাকারী মূল্যবান ওষুধের কাঁচামালের জোগান দেয়, পশু-পাখি ও অন্যান্য বণ্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড়-ঝঞ্ঝা-জলোচ্ছ্বাস বন্যা রোধ করে, বাড়ি তৈরিতে ও দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় শৌখিন ও মূল্যবান আসবাবপত্র তৈরিতে, লবণাক্ততা রোধ করে, মানুষের আপদকালে বিমাতুল্য কাজ করে, মাটির ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থের শোষণ করে নিয়ে মাটিকে বিশুদ্ধ ও পরিষ্কার রাখে, বাতাস পরিষ্কার রাখে, বায়ুমণ্ডলের তাপ কমিয়ে আবহাওয়া ঠাণ্ডা রাখে, বায়ুদূষণকারী পদার্থ যেমন- কার্বন মনোক্সাইড, সালফার-ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং গাছের পাতা ঝড়-বাতাসের গতিকে রোধ করে, বৃষ্টির সৃষ্টি করে ও মরুময়তা রোধ করে, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি প্রকৃতিকে মায়াময় ও সৌন্দযর্ময় রূপে সাজিয়ে তোলে। এজন্য বেশি বেশি বনায়নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক।

পর্যাপ্ত পরিমাণ বনভূমি ও বৃক্ষ না থাকার কারণে আমাদের প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তার মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, মরুময়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইড বৃদ্ধি পাচ্ছে, জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর ক্লোরোফ্লোরো কার্বন, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ অনেক অনেক গুণ বেড়ে যাচ্ছে, বায়ুমণ্ডলের ওজন স্তরে ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে, ফলে ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে চলে আসছে। অ্যাসিড বৃষ্টি ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মেরু অঞ্চল ও এন্টারটিকা মহাদেশের বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবতের্নর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ এবং এজন্য ব্যাপক বনায়নের কোনো বিকল্প নেই।

এক হিসাবে বলা হয়েছে, গত এক শ বছরের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা ০ দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এভাবে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০ দশমিক ৫০ থেকে ১ দশমিক ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা যদি এভাবে বেড়ে যায়, তাহলে প্রকৃতি ও পরিবেশকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা, সুপেয় পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি তাদের অধিকার, গৃহায়ন ও অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা হুমকির মুখে পড়বে। এজন্য বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, আগামী ৫০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অনেকটা অংশ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি ও উপকূলীয় এলাকার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত বেড়ে গিয়ে বন্যা হবে, খাদ্য উৎপাদন শতকরা ৩০ ভাগ কমে গিয়ে ক্ষুধা ও গরিবের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে, তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে হিমালয়ের হিমবাহগুলো গলে বিপর্যয়ের মুখোমুখি করবে আমাদের।

বাংলাদেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৩ লাখ হেক্টর, যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এর মধ্যে বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৬ লাখ হেক্টর, যা দেশের আয়তনের প্রায় ১০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশের বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দেশের মোট আয়তনের ২২ দশমিক ৩৭ শতাংশএ উন্নীত হয়েছে, যা ২০২৫ সালের মধ্যে ২৪ শতাংশের বেশি উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়ে এরই মধ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, কৃষিভূমি সম্প্রসারণ, আবাসন প্রভৃতি নানা কারণে সংকুচিত হচ্ছে বনাঞ্চল। ফলে দেশের বন ও বন্যপ্রাণী আজ হুমকির সম্মুখীন।

বনজসম্পদের সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকার যেমন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে, তেমনি বন রক্ষার সঙ্গে জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষাও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিশ্বব্যাপী নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংসের পাশাপাশি শিল্পোন্নত দেশগুলো কর্তৃক অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের মাধ্যমে অবাধে কার্বন নিঃসরণের ফলে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনই হয়নি, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বন ও বন্যপ্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে। নির্বিচারে বন ধ্বংসের ফলে বন্যপ্রাণী বিশেষ করে হাতি, বাঘসহ অনেক মূল্যবান প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্তির হুমকির মুখে পড়ছে। পাশাপাশি শিল্পায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যে একের পর এক প্রাকৃতিক বনাঞ্চল উজাড় করায় ক্রমেই বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ফলে সার্বিকভাবে কৃষি বিশেষ করে ধানসহ পানিনির্ভর কৃষির রোপণ প্রক্রিয়া এবং এর উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

এ কারণে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত উষ্ণতা, প্রকৃতির খরা ও মরুময়তা থেকে রক্ষার জন্য ব্যাপক বনায়ন ও বৃক্ষ রোপণের কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, বনের বৃক্ষ ও প্রাণী আমাদের পরম বন্ধু, প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য এক অমূল্য সম্পদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অতন্দ্র প্রহরী। খাদ্য, বস্ত্র, পুষ্টি, বাসস্থান, ওষুধপত্র, অর্থের জোগানদাতা হিসেবে বনের বৃক্ষের অবদান অনস্বীকার্য, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষা ও উন্নয়নে বনের বৃক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জীব ও প্রাণিজগতের অস্তিত্ব বনজসম্পদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বনভূমি অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বাংলাদেশে বনভূমি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। এজন্য প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ব্যাপক বনায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close