ডা. মাহতাব হোসাইন মাজেদ

  ২৪ মার্চ, ২০২৩

ধর্মচিন্তা

ইসলামের দৃষ্টিতে পানি পানের নিয়ম

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পানি। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে পানির অস্তিত্ব বিদ্যমান। পানি ছাড়া পৃথিবীতে কোনো প্রাণিসত্তা টিকে থাকা অসম্ভব। আর পবিত্র কোরআনে পানিকে সব জীবের উৎস বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী একসঙ্গে মিলিত ছিল; অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিয়েছি এবং প্রত্যেকটি সজীব বস্তুকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছি; তবুও কি তারা বিশ্বাস করবে না?’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ৩০)

আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শ বছর আগেই কোরআন বলে দিয়েছে, প্রতিটি প্রাণীর মূলেই রয়েছে পানি। এরও কয়েক শ বছর পর যখন অণুবীক্ষণযন্ত্র উদ্ভাবিত হলো, তখন বিজ্ঞানীরা এই যন্ত্র ব্যবহার করে সাইটোপ্লাজম আবিষ্কার করে; এবং দেখতে পায় যে, এর শতকরা ৮০ ভাগই পানি দ্বারা গঠিত। পানি সম্পর্কিত এ রকম আরো অনেক তথ্য দ্বাদশ শতাব্দীর আগে মানবজাতির কাছে অজানা ছিল, যার বর্ণনা কোরআন বহু আগেই দিয়েছে।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ তিনটি বিষয়ে পরস্পরের অংশীদার। পানি, ঘাস (বাণিজ্যিক ও মালিকানাধীন ভূমিতে নয় এমন) ও আগুন।’ (ইবনে মাজাহ)

আল্লাহতায়ালা বিশুদ্ধ পানির গুরুত্বও তুলে ধরে বলেছেন, ‘তোমরা যে পানি পান করো, তা সম্পর্কে ভেবে দেখেছো কি? তোমরা তা মেঘ থেকে নামিয়ে আনো, না আমি বর্ষণ করি? আমি চাইলে তা নোনা করে দিতে পারি, এর পরও কেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো না?’ (সুরা : ওয়াকিয়াহ, আয়াত : ৬৮-৭০) কিন্তু কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা উপেক্ষা এবং বৈশ্বিক সম্পদ পানির সুষ্ঠু বণ্টন ও রক্ষায় উপযুক্ত উদ্যোগ না থাকায় পৃথিবীতে এরই মধ্যে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট তৈরি হয়েছে। পরিবেশবিজ্ঞানীদের দাবি, আগামী দিনে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহই হবে পৃথিবীর অন্যতম কঠিন চ্যালেঞ্জ।

বিশ্বনবীর পানি পানের ৬টি সুন্নাত : ইসলামের বিধান শুধু নামাজ-রোজা-হজ-জাকাত তথা ইবাদত-বন্দেগির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং দুনিয়ার প্রতিটি কাজের সঙ্গেই ইবাদত-বন্দেগি ও ইসলামের রীতিনীতি জড়িত। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই মানুষের জন্য ইবাদত হবে যখন এসব কাজ ইসলামি পদ্ধতিতে করা হবে, যেমন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাবার ও পানীয় গ্রহণ করা অত্যন্ত আবশ্যক। আবার জীবনধারণে পানি পান করাও আবশ্যক। পানির অপর নাম জীবন। জীবন বাঁচাতে পানি পানের বিকল্প নেই। সব সৃষ্টিরই বেঁচে থাকার তাগিদে পানি পান করতে হয়।

আর মানুষের পানি পানে রয়েছে কিছু ইসলামি নিয়ম ও পদ্ধতি। কাজটি ছোট হলেও প্রতিদিন অনেকবার মানুষকে পানি পান করতে হয়। পানি পানের সময় স্বয়ং বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুনির্দিষ্ট কিছু আমল করতেন। মহানবীর বাস্তব জীবনের এ আমলগুলো উঠে এসেছে হাদিসের বর্ণনায়। আমলগুলো হলো-

১. পানি পানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন তোমরা পানি পান করতে যাবে তখন প্রথমেই ‘বিসমিল্লাহ’ পড়বে।’ (তিরমিজি) শুধু পানি পানের সময়ই নয়, বরং যেকোনো কিছু খাওয়ার সময় এবং ভালো যেকোনো কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে হবে।

২. সব সময় ডান হাতে পানি পান করা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কখনো খাবার এবং পানীয় বাম হাতে গ্রহণ করবে না। কেননা শয়তান বাম হাতে খাবার গ্রহণ করে।’ (মুসলিম) সব ভালো কাজে ‘বিসমিল্লাহ’ বলার মতো ভালো কাজে ডান হাত ব্যবহার করাও উত্তম। এমনকি পোশাক পরার সময়ও আগে ডান দিক থেকে শুরু করা। আর ডান দিক থেকে শুরু করতে হলে ডান হাতই ব্যবহার করতে হয়।

৩. সব সময় বসে পানি পান করা : হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ মুসলিমে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, (আগে) বসুন এবং পানি করুন। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মতেও এটি সর্বজন-বিদিত যে, দাঁড়িয়ে পানি পান করার চেয়ে বসে পানি পান করা বেশি ভালো। আর বসে পানি পান করা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম সুন্নত।

৪. তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা কখনো এক নিঃশ্বাসে পানি পান করো না। বরং তোমরা দুই কিংবা তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করো। অনেককেই দেখা যায়, পানি পান করার সময় ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় এক নিঃশ্বাসে মগ কিংবা গ্লাসে পুরো পানি পান করে থাকে। আবার অনেকে পানিও পান করতে থাকে আর নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। এর কোনোটিই ঠিক নয় বরং সুন্নাতবিরোধী কাজ। তাই পানি পানের সময় অল্প অল্প করে ২-৩ বারে পানি পান করা। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানেও এটি উপকারী।

৫. গ্লাসের পানিতে নিঃশ্বাস না ছাড়া তিবরানিতে এসেছে, ‘পানি পান কিংবা খাবার গ্রহণের সময় মুখ থেকে পানি কিংবা খাবারে নিঃশ্বাস না ছাড়া।’ চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিষয়টি সুস্পষ্ট করা হয়েছে যে, অনেক সময় মুখে অনেক বা মুখের সামনে অনেক ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু থাকে। পানি বা খাবারে ফুঁ দেওয়া বা নিঃশ্বাস ফেলানোর ফলে এ জীবানু ব্যাকটেরিয়া পানি ও খাবারের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। আর তাতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

৬. সব সময় পানি পানের পর ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়া- পানি পানের পর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় স্বরূপ সব সময় ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা। সুন্দর ও নিরাপদভাবে খাবার ও পানীয় গ্রহণের পর আল্লাহর প্রশংসামূলক বাক্য ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলায় তারই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়।

পরিশেষে বলতে চাই, পানি যেহেতু আল্লাহ প্রদত্ত অপার নিয়ামাত। তাই পানির অপচয় ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো সব কর্ম পরিহার করি। সুস্বাদু পানির সংরক্ষণে এগিয়ে আসি। পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করি। আল্লাহতায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close