ইলিয়াজ হোসেন

  ২৪ মার্চ, ২০২৩

বিশ্লেষণ

ব্রিটিশ শাসন ও ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

১৭৬৫ সালে আগস্ট মাসে লর্ড ক্লাইভ এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধির দ্বারা বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করেন। এই সন্ধির দ্বারা বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের মর্যাদা ও ক্ষমতা কোম্পানি স্বীকার করেন, কোরা ও এলাহাবাদ প্রদেশ বাদশাহকে কোম্পানি ছেড়ে দেয়, বাদশাহ বিনিময়ে কোম্পানিকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি বা রাজস্বের স্বত্ব স্থায়ীভাবে ছেড়ে দেন, এজন্য কোম্পানি বাদশাহকে বছরে ২৬ লাখ টাকা দিতে অঙ্গীকার করে এবং বাংলার নবাবকে নিজামতের খরচার দরুন বছরে ৫৩ লাখ টাকা দিতে স্বীকৃতি দেয়। কোম্পানি বাংলার রাজস্ব বা দেওয়ানি পেলেও প্রত্যক্ষভাবে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব গ্রহণ করা কোম্পানির পক্ষে আপাতত সম্ভব না। কারণ কোম্পানির এই কাজের জন্য উপযুক্ত কর্মচারী, লোকবল এবং রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় রেকর্ড বা কাগজপত্র ছিল না। সুতরাং ক্লাইভ বাংলার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব নায়েব রেজা খানকে এবং বিহারে সিতাব রায়কে দান করেন। রেজা খান যাতে ক্ষমতালোভী স্বৈরাচারী হতে না পারে এজন্য বাংলার দুর্লভ রায় ও জগৎ শেঠকে এবং তার সহকারী হিসেবে নিয়োগ করেন।

এভাবে সব বন্দোবস্ত করে ক্লাইভ বাংলার দেওয়ানি ও দ্বৈতশাসন চালু করেন। কোম্পানির দিক থেকে বাংলার দেওয়ানি লাভ ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এত দিন তারা মীরজাফর ও মীর কাশিমের সঙ্গে চুক্তিবলে বর্ধমান, মেদেনীপুর, চট্টগ্রাম ও ২৪ পরগনার রাজস্ব ভোগ করত। এখন তারা গোটা বাংলার রাজস্বের অধিকারী হয়। কোম্পানি একজন নবাবের কৃপাপ্রার্থী বণিক থেকে একলাফে রাজস্বের অধিকারী হয়ে বাংলার ওপর প্রকৃত আধিপত্য বিস্তার করে। ঐতিহাসিক পাসিভ্যাল স্পিয়ারের মতে, বাংলার কোম্পানির আধিপত্য রক্ষার জন্য এবং দিল্লির বাদশাহের আক্রমণের ভয়ে কোম্পানিকে স্থির, ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতে হয়নি। বাংলায় ঘনঘন নবাব পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তাও শেষ হয়ে যায়। পি. জে মার্শাল বলেন, পেছন থেকে দেখলে ১৭৬৫ সালে কোম্পানির দেওয়ানি লাভকে বাংলায় মুঘলযুগ ও ব্রিটিশ যুগের বিভাজিকা চিহ্ন বলে মনে হবে। দেওয়ানি লাভের ফলে প্রত্যক্ষভাবে নামমাত্র নবাবের শাসন বজায় থাকলেও, কার্যত পরোক্ষভাবে প্রকৃত ক্ষমতা রইল ইংরেজদের হাতে। ক্লাইভ ইচ্ছা করলে নবাবকে সরিয়ে সরাসরি ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন কিন্তু সম্ভবত তিনি মনে করেন যে, এরূপ করলে স্বল্পসংখ্যক বিদেশি বণিকের আধিপত্যে দেশের লোকরা অসন্তুষ্ট হয়ে নানা বিরোধ ও গোল সৃষ্টি করবে এবং বিদেশি অন্যান্য ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায়ও তাদের বিরুদ্ধে বাংলার অভিবাসীদের পক্ষে সমর্থন করবে। এজন্য তিনি ইংরেজ প্রভুত্বের ওপর একটি আবরণ রেখে দিলেন, যাতে প্রকৃত রাষ্ট্রবিপ্লবের চিত্রটি জনসাধারণের কাছে স্পষ্টরূপে প্রতিভাত না হয়ে ক্রমেই ধীরে ধীরে প্রকট হয়।

দেওয়ানি লাভের ফলে কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা বাংলায় শুল্কহীন অবাধ বাণিজ্য করার সুযোগ পায়। কোম্পানি বাংলায় রাজস্বের দাবি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। বাংলাকে কামধেনু মনে করে কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা নির্মমভাবে দোহন করতে থাকে। কোম্পানির অর্থের লালসা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। ১৭৬৫ সালের আগে নবাবরা এই লালসাকে অনেক পরিমাণে সংযত রাখতেন। এখন নবাব ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হওয়ায় কোম্পানিকে নিরস্ত করার কোনো উপায় ছিল না। কোম্পানির সব কর্মচারীরা অসদুপায়ে রাজস্ব আদায় এবং রাজস্ব আত্মসাৎ করলেও কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা চোখ বুঝে থাকতেন। ডা. এন কে সিংহ বলেন, আলীবর্দীর আমলে পূর্ণিয়া থেকে রাজস্ব আদায় হতো ৪ লাখ টাকা, এখন ওই জেলা থেকে সুচেৎ রাম ২৫ লাখ টাকা আদায় করে দিলেও কোম্পানি সন্তুষ্ট হয়নি। দিনাজপুর থেকে নবাব আলীবর্দীর আমলে আদায় হতো ১২ লাখ টাকা, এখন দেওয়ানির পর ১৭ লাখ আদায় করা হয়, তবুও কোম্পানির কর্তারা যথেষ্ট আদায় হচ্ছে না বলে মনে করেন। মুহাম্মদ রেজা খান এরূপ অবস্থায় কোম্পানিকে সতর্ক করে বলেন, হংসীকে খেতে না দিয়ে তাকে স্বর্ণ ডিম প্রসব করতে বাধ্য করলে, হংসীর প্রাণবায়ু নির্গত হবে। দেওয়ানি লাভের পরে বাংলা থেকে ব্যাপকভাবে সম্পদের নির্গমন হতে থাকে। পলাশির পর যে লুণ্ঠনের ক্ষীণধারা দেখা গিয়েছিল এখন তা স্রোতস্বিনীতে পরিণত হয়।

কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা শুধু ব্যাপক বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে ক্ষান্ত থাকেনি। তারা ব্যাপক ও অবাধ শুক্লহীন বাণিজ্য দ্বারা বঙ্গলক্ষ্মীর ভাণ্ডার লুট করতে থাকে। এই অর্থ ইংল্যান্ডে চলে যায়। কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের কাজে এতই মত্ত হয় যে, কোম্পানির নিজস্ব বাণিজ্যে ভাটা পড়ে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, বাংলা থেকে প্রেরিত এই সম্পদের সাহায্যে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের মূলধনের সরবরাহ হয়। ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের উড্ডয়নকাল ১৭৬০-১৭৮০ খ্রি. ধার্য করেন। ১৭৬৫ সালে বাংলার দেওয়ানি প্রকৃত অর্থে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ক্ষেত্র রচনা করে। জর্জ কর্নওয়াল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের সম্মুখে সাক্ষাৎকার দানের সময় বলেন, আমি দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এ কথা জানাতে চাই, ১৭৬৫-১৭৮৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অপেক্ষা বেশি দুর্নীতিপূর্ণ, বেশি অত্যাচারী ও লুণ্ঠন প্রবৃত্তির তথাকথিত সভ্য সরকার পৃথিবীর বুকে আর দেখা যায়নি।

১৭৬৭ সালে লর্ড ক্লাইভ ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ক্লাইভের পরে প্রথমে ভেরেলস্ট ও পরে কার্টিয়ার ১৭৬৯ সালে বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির গভর্নর হলেন। এ সময়ে ইংরেজ কর্মচারীরা নানা অসৎ উপায়ে অবাধ লুণ্ঠন ও শুল্কহীন অবাধ বাণিজ্য গ্রামবাংলাকে দরিদ্রের পাঁকে ডুবিয়ে দেয়। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা জবরদস্তি করে তাঁতি, শিল্প, কারিগর ও কৃষকদের তাদের উৎপন্ন দ্রব্য ন্যায্যমূল্য অপেক্ষা কমদামে বিক্রি করতে বাধ্য করে। কোম্পানির গোমস্তা ও পেয়াদাদের নির্যাতনের ফলে ঢাকা, সোনারগাঁ, মুর্শিদাবাদ ২৪ পরগনায় তাঁতিরা কোম্পানির কর্মচারীদের কাছে কম দামে কাপড় বিক্রি করতে বাধ্য করে। ১৭৭০ খ্রি. তাঁতিদের উৎপন্ন মালের জন্য যে দাম কোম্পানি বা কর্মচারীরা দেয় তার পরিমাণ ছিল ১৭৩০-৪০ খ্রি. থেকে অনেক কম। ১৭৫৭ খ্রি. একসের আফিম উৎপাদনে জন্য পারিশ্রমিক ছিল ২ টাকা, ১৭৭০ খ্রি. তা দাঁড়ায় ১ টাকা ৯ আনায়। চালের দাম বাড়তে থাকায় কারিগর, শিল্পী শ্রেণি, যারা তাদের মাল বিক্রি করে চাল খরিদ করত, তাদের জীবনধারণ দুষ্কর হয়ে পড়ে। ১৭৬৯-৭০ সালে মোটা চাল টাকায় ছিল ১৬ সের, গম টাকায় ৩২ সের, তেল টাকায় ৬ সের ১ পোয়া। সেই তুলনায় মজুরির হার কম ছিল। এ জন্য খেটে খাওয়া মানুষের ভোগান্তির সীমা ছিল না। এই পরিস্থিতিতে অনাবৃষ্টিজনিত অজন্মার ধাক্কা বাঙালিকে দুর্ভিক্ষের গহ্বরে ফেলে দেয়।

বাজারে চালের সরবরাহ টান পড়ায় কোম্পানির কর্মচারীরা সস্তা দরে চাল কিনে মজুদ করে উঁচু খুচরা দামে বিক্রি করে মুনাফা লুটতে থাকে। পরের বছর আবার অনাবৃষ্টির দরুন দুর্ভিক্ষের আবাস পাওয়া যায়। কোম্পানি তার সেনাদের খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য বাজারে যা চাল পাওয়া যায় তা সবাই কিনে নিয়ে মজুদ করে। বাংলায় অনাবৃষ্টি, খাদ্য সংকট প্রবল আকার ধারণ করে, তখন কোম্পানি মাত্র ৫ টাকা এবং পরের বছর শতকরা ১০ টাকা ছাড় দিয়ে বাকি রাজস্ব বলপূর্বক আদায় করে। হান্টারের বিবরণ থেকে জানা যায়, পরপর দুবছর অনাবৃষ্টির পর, কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের জুলুমে সর্বস্বান্ত হয়ে কৃষক তার গরু, লাঙল, বীজধান খেয়ে ফেলে। শেষ পর্যন্ত পুত্র-কন্যাকে বিক্রি করতে শুরু করে। গাছের পাতা, ঘাস প্রভৃতিও তারা খেতে আরম্ভ করে। একই সঙ্গে আরম্ভ হয় গুটি বসন্তের মহামারি। সিয়ার-উল-মুতাকখিরিনের মতে, তিন মাসব্যাপী বসন্তের প্রকোপ, খাদ্যভাবে শীর্ণ লোকরা দলে দলে মারা যায়। অন্নহীন কঙ্কালসার মৃত্যু দেহগুলো রাস্তাঘাটে পড়ে থাকে। মাংসভোজি পশু, পাখিদেরও মানুষ্য মাংসে অরুচি দেখা দেয়। দলে দলে লোক খাদ্যের আশায় কলকাতা, ঢাকা, মুর্শিদাবাদের দিকে ছুটে আসে। গ্রামবাংলায় যখন এই মৃত্যুর মিছিল চলছিল, তখন কলকাতায় শেতাঙ্গ সমাজে আমোদণ্ডপ্রমোদ, বিলাসিতা, নাচ, সুরাপানে আনন্দণ্ডউচ্ছল জীবনযাপনে রত ছিল।

হিকির গেজেটে পাওয়া যায় বাংলার ১/৩ জনসংখ্যা ধ্বংস হয় ও ১/৩ কৃষিজমি অনাবাদি হয়। প্রায় দুই পুরুষের পর বাংলার জনসংখ্যা বৃদ্ধি সম্ভব হয়। গ্রামবাংলা জনশূন্য শ্মশানে পরিণত হয়। কৃষকের ছন্নছাড়া শূন্য ভগ্নদশাগ্রস্ত মাটির কুটিরগুলো একমাত্র এই বিরাট ধ্বংসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জমিগুলো অনাবাদি হয়ে আগাছা ও জঙ্গলে ভর্তি হয়। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলা অকস্মাৎ একটি মহাশ্মশানে পরিণত হয়। জেমস মিল ও ওয়ারেন হেস্টিংসের মতে বাংলা-বিহারের ৩ কোটি মানুষের মধ্যে ১ কোটি মানুষ মারা যায়। হান্টারের মতে, বাংলা-বিহারে প্রতি ১৬ জনে ১ জন মারা যায়। স্যার জন শোর ছিলেন এই দুর্ভিক্ষের প্রত্যক্ষদর্শী। তার মতে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলার সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো ছিল নদীয়া, রাজশাহী, বীরভূম, বর্ধমান, যশোহর, মালদাহ ও ২৪ পরগনা এবং বিহারের পূর্ণিয়া। তিনি বলেন, ৩ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ৯০ হাজার টাকা খরচ করা হয়। বহু সম্ভ্রান্ত পরিবার ও সাধারণ গৃহস্থ সর্বস্বান্ত হয়েছিল। প্রায় বিশ-ত্রিশ বছর বাংলাদেশে এই দুর্ভিক্ষের চিহ্ন লোপ পায়নি। ১৭৭০ সালের মন্বন্তর এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। ১৭৫৭ সালে সিরাজের পতনের পর থেকে ইংরেজ কোম্পানি ধাপে ধাপে এই পরিণতির দিকে নিশ্চিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। বলা যায়, অজগর সাপ যেমন শিকারকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধীরে ধীরে উদরস্থ করে, সম্রাট শাহআলম সেরূপ ইংরেজদের সঙ্গে এলাহাবাদ চুক্তির মারাত্মক আলিঙ্গনে বাধা পড়ে শেষ পর্যন্ত বাংলাকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। মাকড়সার জালে পড়ে গেলে যেমন মক্ষিকা বন্দি হয়ে প্রাণ হারায়, ব্রিটিশ কোম্পানির দেওয়ানি অধিগ্রহণ দিয়ে বাংলার মানুষ ১৭৭০ সালে অবর্ণনীয় দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে মারা গিয়েছিল।

লেখক : প্রভাষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close