আবু আফজাল সালেহ

  ২৪ মার্চ, ২০২৩

মতামত

যুবশক্তি : বেকারত্ব ও কর্মসংস্থান

দেশের বড় একটা অংশ হচ্ছে যুব বা তরুণসমাজ। এ সমাজের ওপর নির্ভর করে সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থিরতা ও শান্তিময়তা। অপ্রাপ্ত বা তরুণ কর্তৃক খুন-ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে অহরহ। দেশে ছাত্র কর্তৃক শিক্ষক লাঞ্ছিত হচ্ছে, তরুণ কর্তৃক সিনিয়র অবহেলিত হচ্ছে। মিডিয়ায় যা আসে সেটাও কম নয়। প্রকৃত অবস্থা আরো খারাপ বা ভয়াবহ। এ অবস্থা বলে দেয়, দেশে তরুণসমাজ ভালো নেই; তরুণের তারুণ্য কাজে লাগাতে হবে। তরুণসমাজের বিপথ থেকে রক্ষা করতে আমরাই ব্যর্থ হয়েছি। পারিবারিকভাবে আমরা নৈতিক শিক্ষা দিতে পারছি না। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কম করতে পারছি! ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ও আইনের যথাযথ প্রয়োগে ব্যর্থ হওয়া ইত্যাদি কারণে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। তরুণসমাজে স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব না! উন্নয়নও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে।

ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা চাকরিপ্রার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন অথবা তাদের চাহিদামতো কাজ পাচ্ছেন না। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এ সময়ে বাংলাদেশের শতকরা ৪৭ ভাগ স্নাতকই বেকার। যেখানে ভারতে ৩৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৮, নেপালে ২০ এবং শ্রীলঙ্কায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ বেকার রয়েছেন। আর আইএলওর তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। বেকারত্বের এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে দু-এক বছরের মধ্যে বেকারের সংখ্যা ছয় কোটিতে দাঁড়াবে। বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ১২তম। বেকারের সংখ্যা দেড়-দশকের তুলনায় বর্তমানে অনেক বেশি। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে শিক্ষিত বেকারত্বের হারের সর্বোচ্চ স্তরের জন্য ২৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় স্থানে রেখেছে। যে ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে যুব বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে বলে আইএলও তার এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮ শিরোনামে জানিয়েছে। জাতীয় শ্রমশক্তি সমীক্ষা (২০১৬-১৭) হিসেবে ১১ শতাংশ যুবক বেকার এবং বেকারত্বে তাদের অংশ প্রায় ৮০ শতাংশ। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশে আনুমানিক ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে বলে সংস্থাটি মনে করে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের শ্রমশক্তি ২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রতি বছর ২ দশমিক ১ মিলিয়ন কর্মসংস্থান দরকার। ফলে বিপুল পরিমাণ যুবশক্তি কর্মসংস্থানের বাইরে থাকছে। উল্লিখিত পরিসংখ্যানগুলো প্রাক-কোভিড-১৯ সময়ের। পরে এ অবস্থা আরো মারাত্মক হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থ’ার মতে, (আগস্ট, ২০২২), বাংলাদেশে, যুব বেকারত্বের হার বর্তমানে ১০ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা জাতীয় বেকারত্বের ৪ দশমিক ২ শতাংশের দ্বিগুণেরও বেশি। বিপুল এ-সংখ্যা দেশের জন্য স¤পদ না-হয়ে বোঝা হচ্ছে। তরুণ বা যুবশক্তিকে যদি আমরা কাজ না দিতে পারি তাহলে রাজস্ব যেমন ব্যয় হবে বা আদায় কমে যাবে এবং সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর বিশাল চাপ দেবে। এতে দেশের উন্নয়ন শ্লথ হয়ে যাবে। বাংলাদেশে যুববেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে মূলত চাহিদা ও জোগানের সীমাবদ্ধতার কারণে। চাহিদার বিপরীতে বৃহৎ যুবজনগোষ্ঠীর জন্য বিনিয়োগ তেমন বৃদ্ধি পায়নি। ২০০৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে, ব্যক্তিগত বিনিয়োগ জিডিপির ২২ শতাংশ থেকে বেড়ে মাত্র ২৫ শতাংশ হয়েছে। সমস্যাটা এখানেই। শিক্ষিত তরুণরাই একটি জাতির সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। তবে বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণদের একটি বড় দল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকে বঞ্চিত। ফলে, কর্মসংস্থান-সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তরুণদের প্রশিক্ষণ/শিক্ষা গ্রহণ অপর্যাপ্ত ও সময়োপযোগী নয় বা উপযোগিতা কম। এ বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার, বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ/বাস্তবায়ন করতে হবে। তরুণদের প্রাসঙ্গিক দক্ষতায় সজ্জিত করতে হবে। তাহলে পরিপূরক আয় সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে, যেখানে এ ধরনের দক্ষতা কাজে লাগানো যেতে পারে।

কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করতে পারলে বিপুলসংখ্যক বেকার সমাজের বোঝা হয়ে যাবে। বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হবে। তার নমুনা দেখতে পারছি। চীনের ক্ষেত্রেও তরুণসমাজের একটি অংশ বেকার-বয়স্ক হয়ে বোঝা হয়ে গেছে। তরুণসমাজের নিরানন্দ রুখতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতেই হবে। কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা সরকারের আছে। বর্তমান সরকার অনেক এগিয়েছে। আরো বাড়াতে হবে। হাতে-নেওয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে এ ক্ষেত্রে অনেক সমাধান হবে। বেসরকারি খাতকে অনেক বেশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ায় অদক্ষ লোকের দাম নেই। অনেক ক্ষেত্রে জনবল ছাঁটাই করতে বিভিন্ন সংস্থা। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। কারিগরি শিক্ষায় অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে তরুণসমাজকে স¤পদে পরিণত করতে অপেক্ষাকৃত সহজ হবে।

বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্য হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করে উন্নত দেশে রূপান্তরিত করা। সে ক্ষেত্রে মানুষের জীবনমান আরো উন্নত করা, মাথাপিছু আয় বাড়ানো, তরুণ প্রজন্মকে দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মে নিয়োগ দান, ২২ শতাংশ অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যচক্র থেকে যত দ্রুত সম্ভব বের করা, কন্যাশিশুসহ মাতৃপ্রধান পরিবারসমূহকে সহায়তা করা ইত্যাদি কাজ করতে হবে। শিক্ষিত তরুণরা যেন দেশ-বিদেশে চাকরি করতে পারেন, শ্রমবাজারে ছড়িয়ে পড়তে পারেন সেই ব্যবস্থাও সরকারকে করতে হবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই হতে পারে তরুণসমাজের সবচেয়ে বড় সমাধান। কর্মসংস্থানই তরুণদের পথচলাকে আনন্দময় করতে পারে। বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের বড় তিনটি খাত পোশাক, চামড়া এবং ওষুধশিল্প। কিন্তু এ-খাতের মূল পদগুলো বিদেশিদের দখলে। আর তার কারণ, আমাদের দক্ষ জনশক্তি নেই। আমরা পোশাকশিল্পের কথা জানি। সেটা কিন্তু পড়তির দিকেই। বাংলাদেশের ওষুধশিল্প কর্মসংস্থানের বড় একটি খাত। সরকারি চাকরির বাইরে প্রতি বছর এখন প্রায় ৭০ হাজার চাকরির ব্যবস্থা হয় এ শিল্পের মাধ্যমে। আরো কয়েকটি খাত কর্মসংস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিজাত, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণ, পর্যটন ও হালকা কারিগরি নির্মাণশিল্প ইত্যাদি এ পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু তারা চাহিদামতো দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছে না। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে এখন দরকার ডিজাইনার, বিশেষ করে ফ্যাশান ডিজাইনার। এমবিএ ডিগ্রিধারী হচ্ছে, কিন্তু বেশির ভাগই বেকার থাকছে বা চাহিদামতো চাকরি পাচ্ছে না। অন্যদিকে ফ্যাশন ডিজাইনার আনছি বিদেশ থেকে। পোশাক খাতেই আমরা বছরে বিদেশিদের বেতন দিয়ে থাকি অন্তত পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ অবস্থা অনেক সেক্টরে বিরাজ করছে। শিক্ষার পরিমাণগত হার বাড়ছে কিন্তু চাহিদাকৃত/কোয়ালিটি শিক্ষার হার খুব কমই বাড়ছে। এ থেকে উত্তরণে উন্নত শিক্ষানীতি ও বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। মানসম্মত কারিগরি শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

দেশের তরুণসমাজের একাংশ মাদকাসক্ত- নেশাগ্রস্ত। এ-থেকে মুক্তি পেতেই হবে। একাংশকে দুর্বল রেখে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। এ ব্যাপারে অবশ্য সরকার কঠোর অবস্থানে আছে। বাস্তবায়নকারীদের আরো সতর্ক হতে হবে। তরুণসমাজের বড় অংশ নেটে আসক্ত। এতে সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে। খারাপ কিছু গ্রহণ করে বিপথগামী হচ্ছে। দেশের মিডিয়ায় ভালোমানের অনুষ্ঠানের অভাব। ফলে বাইরের দেশের অনুষ্ঠান দেখে অন্য দেশের কালচার গ্রহণ করছে যুবসমাজ। সবকিছুর মূলেই কর্মসংস্থানের অভাব। ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’ এর অবস্থা। পারিপারিক ও ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষা তরুণদের জাগিয়ে তুলতে পারে। এ ক্ষেত্রে সমাজের অংশ হিসেবে সবার ভূমিকা আছে; এবং তা গুরুত্বপূর্ণ। সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের পূর্বশর্ত যুব-কর্মসংস্থান। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিভিন্ন আর্থসামাজিক সূচকে অনেক অগ্রগতি করেছে। তার পরও যুব বেকারত্ব-সমস্যা অনেক বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কোভিডে বেকারত্বের হার সারা বিশ্বের ন্যয় বাংলাদেশেও বেড়েছে। ফলে, যুব বেকারত্ব দেশের অন্যতম প্রধান নীতিগত চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। প্রতি বছর দুই মিলিয়নেরও বেশি লোক কর্মশক্তিতে প্রবেশ করে ধরে নিয়ে বৃহৎ শিক্ষিত যুবকদের চাকরির বাজারে স্থান দিতে। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত বা জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য চিহ্নিত-সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য বাস্তসম্মত ও সময়োপযোগী নীতি গ্রহণ করতে হবে। এজন্য জাতীয় বা বাজেটে যুব-সংক্রান্ত বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে, মনিটরিং জোরদার করতে হবে। যথাযথ প্রশিক্ষণ মডিউল, দক্ষ প্রশিক্ষক এবং অন্যান্য জাতীয় স¤পদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ব্যয় বাড়াতে হবে। বিনিয়োগের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এসব কার্যকর হলে যুবশক্তিকে ক্ষমতায়িত করা যাবে, দেশের উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করবে। ফলে দিশাহারা তারুণ্য হবে আনন্দময়, দেশ পাবে অফুরন্ত শক্তির আধার। উন্নয়নের সিঁড়ি গড়তে গড়তে উন্নয়নের হিমালয় গড়া যাবে। তারণ্যশক্তি থাকবে সঠিকপথেই- নিশ্চিন্তে, আনন্দে।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close