রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৩ মার্চ, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা জরুরি

রমজান মাসে আমাদের নানা রকম প্রস্তুতি নিতে হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ব পায় খাদ্যদ্রব্যের পর্যাপ্ততা ও প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। কিন্তু রোজার আগেই বাজারে বেশ কিছু পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। প্রতি বছর রোজার আগে কিছু নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রশ্ন করা যেতে পারে, নিয়ম করে রোজার মাসে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে কেন? এর সহজ উত্তর হচ্ছে, রোজার সময় সরবরাহের বিপরীতে চাহিদা বেড়ে যায়, আর সে কারণেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। শুধু তা-ই নয়, এমনও হতে পারে যে রোজার মাসে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি ব্যবসায়ীদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আবার এমনও হতে পারে, ভোক্তার অধিকার রক্ষায় যেসব আইন আছে, সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নেই। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আবার আরেক শ্রেণির মানুষকে দেখা যায় হুড়োহুড়ি করে জিনিসপত্র কিনতে। এই প্রবণতাও বাজারকে অস্থির করে তুলতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, বাজারে ভোক্তাদেরও ভূমিকা রয়েছে। পণ্যের দাম বেড়ে যাবে- এমন আশঙ্কা থেকে রমজান মাস আসার আগেই অনেকে ছোটখাটো মজুদ গড়ে তোলে। এতে হঠাৎ করে বাজারে চাহিদা বেড়ে যায় এবং ব্যবসায়ীরা এই বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা প্রায় ১৮০ কোটি মুসলমানের জন্য পবিত্র রমজান বয়ে আনে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের বার্তা। আত্মশুদ্ধি ও মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় এই এক মাস ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। রমজান মুসলমানদের ত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির মাস হলেও দেখা যায়, অনৈতিকভাবে প্রতি বছর রমজান মাসে বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে যায়, বিষয়টি যেন একটি স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এর বিপরীত চিত্রের দেখা মেলে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এসব দেশ রমজান উপলক্ষে বড় বড় চেইনশপ থেকে শুরু করে ছোট দোকানে দেয় বিশাল বিশাল ছাড়।

এমনকি ক্রেতাদের কে কত বেশি মূল্যছাড় দিতে পারে সেটা নিয়ে চলে রীতিমতো প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় ছাড়ের মাত্রা কখনো কখনো ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। মূলত রোজাদারের অর্থকষ্ট লাঘবের পাশাপাশি অধিক সওয়াবের আশায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসে এমন ছাড় দেন বিক্রেতারা। ক্রয়ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নাগালে রাখতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানোর ঘোষণা মানবিক গুণাবলির একটি অংশ বৈকী। রমজানে শুধু পণ্যের মূল্যছাড়ই নয়, সৌদি সরকার এবং বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও দেওয়া হয় বিশেষ সুবিধা। রাতে কাজ এবং অন্যান্য সময়ের তুলনায় কর্মঘণ্টা কমানো হলেও বেতন-বোনাসে কোনো হেরফের হয় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের ধর্মীয় উপলক্ষ কিংবা উৎসবের সময় জিনিসপত্রের দাম কমোনার ঘোষণা দেয়। এসব উৎসব ঘিরে ইউরোপ-আমেরিকায় ছাড়ের হিড়িক পড়ে যায়। মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হয় উৎসব। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সাধারণ মানুষ বছরভর এ সময়টার জন্য অপেক্ষা করেন। এ সময় তারা সারা বছরের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে রাখে। অবাক করার বিষয় হলো, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়; তবু রমজান উপলক্ষে অনেক দেশে পণ্যসামগ্রীর দাম কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র অন্যরকম। এর প্রতিকার দরকার, দরকার রোজায় প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য সহনীয় ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ। রমজানে স্বাভাবিকভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের চাহিদা বেড়ে যায়। রমজানের পূর্বমুহূর্তে সঠিক তদারকি এবং পরিকল্পনা না নিলে বাজারে আগুন লেগে যায়। সবকিছুর দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায়। ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন অসাধু চক্র সিন্ডিকেট তৈরি করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। পণ্য কেনার বিভিন্ন অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করে। সঠিক দিকনির্দেশনা, পরিকল্পনা, বাজার মনিটরিং এবং জবাবদিহি না থাকায় বরাবরই একই ঘটনা ঘটে।

করোনার ভয়াল থাবা পেরিয়ে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু। তার ওপর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। সমাজের বৃহৎ একটা অংশ অর্থনৈতিকভাবে দিশাহারা। তবুও সবার মধ্যে একটা ইচ্ছে থাকে, রমজানে অন্তত পরিবার পরিজনকে সঙ্গে নিয়ে ভালোভাবে খেয়েদেয়ে সময় কাটাবে। কিন্তু যখন দেখে রমজানের আগেই বাজারে দ্রব্যমূল্যে আগুন তখন মাথায় হাত রাখতে হয়। করোনা সংকট, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আমাদের অর্থনৈতিক সংকট সবাইকে ভয়াবহ অবস্থায় ফেলছে। ডলার সংকট হওয়ার ফলে আমদানি সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষুদ্র এবং মাঝারি মানের কোম্পানিগুলো বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমদানি করতে পারছে না। ফলে দিন দিন সব আমদানি পণ্য বড় কোম্পানির হাতে স্টক হয়ে যাচ্ছে। যেটার সঠিক তদারকি না করলে বাজারে দাম বৃদ্ধি এবং বড়সড় সংকট তৈরি করতে পারে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে।

যেকোনোভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হাতের নাগালে রাখতে হবে। সরকারের উচিত হবে রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্য সংগ্রহ করে রাখা, কেউ যেন কালোবাজারি, অসাধু সিন্ডিকেট তৈরি করতে না পারে সে ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া এবং অনুযায়ী আইনের সঠিক ও সুষ্ঠু প্রয়োগ বাস্তবায়ন করা একান্ত প্রয়োজন। করোনায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের জন্য আরেকটি সমস্যা। দেশে এত বড় বাজার, যা শুধু আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ন্যায্যতার মূল্যবোধ দিয়ে গড়ে তুলতে না পারলে দ্রব্যমূল্য কেন, কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। সবকিছুর দাম বাড়ায় সংসার খরচ বেড়ে গেছে। যে কারণে আয়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের পেছনে। চাহিদার সঙ্গে দাম যাতে না বাড়ে, সে জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো দৃশ্যত কিছু বিশেষ ব্যবস্থাও নিয়ে থাকে। তবে আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, এসব ব্যবস্থা বাজার নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না।

এটা স্পষ্ট, করোনা-দুর্যোগে অনেকের আয়-রোজগার কমে গেছে, অনেকেই হয়েছেন কর্মহীন। বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে যাতে বাজারকে অস্থিতিশীল করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখার কথা জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক করছেন কর্মকর্তারা। অবশ্য এসব তৎপরতায় তেমন কোনো সাফল্য আমরা দেখি না। বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পণ্য বিপণন, বাজার মনিটরিংসহ যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে এগুলো যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য পরিবহন নির্বিঘ্ন রাখতে বিশেষ করে কৃষিপণ্যের সরবরাহে যাতে কোনো বাধার সৃষ্টি হতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের। এর বাইরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে। অর্থনীতির সূত্র মতে, উৎপাদনব্যয় ছাড়াও জিনিসপত্রের দাম বাজারের চাহিদা জোগানের ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মূলে বহুবিধ কারণ রয়েছে- স্বার্থপরতা, অসাধু ব্যবসায়ী সমাজবিরোধীদের তৎপরতা, অর্থলোভী মানুষের অমানবিক আচরণ। তা ছাড়া প্রাকৃতিক কারণে অর্থাৎ অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টির কারণে জমিতে আশানুরূপ ফসল উৎপাদিত না হলে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যায়। আবার কৃষি ও শিল্প-কারখানাগুলোর উৎপাদনে সীমাবদ্ধ এবং বিদেশি মুদ্রার অভাবে পণ্যদ্রব্য চাহিদা পরিমাণ আমদানি করা সম্ভব না হলে চোরাকারবারি, মজুদদারি ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ গ্রহণ করে। তারা জিনিসের কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে, ফলে দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। পণ্যমূল্য নির্ধারণে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ আইনের আওতায় দ্রব্যমূলের মূল্য নির্ধারণ, চোরাকারবারি প্রতিরোধ এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যেতে পারে। পরিশেষে বলব, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে পবিত্র মাসে এমন অমানবিক কাজটি কেন হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। দেশে ব্যবসায়ীদের ৯০ ভাগেরও বেশি মুসলমান, মুসলমান হয়েও পুণ্যের মাসে অপুণ্যের এমন কাজ তারা কীভাবে করেন? এর প্রতিকার দরকার, দরকার রোজায় প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য সহনীয় ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close