দীপংকর গৌতম

  ২২ মার্চ, ২০২৩

বিশ্লেষণ

বীর মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণা রহমানের জীবন-সংগ্রাম

শৈশবে কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র একতায় অনেকের ভেতরে দেখা যেত এক মহীয়সী সংগ্রামীর মুখ। ইস্পাত দৃঢ় হাতে মুষ্টিবদ্ধ হাতে স্লোগান দিচ্ছেন। আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল যার প্রাত্যহিক বিষয়, তারপর সংসার সামলানো ইত্যাদি। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর বিশ্বেও কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে পরিবর্তন হয়, তার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বিলোপবাদের হাতে পড়ে। সেখান থেকে পার্টিকে যারা ধরে রাখে তিনি তাদের একজন। আমি গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকা আসার পরে পার্টি অফিসে গেলে তার সঙ্গে দেখা হতো। মায়ের স্নেহে ছোটদের ভালোবাসতেন। ভীষণ বিনয়ী ও লড়াকু। যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থাকতেন। আমি তখন উদীচী করি। আজকের কাগজের কাজ সেরে উদীচীতে আসি। তারপর এই মহীয়সী নারীকে মাঝেমধ্যেই গোপীবাগ রেলগেটে পৌঁছে দিয়ে আমি সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজের গলিতে চলে যেতাম। তার বড় মেয়ে সৈয়দা অনন্যা রহমানসহ আমরা সংগীত বিভাগে কাজ করতাম। প্রতিদিনের বিপ্লবী এই মহীয়সী নারীকে আমরা সংগঠন করার কারণে আপা বলে ডাকলেও তিনি আমাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। আমি গোপীবাগ এলাকায় থাকার কারণে দেখতাম সব মানুষ তাকে আভূমিনত শ্রদ্ধা করে। কার কী খেতে পছন্দ? কে কোন সংকটে আছে? কার ঘরে ডাক্তার দেখানোর কেউ নেই- সেসব মানুষ তার কাজের অংশ। এলাকার মানুষের পরম শ্রদ্ধেয়া তিনি। তার জীবনটাই সংগ্রামের ইতিহাসে ভরা। জীবনে কোনো আপস করেননি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষ-পেশাজীবীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন তিনি। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ কালরাতে বাংলাদেশের নিরীহ ঘুমন্ত মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়- সেই যুদ্ধে যেসব মা-বোন সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন কৃষ্ণা রহমান তাদের একজন।

কৃষ্ণা রহমানের অতীত ইতিহাসও সংগ্রামের স্রোতোধারায় প্রোজ্জ্বল। খুলনায় তার জন্ম। তার বাবা ও কাকা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ এক রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্য দিয়েই তিনি বড় হয়েছেন। শৈশবে পড়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার জীবনী। সেসব পড়ে আলোড়িত হয়েছেন তিনি। নিজের বোঝাপড়া থেকে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন শ্রমিক-মেহনতী মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে। তারপর আর পিছু তাকাননি। খুলনা পিটিআই স্কুলে তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হলেও ১৯৬২ সালে। সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের শাসন আমলে শরীফ কমিশনের নেতৃত্বে যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধেই ৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল। গড়ে উঠেছিল দুর্বার আন্দোলন। সেই ধর্মঘট পালনকালেই মিছিলে গুলি করে পুলিশি এই হত্যাকাণ্ডের সূচনা হয়। আন্দোলনের তীব্রতায় বেগতিক হয়ে সামরিক শাসক আইয়ুব খান শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ৬২ শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত হয় যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর বাঙালি জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। শিক্ষা আন্দোলন যখন প্রকট আকার নিয়েছে, তখন তিনি সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে সংগ্রামের ব্রত নিয়ে ফেলেন। ছাত্র ইউনিয়নের একজন কর্মী হিসেবে শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী খান এ সবুরের উসকানিতে খুলনায় দাঙ্গা সৃষ্টি হয় এবং সেই দাঙ্গায় বহু লোক মারা যায়। ওই সময় তিনি শান্তি মিছিল করেন, গান গেয়ে টাকা তোলেন এবং রুটি বিতরণ করেন। ১৯৬৬ সালে খুলনায় ডায়রিয়া মহামারি আকার ধারণ করলে হাজার হাজার মানুষ মহামারি আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ওই সময় তিনি ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছে দিতেন। এভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে একপর্যায়ে তিনি নিজেও আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে কৃষ্ণা রহমান যথারীতি অংশ নেন। সে সময় সব মিটিং-মিছিলে থাকার কারণে তার নামে হুলিয়া জারি হলেও সব উপেক্ষা করে আন্ডার গ্রাউন্ডে গেলেও তিনি সক্রিয় থাকেন। আসে মুক্তির ডাক- হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্নে উত্তাল দেশ। আর সেই উত্তাল স্রোতে ঝাঁপ দেন এই মহীয়সী নারী। পাকিস্তানের খোলস ভেঙে স্বপ্ন দেখেন নতুন দেশ, নতুন মানচিত্রের।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ খুলনা শহরে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকবাহিনী। তাদের নারকীয়তা যেকোনো বর্বরতাকে হারিয়ে দেয়। ১ এপ্রিল ছাত্রলীগের নেতা কামারুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে একটি দল গল্লামারী রেডিও স্টেশন দখল করতে গেলে কিন্তু মাত্র কয়েকটা থ্রিনট থ্রি রাইফেল সঙ্গে থাকায় কাজটি হয়নি। বরং দলের বেশির ভাগই পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হয়। এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নারকীয় হত্যাকাণ্ড শুরু করলে ওই রাতেই কৃষ্ণা রহমান তার পরিবারের সঙ্গে বাগেরহাটের কারাপাড়ায় চলে যান। কারাপাড়া থেকে চিতলমারী যাওয়ার পথে খরচ খালি গ্রামের মালেক মোল্লার বাড়িতে আশ্রয় নেন। ওই সময় চিতলমারীতে বিডিআর পুলিশ এবং সাধারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে

হাবিব বাহিনী নামে একটি মুক্তিবাহিনী গঠন করে। কৃষ্ণা রহমান চিতলমারী পৌঁছালেই ওই হাবিব বাহিনীর কমান্ডার হাবিব তাকে যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক কি না জানতে চান। গেলে তাদের কাছে ট্রেনিং নিতে পারেন বলে জানান। চিতলমারী বাজারে খড়মখালী নামে একটা জায়গায় অস্ত্র চালনার ট্রেনিং হতো। সেখানে কৃষ্ণা রহমান ২০ দিনের ট্রেনিং নেন। সে সময় রাজাকাররা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। চিতলমারী ছিল হিন্দু অধ্যুষিত একটি এলাকা। রাজাকাররা হিন্দু বাড়িতে অত্যাচার, লুটপাট, ধর্ষণ করত। তাদের অত্যচারে সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তারপর মুক্তিবাহিনীর একটি দল রাজাকারদের ওপর হামলা করে সে দলে কৃষ্ণা রহমান ছিলেন। জয় তাদেরই হয়। তারা রাজাকারদের সব অস্ত্র ছিনিয়ে নেন। এ বিজয়ের আনন্দ আজও তাকে উদ্বেলিত করে। এরপর কয়েক দিন হাঁটতে হাঁটতে ভারতে চলে যান। সে স্মৃতিও দুঃসহ। মানুষের অজস্র লাশ মাড়িয়ে পথচলা। সে বিভীষিকা বর্ণনা করার মতো নয়। অ্যালেন গিনসবার্গের কবিতার প্রেক্ষাপট সারা দেশজুড়ে। শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে কমিউনিস্ট পার্টির একটা মিছিল চোখে পড়লে তিনি যেন ভরা অন্ধকারে একটি আলোর ফুলকি খুঁজে পান। তার এত পথপরিক্রমার ক্লান্তি ধীরে ধীরে উবে যাচ্ছে। মনে হয় জায়গা পেয়েছি। তারপর মিশে যান তাদের সঙ্গে। কলকাতার পদ্মপুকুরে লেনিন স্কুলে কৃষ্ণা রহমানের জায়গা হয়।

সেখানে দেখা হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড ভবানী সেন। কৃষ্ণা রহমান তার সঙ্গে দেখা করেন। এরপর রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে ইলামিত্রের বাসায়। সেখান থেকে তিনি কৃষ্ণ রহমানকে নিয়ে যান ৮নং থিয়েটার রোডে। যেখানে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বসেন। কৃষ্ণা রহমানকে তাজউদ্দীন আহমদ চিঠি লিখে পাঠিয়ে দেন ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক মন্ত্রী কামারুজ্জামানের কাছে। সেই চিঠি নিয়েই বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নাম লেখেন এবং সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাজেদা চৌধুরী তখন নারীদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণের জন্য গোবরা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত ছিলেন। জুন মাসে তিনি গোবরা ক্যাম্পে যান এবং তখন থেকেই তিনি কাজ করতে শুরু করেন। গোবরা ক্যাম্পে অবস্থানকালে তিনি তিন ধরনের কাজ করেছেন। প্রথমত, জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণ, দ্বিতীয়ত গোবরা ক্যাম্পে তিনি নার্সিং প্রশিক্ষণ প্রশিক্ষণ নেন এবং তৃতীয়ত সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। এখানে তিন ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন সবাই। এ ছাড়া তার নিজস্ব দক্ষতা ও যোগ্যতার গুণে তাকে বাড়তি কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, যেমন : যেসব মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল, তাদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব ছিল তার ওপরে।

এ প্রসঙ্গে তিনি গীতা কর এবং ডাক্তার লায়লার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। গোবরা ক্যাম্পে অবস্থানকালে কৃষ্ণা রহমানকে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যেতে হতো। ক্যাম্পের ৪০০ জন মেয়ের নিয়মিত বাজার করতে হতো। তখন আবদুর রাজ্জাক রাফি, আক্তার ডলি, আইভি রহমান, ফনি ভূষণ মজুমদার, বদরুন্নেসা আহমেদ, নুরজাহান মুরশিদ, মনোরমা মাসিমা, ক্যাম্পে নিয়মিত আসতেন। ইলা মিত্র, মিরা দে, ফুলরেণু গুহ, প্রতিভা বসু এদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। গোবরা ক্যাম্পে থাকার সময়ে তিনি যে জরুরি কাজটি করতেন তা হলো এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে সংবাদ বহন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিসেনাদের বিজয়ের খবরও তিনি বিভিন্ন ক্যাম্পে আনা-নেওয়া করতেন। এই বীর মুক্তিসংগ্রামী দেশে এসে তার রাজনৈতিক দলের কাজ শুরু করেন। মিছিল-মিটিং-সভায় তার উপস্থিতি ছিল যথারীতি এবং গোপীবাগ এলাকার মানুষ হয়ে ওঠে তার সন্তান ভাই-বোন। এলাকার মানুষের উপকারে নিবেদিত এই বীরযোদ্ধা মনে করে মুক্তির সংগ্রাম সহসা শেষ হয় না। তিন সন্তান, গোপীবাগের জনগণ নিয়ে কাটে তার দিন-সময়। মুক্তিসংগ্রামী কৃষ্ণা রহমানের জীবন-সংগ্রাম ছোটখাটো নয়। কিন্তু এখনো সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত তিনি। চারদিকে কত লোকের অঢেল সম্পত্তি কত দ্রুত হয়েছে। তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি আছেন। এ ব্যাপারে তার কোনো আক্ষেপ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি স্বভাবসুলভ হাসিতে বলেন, কই খারাপ নেই তো- দেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের সঙ্গে থেকে এর চেয়ে ভালো আর দরকার কী?

লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close