মোতাহার হোসেন

  ২১ মার্চ, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

বঙ্গবন্ধুচর্চা ও গবেষণার গুরুত্ব

ইতিহাসের রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু আজ শুধুই একটি নাম নয়, বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীনতা, একটি দেশ, একটি স্বাধীন মানচিত্র। বাংলাদেশের স্বাধিকার থেকে মহান স্বাধীনতা অর্জনে মহানায়কের ভূমিকায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশেরই জন্ম হতো না। তাই বলা হয়ে থাকে- ‘বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ’ বঙ্গবন্ধু মানেই জাতির মুক্তি। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া খোকা (বাবা-মায়ের দেওয়া ডাক নাম) পরে হয়ে ওঠেন এ দেশের জাতির পিতা। দিন যতই যাচ্ছে ততই দেশ-বিদেশে বঙ্গবন্ধুপাঠ, তাকে নিয়ে গবেষণা, চর্চা হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে গবেষণা ও চর্চার জন্য বিশ্বে বাংলাদেশের অন্তত ৮১টি বিদেশি মিশনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্নার। এ ছাড়া অন্তত পাঁচটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’। পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর সব নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘরসহ নানা প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপনের পদক্ষেপ নেওয়ার তথ্য খবরে প্রকাশিত হয়েছে। এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে মহৎ ও অত্যন্ত সময় উপযোগী। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির নেতা বা কাণ্ডারি ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নেতা। সে কারণে বিশ্বের দেশে দেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার জীবন, সংগ্রাম, আদর্শ প্রভৃতি নিয়ে চর্চা ও গবেষণা অপরিহার্য।

মূলত বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যেটা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সেটা হলো, তার ওপর সঠিক পর্যালোচনামূলক লেখা, যা ইংরেজিতে লিখে সারা বিশ্বে দূতাবাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া। কারণ বঙ্গবন্ধু-সংক্রান্ত যেসব বই প্রকাশ করা হয়েছে বা পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই তথ্যনির্ভর নয়। অনেকটা আবেগাশ্রিত। এগুলো দিয়ে বিদেশের কাছে বঙ্গবন্ধুকে সঠিকভাবে তুলে ধরা যাবে না। এসব কারণেই দেশের স্কুল-কলেজে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা দরকার। বঙ্গবন্ধুর ওপর শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য মানের বই থাকা প্রয়োজন। সেটি বাংলা এবং ইংরেজি দুটো মাধ্যমেই থাকা বাঞ্ছনীয়। কেননা ইংরেজি মাধ্যমের পড়াশোনায় বঙ্গবন্ধু বা বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানানো হয় না। এসব কাজের জন্য সরকারিভাবে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত করার জন্য কী কী উদ্যোগ নেওয়া যায় সে ব্যাপারে সরকার ওই কমিটির পরামর্শ নিতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘পিপলস হিরো’ নামে একটি বই বের করেছে। এ ধরনের আরো ব্যাপক প্রকাশনা দরকার। বঙ্গবন্ধুকে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়ে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ভারত, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্যসহ পাঁচটি দেশে এটি সম্পন্ন হয়েছে। আরো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এ প্রক্রিয়া চলমান। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ওপর বিভিন্ন ধরনের অডিও-ভিডিও ও তথ্যচিত্র থাকবে। মিশনগুলোর মধ্যে কিছু জায়গায় বঙ্গবন্ধু কর্নারকে বড় পরিসরে তৈরির কার্যক্রমও চলমান। ইরাকের বাগদাদ মিশনে এ কাজটি চলমান রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণার জন্য ‘ফেলোশিপ’ চালু করা হয়েছে। বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ফেলোশিপ চালু করা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশিরা গিয়ে কাজ করছে বঙ্গবন্ধুর ওপর। আবার বিদেশ থেকেও বেশ কয়েকজন ফেলোশিপ পেয়েছে, যারা বাংলাদেশে এসে বঙ্গবন্ধুর ওপর কাজ করছেন। সার্বিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিশদ চর্চা ও গবেষণায় সময় লাগবে। বঙ্গবন্ধুর ওপর এরই মধ্যে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ডকুমেন্ট তৈরি হচ্ছে। যেমন : দশ ভলিউমের ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট বের হয়েছে, যেটা খুবই উল্লেখযোগ্য, যা আগে ছিল না, অতি সম্প্রতি বের হয়েছে। এই দশ ভলিউম ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট ধরে কাজ করতে গবেষকদের সুবিধা হবে। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়া চীন’, ‘বঙ্গন্ধুর ভাষণ’, ‘সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু’, ‘বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা’, ‘বঙ্গবন্ধুর তিন প্রজন্মের রাজনীতি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : বহুমাত্রিক, বিশ্লেষণ’, ‘অনশ্বর বঙ্গবন্ধু’, এ ছাড়া আমাদের বাংলাদেশ ফরেন পলিসি ‘পিডিয়া’ বের করেছে। ফরেন পলিসি-সংক্রান্ত তার যেসব ভাষণ সেগুলো প্রথমবারের মতো একত্র করে গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছে। এই প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণগুলো যত বের হবে ততই গবেষকদের সুবিধা হবে। শুরু হয়েছে, হয়তো আরো বড় আকারে সময় নেবে। এ ছাড়া যেকোনো গবেষণায় যথেষ্ট সময়ও লাগে। দেশে এবং দেশের বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুকে পাঠ্যপুস্তকে উপস্থাপন ও গবেষণা চলছে। বিশ্বের অনেক দেশই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রিসার্চ সেন্টার করতে আগ্রহী। তাকে নিয়ে প্রায় নিয়মিত মিশনগুলোতে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে দেশে বিভিন্ন দেশের পাঁচজন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এসেছিলেন। এ ছাড়া ওই সময়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাণী দিয়েছিলেন। সেই বাণীগুলো দিয়ে একটি বই ছাপানো হয়েছে। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তারা কী বলেছেন, সে বিষয়গুলো ওই বইয়ে উল্লেখ রয়েছে। বইটির ই-ভার্সনও ওয়েবসাইটে রয়েছে।

ইতিহাস বিশ্লেষণে ও পাঠে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মধ্যে সুদীর্ঘ ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিহাস একই সুতোয় গাঁথা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছয় দফার আন্দোলন হয়ে সর্বশেষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামে মহানায়কের ভূমিকায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন ইতিহাসবিদরা। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই ছিল দেশকে স্বাধীন করার সুস্পষ্ট ঘোষণা ও নির্দেশনা। অর্থনৈতিক মূল্যবোধ ও মননচর্চার সামগ্রিক মুক্তির ইঙ্গিত দিয়েই বঙ্গবন্ধুর আধুনিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশ আজ উন্নত বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো সক্ষমতা অর্জন করছে। সব খাতে অভাববনীয় উন্নয়নের ধারা দেখে অনেক দেশই এখন বাংলাদেশকে নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছে। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলায় রূপ নিচ্ছে। তাই বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অবদান-অগ্রযাত্রার স্বপ্নকেও বিশ্বজুড়ে এগিয়ে নিতে হবে- এমনটাই মনে করেন ইতিহাসবিদরা।

প্রসঙ্গত, লর্ড হেনরি টেম্পল পামারস্টন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৮৫৫ থেকে ১৮৬৫ পর্যন্ত। তিনি সুয়েজ খাল নির্মাণের বিরোধিতা করেন। তিনি আমেরিকার গৃহযুদ্ধে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেন। তিনি তার দেশের পররাষ্ট্রনীতির ওপরে একটি বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন, যা আজ অবধি চিন্তার খোরাক জোগায়। তিনি বলেছিলেন, ‘ব্রিটেনের অনেক বন্ধু আছে, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আছে এবং থাকবে। কিন্তু সত্যি করে বলতে গেলে আমাদের কোনো স্থায়ী বন্ধু বা কোনো স্থায়ী শত্রুও নেই। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র হলো আমাদের জাতীয় স্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থই হলো আমাদের স্থায়ী বন্ধু। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ঠিক অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর।

বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শিশুতীর্থ’ কবিতার ৭ অনুচ্ছেদের কিছু অংশ এখানে প্রাসঙ্গিক হওয়ায় তা উল্লেখ করছি “কেউ বা অলক্ষিতে পালিয়ে যেতে চায়, পারে না;/অপরাধের শৃঙ্খলে আপন বলির কাছে তারা বাঁধা।/পরস্পরকে তারা শুধায়, ‘কে আমাদের পথ দেখাবে।’/পূর্ব দেশের বৃদ্ধ বললে, ‘আমরা যাকে মেরেছি সেই দেখাবে।’/সবাই নিরুত্তর ও নতশির।/বৃদ্ধ আবার বললে, ‘সংশয়ে তাকে আমরা অস্বীকার করেছি,/ক্রোধে তাকে আমরা হনন করেছি,/প্রেমে এখন আমরা তাকে গ্রহণ করব,/কেননা, মৃত্যুর দ্বারা সে আমাদের সকলের জীবনের মধ্যে সঞ্জীবিত, সেই মহামৃত্যুঞ্জয়।’/সকলে দাঁড়িয়ে উঠল, কণ্ঠ মিলিয়ে গান করল, ‘জয় মৃত্যুঞ্জয়ের জয়।” ঠিক বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। অন্যদিকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাঙালি অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লিখেছেন- ‘সুচিন্তিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা যে সম্ভব, শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রমাণ সমগ্র পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্বিকল্প নতুন আদর্শের নবতর নিলয় হয়েছে বাঙালির আজন্ম লালিত গন্তব্য। সৈয়দ শামসুল হকের ভাষায়- ‘যেখানে ঘুমিয়ে আছো, শুয়ে থাকো বাঙালির মহান জনক তোমার সৌরভ দাও, দাও শুধু প্রিয়কণ্ঠ শৌর্য আর অমিত সাহস টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে আমাদের গ্রামগুলো তোমার সাহস নেবে, নেবে ফের বিপ্লবের দুরন্ত প্রেরণা। বিশ্বের মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীর জ্যোতির্ময়-মাঙ্গলিক ও নান্দনিক শুভক্ষণে দেশে কদর্য আবরণে আচ্ছাদিত সব অশুভ অন্ধকারের ধূসর কুয়াশা তিরোধানে জাতি নবতর প্রেরণায় উজ্জীবিত ও উদ্ভাসিত হওয়ার প্রত্যাশা করছি।’

লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক- বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close