ইলিয়াজ হোসেন
বিশ্লেষণ
বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে যখন রবার্ট ক্লাইভ ফরাসি অধিকৃত চন্দননগর আক্রমণ করেন, তখন ব্রিটিশ সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এবং ফরাসি সৈন্যদের সাহায্য করার জন্য নবাব সিরাজউদ্দৌলা হুগলির ফৌজদার নন্দনকুমারকে আদেশ করেন। কিন্তু নন্দনকুমার ইংরেজদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়া তো দূরে থাক, নবাবের অপর একদল সৈন্যকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বিরত রাখলেন। তিনি যে ইংরেজদের কাছ থেকে মোটা টাকা ঘুষ পেয়ে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তা কেবল অনুমান নয়, সমসাময়িক ইংরেজ লেখকরাও এটি স্বীকার করেছেন। সেই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে এটা মোটেও অসংগত নয় যে, নন্দনকুমার ইংরেজদের বাধা দিলে তারা চন্দননগর দখল করতে পারত না এবং পলাশীর যুদ্ধ ও সিরাজউদ্দৌলার পতনও ঘটত না।
সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে বাংলার নবাব হওয়ার জন্য মীরজাফর ইংরেজদের সঙ্গে ১৭৫৭ খ্রি. গোপন যে সন্ধি করেন তার একটি শর্ত এমন ছিল, সুবা বাংলাকে ফরাসি ও অন্য শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে ইংরেজ কোম্পানি উপযুক্ত সৈন্য নিযুক্ত করবে এবং তার ব্যয় বহনের জন্য পর্যাপ্ত জমি কোম্পানিকে দিতে হবে। অন্যদিকে মীর কাশিম ইংরেজদের সঙ্গে যে গোপন সন্ধি দ্বারা মীরজাফরকে সরিয়ে নিজে নবাব হলেন তার শর্ত অনুসারে তিনি ইংরেজ সৈন্যদের ব্যয়নির্বাহের জন্য বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামের রাজস্ব কোম্পানিকে দিলেন। ১৭৬৫ সালে সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ইংরেজ কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ান নিযুক্ত করলেন। ফলে সমগ্র দেশের রাজস্ব আদায়ের ভার ইংরেজ পাইল। সুতরাং এ কথা বললেও অত্যুক্তি হবে না ১৭৬৫ সালে কোম্পানির রাজত্ব এখান থেকে শুরু হলো।
ভারতবর্ষের সঙ্গে বাণিজ্য ইউরোপীয় বণিকদের জন্য একাধারে জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সাধারণত বণিকরা কোম্পানি স্থাপন করত এবং তাদের দেশের সরকার এগুলোকে অনুমোদন দিত। ভারতবর্ষে পর্তুগিজ অভিযানের সাজসরঞ্জাম ও অর্থ জুগিয়েছিলেন পর্তুগালের রাজা। ওলন্দাজ এবং ব্রিটিশ কোম্পাানিগুলোও তাদের সরকারের কাছ থেকে সনদ পেয়েছিল। সতেরো শতকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ব্রিটিশ সরকার ক্রমান্বয়ে বেশি বেশি অধিকার মঞ্জুর করেছিল। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত কয়েকটি সনদের কল্যাণে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর অবস্থান খুবই মজবুত হয়েছিল। ১৬৫৭ সালে ক্রমনওয়েল সনদ এবং ১৬৬১ সালের সনদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে যুদ্ধ ঘোষণা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার অধিকার, ১৬৮৬ সালের সনদ কোম্পানিকে মুদ্রা তৈরি ও সামরিক দণ্ডবিধিসহ নিজস্ব সৈন্য ও নৌবাহিনী রাখার ক্ষমতা দিয়েছিল। ১৬৯৮ সালে কয়েকজন বণিক ব্যক্তিগত মালিকানাধীনে আরো একটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করলে এবং দুটি কোম্পানি একীভূত হয়ে নতুন নাম হয় ইউনাইটেড কোম্পানি অব দ্য মার্চেন্ট অব ইংল্যান্ড ট্রেডিং টু দিস ইস্ট ইন্ডিয়া। দুটি কোম্পানির পুরাতনটিকে বলা হতো লন্ডন কোম্পানি এবং নতুনটিকে বলা হতো ইংলিশ কোম্পানি। এই ইউনাইটেড কোম্পানি যৌথভাবে বাংলায় তাদের দখল বজায় রাখার চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত তারা এতে সার্থকতা লাভ করে। ১৭০২ সালে কোম্পানি দুটোর মিলন ঘটলে ১৭০৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এটি অনুমোদন দেয়। সেদিন থেকেই ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানি কার্যকলাপ দ্রুত শুরু হয় এবং বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৬৩৯-৪০ সালে ব্রিটিশ কোম্পানি স্থানীয় শাসকের কাছ থেকে দখল করা করমণ্ডল উপকূলের মাদ্রাজ ছিল তাদের প্রধান ঘাঁটি। আঠারো শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ সেখানে একটি দুর্গ ও একটি বন্দর নির্মাণ করলে অচিরেই এটি একটি সমৃদ্ধ ও জনবহুল শহর হয়ে ওঠে। বাংলার কলকাতাই ক্রমে ব্রিটিশ কোম্পানির কার্যকলাপের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। দুর্বল সুবেদার ইব্রাহিম খানের আমলে ইংরেজ কোম্পানি কলকাতা নগরী প্রতিষ্ঠা করে। ১৬৯০ সালে এবং নিজ পণ্য গুদামগুলোর রক্ষার জন্য কোম্পানি সেখানে সেই সতেরো শতকেই একটি দুর্গ তৈরি করে। ইংল্যান্ড রাজা তৃতীয় উইলিয়ামের নামানুসারে দুর্গটির নাম দেয় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ। এই দুর্গ থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি বাংলায় তার কার্যাদি পরিচালনা করত। ১৭১৭ সালে ফারুকশিয়ার ব্রিটিশদের আরো ৪৮টি গ্রাম ইজারা দেন। মুঘলদের কোষাগারে বার্ষিক তিন হাজার টাকা নজরানা দেওয়ার শর্তে ব্রিটিশদের পণ্য শুল্কমুক্ত করা হয়। তা ছাড়া বাণিজ্য কেন্দ্রের প্রধান কর্তৃক প্রদত্ত দাস্তাক বলে শুল্ক দপ্তরের পরিদর্শন ছাড়াই ব্রিটিশদের মালপত্র চলাচলের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, তখন থেকেই এখানকার ব্রিটিশ রপ্তানিতে বাংলার পণ্যের অংশভাগ দ্রুত বাড়ছিল। কোম্পানির কর অচিরেই ১৭১৭ সালে ২ লাখ ৭৮ হাজার ৬০০ পাউন্ড থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৭২৯ সালে ৩ লাখ ৬৪ হাজার পাউন্ডে পৌঁছায়। ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং আইন প্রবর্তনের ফলে হেস্টিংসের সময় থেকে বাংলাদেশ-ভারতের ব্রিটিশ রাজশক্তির কেন্দ্রে পরিণত হলো। এ সময় বাংলার বাইরে চারটি বড় স্বাধীন রাজ্য ছিল মহারাষ্ট্র, মহীশূর, হায়দ্রাবাদ ও অযোধ্যা। ইংরেজরা প্রথম দুটিকে একাধিকবার যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং অন্য দুটির সঙ্গে সন্ধি করে এবং ত্রিশ বছরের মধ্যেই এই রাজ্যগুলোর ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করল। এভাবে বাংলাদেশে রাজ্য স্থাপনের ফলে ইংরেজ ক্রমেই সমগ্র ভারতের অধীশ্বর হলো।
শুভা সিংয়ের বিদ্রোহের সময় সুবাদার ইব্রাহিম খান ইংরেজদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়ে তাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদের ব্যবস্থা করতে বলেন। এই সুযোগে অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানির সঙ্গে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করেন এবং বড় বড় কামান বসান। আর এভাবে ইংরেজরা বাংলায় তথা সমগ্র ভারতে তাদের রাজত্বের ভিত্তি স্থাপন করে। বাংলা, বিহার ও ওড়িশা সমন্বয়ে গঠিত সুবা-ই-বাঙ্গালাই সর্বপ্রথম, যা ইংরেজদের রাজনৈতিক ক্ষমতার আওতাভুক্ত হয়। ১৬৩৪ সালে পিপলিতে একটি সমুদ্রবন্দরসহ বাংলায় কারখানা স্থাপনের জন্য ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাট শাহজাহানের নিকট থেকে অনুমতি লাভ করে। ১৬৫২ সালে সম্রাট শাহজাহানের কন্যা জাহানারা ভীষণভাবে অগ্নিদগ্ধ হন এবং তার আরোগ্য লাভের আশা ত্যাগ করেন। সম্রাট একজন ইউরোপীয় সার্জনের সহায়তা চেয়ে পাঠান। সুরাটের ইংরেজ কাউন্সিল হোপওয়েল নামক জাহাজের শাল্যচিকিৎসক জিব্রাইল বউটনকে প্রেরণ করে এবং তিনি সৌভাগ্যবসত যুবতী-যুবরাজ্ঞীকে এই দুর্ঘটনার কবল থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলেন। এই কাজের জন্য পুরস্কার দিতে চাইলে তিনি বলেন, ইংরেজদের বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্য করা এবং তার সঙ্গে কুঠি স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হোক। ফলে স¤্রাট ইংরেজদের বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি-সংবলিত একটি ফরমান জারি করেন। ১৬৬১ সালের এক নতুন চার্টার বলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দুর্গ নির্মাণ করা, সৈন্য নিয়োগ করা এবং অখ্রিস্টানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ক্ষমতা লাভ করে। ১৬৬৯ সালে সুরাটের প্রেন্সিডেন্ট এবং বোম্বের গভর্নর জেরাল্ড আঁগিয়ার কোম্পানির বাণিজ্যের তেজীভাব সুনিশ্চিত করার জন্য একটি কঠোর নীতি গ্রহণের সুপারিশ করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৬৮৭ সালে ফোর্ট সেন্ট জর্জের প্রেসিডেন্ট ও কাউসিলকে আদেশ দেওয়া হয়, যাতে এমন একটি সামরিক ও বেসামরিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার নীতি গ্রহণ করা হয় এবং মোটা অঙ্কের রাজস্ব জোগাড় করা হয়, যা দ্বারা সর্বকালের জন্য ভারতে একটি বিশাল, সুদৃঢ়, সঠিক ইংরেজ রাজস্বের ভিত্তি স্থাপন করা হয়।
ইংরেজিতে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হলো White Man's Burden বা শ্বেতাঙ্গদের বোঝা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আফ্রো-এশিয়ার যেসব দেশ আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক বা জোরপূর্বক ইউরোপীয় শক্তিবর্গের বা এক কথায় শ্বেতাঙ্গদের অভিভাবকত্বে দেওয়া হয় তারা এটিকে শ্বেতাঙ্গদের বোঝা হিসেবে বলে বেড়ায়। তবে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এসব দেশ তারা অনেক ষড়যন্ত্র ও শঠতার মাধ্যমে দখল করে নিয়েছে। কিন্তু বাহ্যিকভাবে বলে বেড়ায় ‘বোঝা’ হিসেবে। এর মূলকথা, তারা যাতে অভিভাবকত্বের নামে এসব দেশে তাদের পুরাতন সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ চালাতে পারে। এভাবেই তারা মধ্যপ্রাচ্যে মিসর, ফিলিস্তিন, ইরাক, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন ইত্যাদি দেশ দখল করে এবং পরবর্তী জাতিপুঞ্জের আশীর্বাদ নিয়ে এসব দেশের ওপর অভিভাবকত্বের ক্ষমতা লাভ করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা, বিহার, ওড়িশা, অতঃপর সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া দখলকেও ঠিক এভাবেই বিবেচনা করা হয়।
লেখক : প্রভাষক ও কলাম লেখক
"