তানজিব রহমান

  ১৯ মার্চ, ২০২৩

মতামত

ড. ইউনূসের রাজনীতি বিলাস ও কিছু প্রশ্ন

বাংলাদেশের মানুষের কাছে একজন নোবেল বিজয়ী হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বয়োজ্যেষ্ঠ ও সম্মানিত নাগরিক। ২০০৬ সালে তিনি যখন নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, সমগ্র বাংলাদেশ অবাক বিস্ময়ে উল্লাস প্রকাশ করেছিল। তিনি গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা হিসেবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তখন বাঙালি হিসেবে অমর্ত্য সেন কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মিলিয়ে পত্রপত্রিকায় নানা সংবাদ বেশ আলোচিত ছিল। কিন্তু বছর পেরোতে না পেরোতেই দেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত হলো ১/১১-এর সরকার। জরুরি অবস্থা জারি, রাজনীতি ও সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধসহ সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনীতির সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে শুরু করল। রাজনীতির মাঠ ফাঁকা করে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের জোর প্রচেষ্টা চলছিল। তখনই হাত কচলে গাল ভরা হাসি দিয়ে সামনে চলে আসেন আলোচিত ড. ইউনূস। যার পর থেকে যেন সমালোচনা তার পিছু ছাড়ছে না। গত ৭ মার্চ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হয় একটি খোলা চিঠি, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ৪০ বিশ্বনেতার লেখা ড. ইউনূসের পক্ষে এক পৃষ্ঠার পক্ষপাতমূলক সাফাই, যা নতুনভাবে তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

১/১১-এর সময় ড. ইউনূস সম্মান আর সৌহার্দের নোবেলকে বিসর্জন দিয়ে রাজনীতির ফাঁকা মাঠে গোল দিতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। তখন পেছনে ছিল তার মার্কিন বন্ধুদের জোর ও শক্তি। বলা হয়ে থাকে, হিলারি ক্লিনটন তার পারিবারিক বন্ধু। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যখন জরুরি অবস্থা জারি করে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তখন ড. ইউনূস রাজনৈতিক দল ‘নাগিরিক শক্তি’ গড়লেন কীভাবে? তখন দল গঠন ছিল তার রাজনীতি বিলাস! যা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ গ্রহণ করেনি। এর আগে কখনোই তাকে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ফখরুদ্দীন আহমেদ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন মার্কিন নীতির প্রশ্নে ইউনূস এবং ফখরুদ্দীন অভিন্ন মানসিকতার হবেন, হয়তো তাই পেছনের দরজা থেকে ড. ইউনূসকে সামনে আনা হয়েছিল।

বিতর্ক ডালপালা মেলতে শুরু করে যখন কিছু অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসকে উচ্চসুদের হারের জন্য দরিদ্রদের ‘রক্তচোষা’ হিসেবে অভিযোগ তোলেন। ক্ষুদ্রঋণ নিরীক্ষণকারী সংস্থা পিকেএসএফেএর চেয়ারম্যান ডক্টর কাজী খলীকুজ্জামান আহমেদ ক্ষুদ্রঋণকে বাংলাদেশের দরিদ্রদের জন্য ‘মৃত্যুর ফাঁদ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কেননা আমরা দেখতে পাই ক্ষুদ্র্রঋণের উচ্চসুদ বরং একজন গরিব মানুষকে নতুন নতুন ঋণের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। এ ঋণচক্র থেকে বেরোতে পারে না। ড. ইউনূস যত দিন পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (২ মার্চ ২০১১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সে সময় ঋণের কিস্তি শোধ না করতে পেরে ২৩৭ জন ঋণগ্রহীতা আত্মহত্যা করেন, ১ হাজার ৮১৫ ঋণগ্রহীতা কিস্তি পরিশোধ করতে না পেরে জেলসহ নানা আইনি জটিলতার মধ্যে পড়েন। এ খবর কি বিদেশি বন্ধুরা রেখেছেন?

খোলা চিঠিতে বিদেশিদের বক্তব্যগুলো একতরফা বলে মনে হয়েছে। খোলা চিঠিতে ড. ইউনূস প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকমের গ্রামীণফোনে করা বিনিয়োগ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হিসেবে দাবি করা হলেও গ্রামীণ টেলিকম নজিরবিহীন দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, যা প্রশ্ন উত্থাপিত করে? বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গ্রামীণ টেলিকম (জিটি) এবং এর পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে ৩,০০০ কোটি টাকার মানি লন্ডারিং মামলায় তদন্ত শুরু করেছে। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে কর্মচারীদের জন্য সংরক্ষিত লভ্যাংশের ৫ শতাংশ অপব্যবহার; আইনজীবীদের ফি এবং শ্রমিকদের বেতন থেকে অন্যান্য চার্জ হিসাবে ৬ শতাংশ অবৈধভাবে কাটা; কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিল থেকে ৪৫ দশমিক ৫২ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ এবং কোম্পানি থেকে ২, ৯৭৭ কোটি টাকা অবৈধভাবে পাচার করা। ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখে, শ্রম আইন লঙ্ঘনের জন্য ড. ইউনূস এবং অন্য তিনজনের বিরুদ্ধে কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগ কর্তৃক শ্রম আইনের ধারা ৪, ৭, ৮, ১১৭ এবং ২৩৪-এর অধীনে একটি মামলা করা হয়। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের শ্রম আইন লঙ্ঘনের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন যে তার প্রতিষ্ঠিত একটি সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান শ্রম আইন ভঙ্গ করেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে একটি চমকপ্রদ অভিযোগ উঠেছে যে তিনি তার বিরুদ্ধে গ্রামীণ টেলিকম ইউনিয়ন শ্রমিক ও কর্মচারীদের করা ১১০টি মামলা ২৫০ মিলিয়ন টাকায় বেআইনিভাবে নিষ্পত্তি করেছেন। ২০১৫ সালেও তিনি বিতর্কিত হয়েছিলেন যখন বাংলাদেশের রাজস্ব কর্তৃপক্ষ ১ দশমিক ৫১ মিলিয়নেরও বেশি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ কর পরিশোধ না করার জন্য তাকে তলব করেছিল। সরকারের প্রভাবমুক্ত থেকেই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদক, এনবিআর যেকোনো ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করবে তাতে বিদেশিদের কাছে নালিশ করতে হবে কেন?

২০১১ সালে ড. ইউনূসকে যখন দেশের অবসর আইন অমান্য করে ব্যাংকের এমডি পদ থেকে পদত্যাগ করার অনুরোধ এবং ‘উপদেষ্টা ইমেরিটাস’ হিসেবে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আপিল বিভাগে আইনি লড়াইয়ে নিজেকে প্রমাণিত করতে ব্যর্থ হন। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব বিষয়ে কী বলবেন বিদেশি ৪০ নাগরিক?

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশি-বিদেশি নানা পক্ষ বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির ব্যাপারে সক্রিয় হচ্ছেন তা রাজনীতিসচেতন মাত্রই সবাই জানেন ও আঁচ করতে পারেন। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে ক্ষমতার দৌড়ে নানা পক্ষ নানাভাবে হস্তক্ষেপ করতে বা করাতে চায় বৈধ বা অবৈধ উপায়ে। কেউ কেউ আবার সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে নানা রকম কৌশল কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। এতে যেমন আঞ্চলিক শক্তির একটি প্রভাব থাকে, তেমনি আন্তর্জাতিক শক্তিরও লাভ-ক্ষতির নানান সমীকরণ থাকে, যা বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সহজে অনুমান করা যায়। তবে বাংলাদেশের জন্য কল্যাণকর সিদ্ধান্ত এ দেশের সাধারণ জনগণই সব সময় নিয়ে থাকে এবং সেটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য বলে প্রমাণিত। ড. ইউনূস বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিচিত কোনো মুখ নন তিনি একজন অর্থনীতির অধ্যাপক, নোবেল বিজয়ী এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণের একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী ৪০ জন নাগরিকের স্বাক্ষরিত খোলা চিঠি ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হওয়ার জন্য বাংলাদেশি টাকায় অন্তত প্রায় ৭৮ লাখ টাকা খরচ হতে পারে! আর তাতেই প্রশ্ন উঠেছে ড. ইউনূসকে মহানায়ক বানানোর জন্য এ বিজ্ঞাপনের পেছনে লুকিয়ে থাকা ষড়যন্ত্রটি আসলে কী?

একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মনেও এ প্রশ্ন জাগবে- এমন প্রভাবশালী একটি পত্রিকায় কেন বিজ্ঞাপন দিয়ে ড. ইউনূসের মতো প্রভাবশালী লোকের সাফাই গাইতে হবে? একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদক সবার ব্যাপারেই তদন্ত করতে পারে। সরকার দুদককে পূর্ণ স্বধীনতা দিয়েছে। আর একটি তদন্তাধীন বিষয়ে বিদেশি ৪০ নাগরিকের অযাচিত হস্তক্ষেপ রাষ্ট্রীয় আইনকে কতটা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে? এর পেছনে নতুন কোনো ওয়ান-ইলাভেন নেই তো? পলাশী থেকে ধানমন্ডি বত্রিশ চলচ্চিত্রে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী দেখিয়ে ছিলেন দেশি-বিদেশি চক্র দূতাবাস কিংবা ঢাকার অলিগলিতে এক হয়ে কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল এবং এ দেশে তাদের গোলামি শাসন কায়েম করেছিল, এখনো ঠিক একই কায়দায় দেশ-বিদেশে দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র হচ্ছে কোনোটা প্রকাশ্যে আবার কোনোটা অপ্রকাশ্যে। তাই কারো রাজনীতি উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য ষড়যন্ত্রকে নয় বরং দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে সর্বাবস্থায় তাদের পাশে থাকাই যথার্থ।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close