শফিকুল ইসলাম খোকন

  ১৫ মার্চ, ২০২৩

মুক্তমত

জাতীয় পতাকা এবং আমাদের দায়িত্ব

যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশকে ভালোবাসেন? উত্তর আসবে ‘হ্যাঁ’। যদি প্রশ্ন করা হয়, জাতীয় পতাকাকে ভালোবাসেন? উত্তর আসবে ‘হ্যাঁ’। তেমনি যদি প্রশ্ন করা হয়, জাতীয় পতাকার আকার বা ব্যবহারের নিয়ম জানেন? উত্তরে...? একজন স্বাধীনচেতা মানুষ তথা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তার দায়িত্ব রয়েছে, জাতীয় পতাকার সম্পর্কে জানা, সম্মান দেখানো এবং নিয়মণ্ডকানুন যথাযথভাবে পালন করা। দায়িত্ব রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য জানা এবং সে অনুযাযী সংরক্ষণ করা ও মানা।

আমি একজন নতুন প্রজন্মের নাগরিক। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, মুক্তিযুদ্ধ করিনি। তবে মুক্তিযুদ্ধ আমাকে কাঁদায়-ভাবায়। সব সময় আমাকে ভাবিয়ে তোলে। যে জাতি জীবনের বিনিময় দেশ স্বাধীন করেছে, সে জাতি কখনোই হেরে যাওয়ার নয়; হারতে শেখেনি, হারতে পারেও না। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যতবারই শুনি ততবারই একটা মুগ্ধতা তাড়িত করে। প্রশ্ন করে, ‘তুমি মুক্তিযুদ্ধ দেখনি, মুক্তিযুদ্ধ করনি কিন্তু যা দিয়ে গেছি, তা কি তুমি সংরক্ষণ করেছো? সম্মান দিচ্ছো? নাকি সব পেয়ে ভুলে গেছো!’ বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির জীবনে সোনালি দিন হচ্ছে ১৯৭১ সালের মার্চের অগ্নিঝরা দিন। নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম আর আন্দোলনের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে একাত্তরের গৌরবময় দিনগুলো। কিন্তু আমরা কি সেই স্বাধীনতা নামক শব্দটি ভুলে যেতে বসেছি? আমরা কি সেই লাল-সবুজের পতাকাকে সংরক্ষণ করছি? ইতিহাস ও ঐতিহ্য কি বুকে আগলে রাখছি? আমি একজন নতুন প্রজন্মের নাগরিক হিসেবে মনে করি, না পারিনি, পারছিও না। প্রশ্ন হচ্ছে দায়িত্ব কার? কে সংরক্ষণ করবে? নতুন প্রজন্মকে জানান দেওয়ার দায়িত্বই বা কাদের? সেই দায়িত্ববোধ থেকে কতটুকুই দায়িত্ব পালন করছি, নতুন প্রজন্মের মধ্যে কতটুকু ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছি!

৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার যে স্বাধীনতা সূর্য অস্ত গিয়েছিল, তা একাত্তরের মার্চে আবারও উদিত হয়। বাঙালি পরাধীনতার শৃঙ্খল চূর্ণবিচূর্ণ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য স্বাধীনতার লড়াইয়ে শরিক হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেদিন সমগ্র জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। এ ধরনের ঐক্য আমাদের জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা এনে দেয় নতুন চেতনা এবং মূল্যবোধ। যে জাতি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে নিজের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করে, সে জাতি কোনো দিন পিছিয়ে থাকতে পারে না। নতুন প্রজন্মের জন্য অপেক্ষা করছে নতুন দিন, এক সুখী-সমৃদ্ধ-উন্নত বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে ‘আর আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, প্রতি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’ এ আহ্বান জানিয়েছেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই ডাক জাতির অসহযোগ আন্দোলনকে সশস্ত্র আন্দোলনের দিকে নিয়ে যায়। জনগণের অন্তরাত্মার প্রস্তুতি অনুভব করেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করার নৈতিক শক্তি পেয়েছিল বাঙালি জাতি।

একটি জাতীয় পতাকা একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়, স্বাধীনতাণ্ডসার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। জাতীয় পতাকা হলো জাতির আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা এবং শহীদদের সম্মানের প্রতীক। জাতীয় পতাকা মাথা উঁচু করে বিশ্বের কাছে দেশকে পরিচিত করে। আমরা কি দেখছি, সেই জাতীয় পতাকাকে আমরা মূল্যায়নের চেয়ে অবমূল্যায়নই বেশি করছি। তার কারণ হতে পারে দুই রকম। একটি হলো, পতাকার নিয়মকানুন না জানা এবং জেনেও না জানার ভান করে এড়িয়ে যাওয়া। দেখা গেছে, অনেক জায়গাতেই অসচেতনতার কারণে অনেক ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে। তবে এটি সত্য, জাতীয় পতাকা ব্যবহার রয়েছে সর্বোচ্চ প্রশংসনীয় পর্যায়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে মনিটরিং, নিয়মবিধি মানা হচ্ছে না, মানতে দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন সময় দেখা যায়, কোনো ধরনের নিয়মনীতি না মেনে একেকজন একেকভাবে পতাকা ওড়াচ্ছেন বা অর্ধনমিত রাখছেন। এ ক্ষেত্রে পতাকার রং, আকার-আকৃতি বা উত্তোলনের ধরনের মধ্যেও গরমিল দেখা যায়। আমার চোখে দেখা এখনো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বা বিভিন্ন জায়গায় পতাকা সঠিকভাবে টানানো হচ্ছে না। এমনকি সরকারি দপ্তরে অনেক সময় নিয়ম মানা হচ্ছে না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অনেক জায়গাই পতাকার মাপ এবং পতাকার সঙ্গে বাঁশ ব্যবহারেও রয়েছে অবহেলা। স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়ে গেলেও স্বাধীনতার অর্জন এবং বিশ্বের কাছে যে পতাকা দিয়ে দেশ পরিচিতি হচ্ছে সেই জাতীয় পতাকার মূল্যায়ন বা পতাকা ব্যবহার আমরা জানি না বা জানতেও চাই না। অথচ স্বাধীনতার বড় অর্জন এই জাতীয় পতাকার নিয়মণ্ডনীতি বা রক্ষা করা আমাদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দুঃখের আর লজ্জার বিষয় স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা আজও পতাকার সম্মান ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু কেন? পতাকার সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব যেমন নাগরিকদের, তেমনি সরকারসহ সরকারি সংশ্বিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও দায়িত্ব রয়েছে। শুধু আইন করেই শেষ নয়।

আমি মনে করি, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা টানানো এবং এর নিয়মনীতি বা আইন সম্পর্কে বাস্তবিক ধারণা দেওয়া, প্রতিটি সভা-সেমিনারের মাধ্যমে জাতীয় পতাকার গুরুত্বের বিষয় ধারণা দেওয়া, উঠান বৈঠকের মাধ্যমে জানানো, জাতীয় দিবসগুলোতে মাঠপর্যায়, উপজেলাপর্যায় জাতীয় পতাকার তদারকি করা। এ ছাড়া গণমাধ্যমে জাতীয় পতাকার ব্যবহারবিধি নিয়ে বেশি বেশি প্রচার এবং তথ্যমন্ত্রণালয় থেকে বেশি বেশি পোস্টার, লিফলেটের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো। এ ক্ষেত্রে শুধু সরকার বা প্রশাসন নয় জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। জাতীয় পতাকা ব্যবহারের একটি আইন আছে এবং সেখানে পতাকা অবমাননার শাস্তির বিধানও আছে। তাহলে কেন এত অবহেলা? এ থেকেই বোঝা যায়, শুধু আইন দিয়েই কাজ সম্পাদন করা সম্ভব নয়, মানসিকতার প্রয়োজন। তাই স্বাধীনতার মাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে আসুন আমরা জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান দেখাই। ঐতিহ্য ধরে রাখি, আমরা নাগরিক, জাতি ও রাষ্ট্র তা পালন করবে- এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close