ওসমান গনি
মুক্তমত
স্মার্ট সাংবাদিক স্মার্ট বাংলাদেশ

বিশ্বে চলছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও। নিজেদের স্বার্থ ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্চ মোকাবিলা করতে হবে, না হয় ছিটকে পড়তে হবে উন্নয়নের ধারা থেকে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তিনটি শিল্পবিপ্লব পাল্টে দিয়েছে সারা বিশ্বের গতিপথ ও মানুষের জীবনধারা। আমরা এক এক করে বিগত দিনগুলোতে আরো তিনটি শিল্পবিপ্লব অতিক্রম করে এ পর্যায়ে এসে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি। এখন আমরা ঢুকে গেছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যুগে। এখানেও আমাদের নিজেদের দক্ষতা ও কর্মকৌশলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। শিল্পবিপ্লব হলো কল-কারখানায় মানুষের লাগাতার অধিক সময় ও শ্রমের পরিবর্তে উন্নতি তথ্যপ্রযুক্তি বিদ্যার সাহায্যে অল্প সময়ে অল্প খরচে ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদনকে বলা হয় শিল্পবিপ্লব।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্রুত এবং আমূল পরিবর্তনকে সাধারণভাবে শিল্পবিপ্লব বলা হয়। শিল্পবিপ্লবে বাংলাদেশের প্রতিটি কল-কারখানায় এই আওতায় আসতে হবে। সংবাদপত্রও একটি শিল্প। সে হিসেবে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আওতায় আসতে হবে। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্মার্ট হতে হবে। বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্পে ও এর সঙ্গে জড়িত সব লোকবল বর্তমানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মধ্যে কাজ করছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সাংবাদিকদেরও স্মার্ট সাংবাদিক হতে হবে।
সাংবাদিকতা বিষয়টির সঙ্গে ইংরেজি ‘স্মার্ট’ শব্দটা যুক্ত বেশ আদিকাল থেকেই। সাংবাদিক মানেই তাকে স্মার্ট হতে হয়। তবে আগে সাংবাদিকদের স্মার্ট বলতে বোঝা যেত শারীরিক ও পোশাকপরিচ্ছদে স্মার্ট। কিন্তু বর্তমানে স্মার্ট সাংবাদিক হতে হলে আগের শারীরিক ও পোশাকপরিচ্ছদের স্মার্টের সঙ্গে কর্ম ও দক্ষতায়ও স্মার্ট হতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রগুলোও আগের এনালগ মনমানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যেমন : আগে সাংবাদিকরা বিশেষ করে মফস্বল সাংবাদিকের বেলায় ডাকযোগে এক দিন নিউজ পাঠালে ৪-৫ দিন পর অফিসে পৌঁছাত। এরপর ছাপা হতো। ছাপানো পত্রিকায় মফস্বল এলাকায় গিয়ে পৌঁছাত ১-২ দিন পর। তারপর মানুষ মন চাইলে পড়ত, না হয় সের মাপা বিক্রি হতো। কারণ তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার ছিল না। কিন্তু এখন তথ্যপ্রযুক্তি এতই শানিত যে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে কখন, কীভাবে সংঘটিত হয় তা মুহূর্তের মধ্যেই প্রচার ও প্রকাশ হয়ে যায়। মানুষ আর আগের মতো বসে থাকে না। মানুষের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। কেননা তাকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে হবে। হতে হবে প্রগতিশীল। নিজেকে নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। নতুন দক্ষতা অর্জন করতে হয়। এককথায় বললে, নতুন যেকোনো বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ থাকা ও তা নিয়ে প্রশ্ন করে যাওয়া সাংবাদিকের স্বভাবসুলভ আচরণ।
একজন সাংবাদিককে হতে হবে একটি মায়ের কোলের শিশুর মতো। শিশুর মধ্যে যেমন নতুন নতুন জানা ও শোনার আগ্রহ থাকে বর্তমানে স্মার্ট সাংবাদিকতা করতে এমন হতে হবে। একজন শিশু যেমন রাস্তায় বের হলে তার বাবা-মাকে অনবরত প্রশ্ন করে যায়, ‘এটা কী, ওটা কী, এটা কেন হলো, ওটা কীভাবে হলো?’ তেমনিভাবে একজন সাংবাদিক তার ঘর থেকে বের হওয়ার পর শিশুসুলভ প্রশ্ন করে যেতে হবে যেকোনো বিষয় নিয়ে। তখনই বের হয়ে আসবে অজানা তথ্য ও সংবাদ।
কিন্তু স্মার্ট সাংবাদিকতার যুগে শুধু নতুন তথ্য খুঁজে আনলেই চলছে না, মানুষ নতুন নতুন বিষয় দেখতে চাচ্ছে। অর্থাৎ লেখা সংবাদের থেকে মানুষ দেখতে বেশি পছন্দ করছে। যার জন্য বর্তমানে দেশের অধিকাংশ সংবাদপত্র এখন লেখা সংবাদের সঙ্গে ভিডিওর মাধ্যমে লেখা সংবাদের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরছে পাঠকের চোখের সামনে। এখন দেশের বেশির ভাগ সংবাদপত্র যুগের সঙ্গে টিকে থাকতে তাদের ধরনও পরিবর্তন করে ফেলছে। এখন পত্রিকায় সাংবাদিক নিয়োগ করলে আগে জেনে নেয় তার লেখার দক্ষতা, বাচনভঙ্গিসহ আরো অনেক কিছু। টেলিভিশন সাংবাদিকতার মতো ভিডিও সাংবাদিকতা করতে পারবে কি না। কারণ মানুষ এখন ব্যস্ত, সময় কম। মানুষ এখন চায় একের ভেতর সব। এজন্য সংবাদপত্রের সম্পাদকরাও পাঠকের উপযোগী করে একের ভেতর সব দিচ্ছে বা দেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রিন্ট পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতা থেকে শুরু করে বেশ কিছু পাতায় এখন নিয়মিত দেখা যাচ্ছে ‘কিউআর কোড’, যেখানে লিখিতি সংবাদটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি ভিডিও তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে পাঠকদের জন্য। ওয়েবসাইটগুলোতে যেখানে শুধু ফটোগ্যালারি ছিল, সেই স্থানটি দখল করে নিয়েছে ভিডিও গ্যালারি। অনলাইন সংবাদে যেখানে বেশি বেশি ছবি ব্যবহার করে উপস্থাপন করা হতো, তার বদলে বর্তমানে ভিডিও ও সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট এমবেড করে সাজানো হচ্ছে সংবাদ। পাঠকের সঙ্গে আরো বেশি মিথষ্ক্রিয়ায় এগিয়ে চলছে গণমাধ্যমগুলো। স্মার্ট বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত সংবাদমাধ্যম ও স্মার্ট সাংবাদিকদের ভূমিকা রাখতে হবে বেশি। কারণ যাদের সহযোগী হয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে তারা আমাদের বাংলাদেশ থেকে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। সেদিক লক্ষ করে সর্বাগ্রে সাংবাদিকদের সব সাইটে স্মার্ট বেশি হতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশের প্রতিদিনকার কার্যাবলি সংবাদমাধ্যম সবার আগে প্রকাশ করার মনমানসিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে।
একজন স্মার্ট সাংবাদিককে একই সঙ্গে ভালো প্রতিবেদক, ভালো সহ-সম্পাদক, ভালো ফটোগ্রাফার, ভালো ভিডিওগ্রাফার এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভিডিও এডিটরের কাজ করতে হবে। তবে দেশ ও বিদেশে উভয় স্থানে এমন সাংবাদিকদের এখনো বুলিংয়ের শিকার হতে হয় বাকি ‘মূলধারার’ সাংবাদিকদের কাছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
email- [email protected]
"