অনিল মো. মোমিন

  ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

চাষাবাদ

খাদ্যসংকট নিরসনে আঙিনা কৃষি

করোনা মহামারির স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টার মাধ্যমে গত বছরটি শুরু হয়েছিল। কিন্তু বৈশ্বিক নানা সংকটে সেটা দুরূহ হয়ে ওঠে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডলার সংকট ও আর্থিক খাতের নানা অসঙ্গতি অস্থির করে দেয় দেশের অর্থনীতিকে। ক্রমেই এই সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। আর এই সংকটে বড় প্রভাব পড়বে খাদ্যে এবং এর ব্যাপ্তি হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। করোনার পর এই সংকটের মূল কারণ বলা যায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, ইউক্রেন বিশ্বের ৪০ কোটি মানুষের খাদ্য জোগান দিতো কিন্তু যুদ্ধরত থাকায় তারা খাদ্যশস্য রপ্তানি প্রায় পুরোটাই বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে রাশিয়া দ্বিতীয় বৃহত্তম সার রপ্তানিকারক ও বড় শস্য উৎপাদক দেশ হলেও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় বিশ্ববাজারে তাদের পণ্যও ঠিকমতো আসছে না। এমন নানাবিধ সমস্যায় বিভিন্ন বৈশ্বিক সূচক ও বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে নীরব এক দুর্ভিক্ষ বয়ে যাবে।

বিষয়টি নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সবাইকে সতর্ক থাকতে তাগিদ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সবাইকে অনুরোধ করব কারো কোনো এলাকায় ১ ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। কারণ বিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হয়েছে- আমি যখন জাতিসংঘে গিয়েছি সেখানে অনেক দেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, সবাই খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যে, ২০২৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। আরো ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমি বলব আমাদের দেশের মানুষকে এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’ খাদ্য সংকট সবার জন্য বিপজ্জনক হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও গরিব অসহায়রা। বিশ্বজুড়ে খাদ্যসংকটের যে পূর্বাভাস তা সব দেশকে ভাবাচ্ছে। এই সংকট নিরসনে বিভিন্ন দেশ নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। কোনো কোনো দেশ আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিচ্ছে। কোনো কোনো দেশ বিশেষ বিশেষ পণ্যে রপ্তানিও সীমিত করছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বলা চলে এখনো কৃষিনির্ভর। কৃষি উৎপাদনের হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর অর্থনীতির গতি-মাত্রা পরিলক্ষিত হয়। অথচ দিন দিন কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অধিক জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান, রাস্তাঘাট নির্মাণ, ইটভাটা, কল-কারখানা কিংবা নগরায়ণে অধিগ্রহণের মতো নানা অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে কৃষিজমি। পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, প্রতি বছর ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে কোনো কৃষি জমি থাকবে না। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজন জমির সদ্ব্যবহার। যেহেতু দেশে ফসলি জমি কম তাই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র্র জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় ‘এক ইঞ্চি জমিও খালি রাখা যাবে না।’ আমাদের অফিস, বাসা কিংবা বাড়ির মধ্যে আনাচে-কানাচে অনেক জমি রয়েছে। এসব জমি অব্যবহৃত থাকে। ঘরের চালায়, বাড়ির উঠোন-আঙিনায় কিংবা বাসা-বাড়ির ছাদে এমনকি ঘরের বারান্দায়ও ফাঁকা জায়গা থাকে। শুধু বাড়ি নয়, সরকারি- বেসরকারি সব অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানার আঙিনায়ও বেশ খালি জায়গা থাকে। এসব খালি জায়গাগুলোকে নানা ধরনের ফল ও সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে কাজে লাগাতে হবে।

আদর্শ খাদ্যতালিকা অনুযায়ী, মাথাপিছু দৈনিক সবজি গ্রহণের কাঙ্ক্ষিত মাত্রা ৩০০ গ্রাম হলেও প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ ১৬৭ গ্রাম। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষি উইং, ২০১৬-২০১৭ অনুসারে মাথাপিছু ১২৫ গ্রাম সবজি সরবরাহ নিশ্চিত হচ্ছে। সংকটের আগে এরূপ পরিস্থিতি হলে সংকটকালীন কি হবে সেটা ভাবার বিষয়। আর তাই উপরে উল্লিখিত স্থানগুলোর সদ্ব্যবহার জরুরি। এসব স্থানে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা তরিতরকারি, ফলমূল ফলানো সম্ভব। আঙিনায়, ছাদে বা বারান্দায় লালশাক, ডাঁটাশাক, পুঁইশাক, কলমি, বেগুন, বরবটি, গিমাকলমি, ঢ্যাঁড়শ ও করলা, লাউ, উচ্ছে ও ধুন্দল, মিষ্টি কুমড়াসহ বিভিন্ন প্রকার শাকসবজি উৎপাদন করা যায়। এছাড়া বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, লেটুস পাতা, ধনেপাতা, মরিচসহ নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন মসলা যেমন- রসুন, তেজপাতা, ধনিয়া, মরিচ, আদা, হলুদ উৎপাদন করা যায়। আমাদের খাদ্যতালিকায় যে জিনিসটির ঘাটতি সবচেয়ে বেশি তা হচ্ছে ফলমূল। পুষ্টি চাহিদা পূরণে একজন মানুষের দৈনিক ১০০ গ্রাম ফল খেতে হয়। কিন্তু দেশে মাথাপিছু ফল গ্রহণের পরিমাণ মাত্র ৩৬ গ্রাম। এজন্য আমরা ওইসব স্থানে জাম্বুরা, করমচা, আতা ফল, নুনা ফল, চালতা, বেল, পেঁপে, পেয়ারা, বরই ইত্যাদি ফল গাছ লাগাতে পারি। এছাড়াও আঙিনা কৃষিতে বিভিন্ন ধরনের ফুলের মধ্যে গাদা, চেরিফুল, জবা, টগর, বকুল ফুলের গাছ লাগানো যায় যা মানসিক প্রশান্তি এনে দিবে। এসব ফলমূল, শাকসবজি উৎপাদনে খরচ কম ও লোকবল তেমন প্রয়োজন হয় না। পরিবারের সদস্যরাই অবসরে শ্রম দিতে পারেন। রাসায়নিক ও কীটনাশকের পরিবর্তে সহজে অর্গানিক পদ্ধতিতে উৎপাদন করা যায়। ফলে এগুলো বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। উৎপাদিত এসব ফসল পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে আবার বিক্রি করেও অর্থ উপার্জন করা যাচ্ছে। এতে বাজার নির্ভরতা কমে পারিবারিক সমৃদ্ধি আসে।

এমন নানাবিধ সুবিধার জন্য ক্রমেই আঙিনা কৃষিতে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ইঞ্চি জমি ব্যবহারের বার্তাটি মানুষের মধ্যে আঙিনা কৃষির গুরুত্ব আরো বাড়িয়েছে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান বাস্তবায়নে উপজেলা কৃষি অধিদপ্তরের সহযোগিতায় অনাবাদি পতিত জমি ও বসত বাড়ির আঙিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রকল্প স্থাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতায় উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে সবজির বীজ, জৈব ও অজৈব সার, বীজ উৎপাদন, বাঁশ খুঁটি দিয়ে সবজির বাগান তৈরিসহ যাবতীয় খরচ বহন করছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে কুষ্টিয়ার মিরপুরের কথা। মিরপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের বসতবাড়ির আঙিনায় ৪১৬টি পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন করা হয়েছে। এই পরিবারগুলো যথেষ্ট লাভবান হয়েছেন। কৃষি অধিদপ্তরের এমন সহযোগিতায় সাড়াও মিলছে বেশ। সুবিধাভোগী আরেকটি পরিবারের কথা বলতে পারি। ঢাকার ধামরাইয়ের ফরহাদ হোসেন। তিনি বংশী নদীর পাড়ে বসতবাড়ির উঠানে প্রায় এক বিঘা জমির ওপর পারিবারিক সবজি বাগান গড়ে তুলেছেন। বাড়ির সামনে পতিত ও অনাবাদি জমিতে মাটি ফেলে জায়গা ভরাট করে সবজি চাষ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন তিনি। তার স্ত্রী শাহিদা বেগমও নিয়মিত সবজি বাগান দেখাশোনা করেন। নিজের পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনদেরও প্রায় প্রতিদিন সবজি দিয়ে থাকেন। আঙিনা কৃষির অনুপ্রেরণার আরেক নাম হতে পারে বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন। যিনি তার বাসার আঙিনা ফুল, ফল আর নানা সবজিতে ভরে ফেলেছেন। তার আঙিনা দেখেই মনে হবে এ যেন কৃষকের কোনো ভরা খেতে সোনার ফসলে ভরপুর মাঠ! শহুরে জীবনেও যে আঙিনাকৃষি সম্ভব তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও মি. ডিসকনকে বলা যায়। কৃষি সাংবাদিকতার পুরোধা ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসনের আঙিনাকৃষির যে দৃশ্য আমাদের কাছে তুলে এনেছেন তা নিঃসন্দেহে আমাদের শহুরে জীবনে অনন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

আঙিনাকৃষিতে স্বল্প খরচে উৎপাদিত শাকসবজি ফলমূলে বিভিন্ন রকমের ভিটামিন, খনিজ লবণসহ বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। যেগুলো আমাদের সুস্থ, সবল এবং রোগমুক্ত রাখার জন্য খুব বেশি দরকার। অন্যদিকে বাজারের স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ ও ভেজালযুক্ত সবজি, ফলমূলও গ্রহণ করতে হচ্ছে না। শহর ও গ্রামে বেগবান হোক আঙিনাকৃষি। কাটুক খাদ্যসংকট, আসুক পারিবারিক সমৃদ্ধি এমনটাই প্রত্যাশা।

লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close