ড. মিহির কুমার রায়

  ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

সর্বজনীন পেনশন স্কিম

একটি মানবিক উদ্যোগ

গত ২৪ জানুয়ারি ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল-২০২৩’ সংসদে পাস হয়েছে। ফলে ৬০ বছর পর আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন নাগরিকরা। সর্বজনীন পেনশন সুবিধা পেতে ১৮-৫০ বছর বয়সি নাগরিকদের নির্ধারিত হারে চাঁদা পরিশোধ করতে হবে এবং বিশেষ বিবেচনায় পঞ্চাশোর্ধ্বরাও এই আইনের আওতায় নিরবচ্ছিন্ন ১০ বছর চাঁদা পরিশোধ করে পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে স্কিমে অংশগ্রহণের তারিখ থেকে নিরবচ্ছিন্ন ১০ বছর চাঁদা প্রদান শেষে তিনি যে বয়সে উপনীত হবেন, সে বয়স থেকে আজীবন পেনশন প্রাপ্য হবেন। আজীবন বলতে পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত বিবেচনা করা হয়েছে। বিলে আরো বলা হয়েছে, পেনশনে থাকাকালীন কোনো ব্যক্তি ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তার নমিনি অবশিষ্ট সময়ের জন্য (মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে মারা গেলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। পেনশন তহবিলে জমা দেওয়া অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন তোলার প্রয়োজন পড়লে চাঁদাদাতা আবেদন করলে জমা দেওয়া অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে তুলতে পারবেন, যা ফিসহ পরিশোধ করতে হবে।

জাতির এই মাহেন্দ্রক্ষণে সর্বসাধারণের জন্য পেনশন স্কিমের উদ্যোগ সরকারের দূরদর্শী চিন্তার একটি সফল প্রতিফলন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন ছিল বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। জাতির পিতার অসমাপ্ত স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক সময়ে সর্বসাধারণের জন্য যে পেনশন ব্যবস্থা প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছেন যা প্রশংসনীয় ও সময় উপযোগী উদ্যোগ। এটি দেশের সামগ্রিক সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যে সরকার এরই মধ্যে কৌশলপত্র তৈরি করেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করতে গিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ ব্যাপারে সরকারের চিন্তা-ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বর্তমান অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের অবহিত করলেন যে, আগামী এক বছরের মধ্যে চালু হতে যাচ্ছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা। অর্থমন্ত্রী এই ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য যেসব বিষয় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করেছেন সেগুলো যদি স্বচ্ছতা ও বিধির মাধ্যমে চালু করা যায় তাহলে সমাজ জীবনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয়ভাবে একটি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে সরকার কর্র্তৃক প্রণীত জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রে একটি ব্যাপকভিত্তিক সমন্বিত অংশগ্রহণমূলক পেনশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছিল। গত ২০ জুন সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন ২০২২-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। ১৮-৫০ বছর বয়সিরা এই পেনশন স্কিমের আওতায় আসবে। তবে এর বেশি বয়সিদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা রাখার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ৬০ বছরের পর থেকে এ পেনশন কার্যকর হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে নির্ভরশীল মানুষের বর্তমান হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে যথাক্রমে ২৪ শতাংশ এবং ২০৭৫ সালে ৫৮ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে। ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে সরকারি চাকরি করছেন মাত্র ১৪ লাখ মানুষ। এসব সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তার পেনশন সুবিধা রয়েছে। বাকি ১৮-৫০ বছরের বেশির ভাগ মানুষ কৃষি, বেসরকারি খাত, ব্যবসায়ী কিংবা অন্যান্য পেশায় জড়িত রয়েছেন। এদের কোনো পেনশন সুবিধা নেই। তাই সব মানুষকে পেনশনের আওতায় আনতেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত। ১৮-৫০ বছর বয়সের যে কোনো কর্মক্ষম নাগরিক পেনশন সুবিধার আওতায় আসবেন, প্রবাসীরাও বাদ পড়বেন না। শুধু ব্যক্তিপর্যায় নয়, প্রতিষ্ঠানও অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। ব্যবস্থাটির আওতায় গ্রাহক যে পরিমাণ টাকা মাসিক বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জমা দেবেন তার সমপরিমাণ টাকা দেবে সরকার, জমাকৃত অর্থ বিনিয়োগ করে যে লাভ অর্জিত হবে তারও হিস্যা পাবেন গ্রাহক। পরে প্রাপ্তিযোগ্য বয়সে মাসিক ভিত্তিতে পেনশন হিসেবে প্রদান করা হবে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ। নিম্নআয়ের মানুষের মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দেবে। প্রাথমিক পর্যায়ে কর্মসূচিটি ঐচ্ছিক, পরে তা বাধ্যতামূলক হবে। ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ’ নামে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করে একে সমুদয় কার্যাদি দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হবে।

নিজেদের করা একটি প্রক্ষেপণের সূত্র ধরে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান গড় আয়ু ৭৩ বছর থেকে ২০৫০ সালে ৮০ বছর এবং ২০৭৫ সালে ৮৫ বছরে গিয়ে ঠেকবে। অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে, যার অন্য অর্থ হলো কর্মে অক্ষম নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়বে। পরিবারের অবহেলা থেকে বাঁচানোর তাগিদ থেকে রাষ্ট্রকেই পাশে দাঁড়াতে হবে প্রবীণদের। এতদিন কেবল সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় কর্মরতরা এই পেনশন সুবিধা ভোগ করতেন, যারা মোট জনসংখ্যার অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ। সুবিধা সম্প্রসারিত হয়ে যদি সাধারণ মানুষ পর্যন্ত গড়ায় তো এটি সন্দেহাতীত ভালো খবর।

বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোতে দারিদ্র্যের হার হ্রাস আশাব্যঞ্জক হয়েছে, কিন্তু করোনা পরিস্থিতির প্রভাবে আবার অতিদারিদ্র্য এবং সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এখন সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে চরম দারিদ্র্য তথা সার্বিক দারিদ্র্যের হার যাতে পুনরায় বৃদ্ধি না পায় তা যথার্থভাবে মোকাবিলা করা। আর এক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ সরকারের আরো কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলমান। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কখনো কখনো সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কারো কারো বিরুদ্ধে অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে। অনেক ভালো উদ্যোগ অনিয়মণ্ডদুর্নীতি-অস্বচ্ছতার কারণে মুখ থুবড়ে পড়ার নজিরও আমাদের সামনে রয়েছে। বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি যেগুলো চলমান, সেগুলোর বেশির ভাগই বয়স্ক-দরিদ্রদের জন্য যার কোনোটিই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সেই অর্থে নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। সরকার ঘোষিত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা যে বিশাল কর্মযজ্ঞ- এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল আন্তরিক রয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়, যদিও মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দূরদর্শী পরিকল্পনা ও এর সফল প্রয়োগ জরুরি। ক্ষুদ্রাকৃতির একটি দেশে বিপুল আয়তন জনগোষ্ঠী এই বাস্তবতা স্বভাবতই অসংখ্য সমস্যার জন্ম দেবে। সেসব মাথায় রেখেই এগোতে হবে এবং আমাদের মনে রাখতে হবে অপরিকল্পিত উন্নয়ন, নদীভাঙন ইত্যাদি রোধ করা না গেলে ভূমিহীন-আশ্রয়হীনের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়বে, সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কুলাতে পারবে না।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। আর এদেশের সিংহভাগ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। দেশের মানুষ কৃষকের ওপর নির্ভরশীল। যে দেশের কৃষকরা রোদণ্ডবৃষ্টি উপেক্ষা করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাঠে ফসল ফলিয়ে মানুষের মুখের অন্ন জোগায়, সে দেশের কৃষকরা পায় না কোনো মর্যাদা, উৎপাদিত ফসলের কোনো ন্যায্যমূল্য দেওয়া হয় না। পেনশন স্কিমটি যে প্রক্রিয়াই হোক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে ১ বছরের মধ্যেই চালু করে দেশে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, যে কোনো চাকরি শেষে তাদের পেনশন ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতার মতো- কৃষকের নামে ভাতা চালুর দাবি রইল। হয়তো অনেকে বলবেন যে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা তো কৃষকের মধ্যেই পেয়ে থাকে। কিন্তু না, কৃষক পেনশন ভাতা আলাদাভাবে চালু করতে হবে। কারণ ষাটোর্ধ্ব বয়সি যেসব কৃষক তারা না পারে কোনো চাষ কাজ করতে, না পারে অন্যকিছু করে জীবিকা রক্ষা করতে। তাই তাদের বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন দরকার। সম্প্রতি কৃষক প্রতিনিধিদের এক গোলটেবিল বৈঠক থেকে দাবিটা উঠে এসেছিল। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার সঙ্গে কৃষক পেনশন ভাতা চালু হলে তা হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বর্তমান সরকারের শ্রেষ্ঠ উপহার।

লেখক : গবেষক ও অর্থনীতিবিদ; ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি।

mihir.city@gmail

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close