ওসমান গনি

  ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

বিশ্লেষণ

শিশুদের অধিকার রক্ষায় করণীয়

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এ স্লোগানকে সামনে রেখে শিশুদের অধিকার রক্ষায় আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। দেশের সব শিশুকে সমানভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে। বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গিয়ে তাদের সামনে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় বা হবে তা আমাদেরকে দূর করতে হবে, যাতে শিশুরা বেড়ে ওঠার সময় তারা আঘাত-প্রতিঘাত দ্বারা বাধাগ্রস্ত না হয়। সুন্দর ও সামাজিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ তাদেরকে করে দিতে হবে। শিশুরা ছোটকাল থেকে সুন্দর ও সুস্থ সামাজিক পরিবেশে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারলে তার ভবিষ্যৎ জীবন হবে সোনালি দিনের মতো। আর তাদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব নিতে হবে তাদের অভিভাবকদের, যাতে কোনো শিশুই ছোটকালে বিপথগামী না হয় সেই খেয়াল রাখতে হবে। শিশুদের নিরাপত্তার জন্য অভিভাবকদের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবেও তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে আমাদের দেশে শিশুদের শিশুদের নিরাপত্তার যে আইন আছে প্রয়োজনবোধে তা আরো কঠোর করতে হবে। এবং শিশু আইনের যাতে সঠিক প্রয়োগ হয় তার তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে কোনো শিশুই আমাদের দেশের নিরাপত্তার অভাবে বিপথগামী না হয় সে ব্যাপারে আমাদের দেশের সকল পেশাশ্রেণির মানুষকে সচেতন থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে শিশুদের নিরাপত্তার জন্য আইন আছে, আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ার কারণে অব্যাহতভাবে শিশুদের ওপর নির্যাতন বেড়েই চলেছে। হরণ করা হচ্ছে বিভিন্নভাবে শিশুদের অধিকারও। বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও এখনো বহু দেশে তা চালু আছে। আমাদের দেশেও শিশুশ্রম পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।

আমাদের দেশে এখনো শিশুরা বাসাবাড়ি, হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকানপাট, শিল্পকারখানা সহ বিভিন্ন যানবাহনে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। অথচ শিশুদের লেখাপড়াসহ তাদের অন্নবস্ত্র ও বাসস্থানের সুব্যবস্থা থাকা খুবই জরুরি। এ শিশুরা যদি পড়ালেখা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান ও অন্ন-বস্ত্রের নিশ্চয়তা না পায় তারা কীভাবে বেড়ে উঠবে? শিশুদের এসব অধিকার নিশ্চিত করা দূরে থাক, আমাদের এ নিষ্ঠুর সমাজে তাদের প্রকাশ্যে পিটিয়ে, ছ্যাঁকা দিয়ে, এমনকি নিভৃত ঘরে বন্দি করে রেখে দানাপানি না দিয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার মতো অমানবিক ঘটনা ঘটছে আমাদের দেশসহ পৃথিবীর আরো অনেক দেশে। এ যে কত বড় নিষ্ঠুর ও লজ্জাজনক, তা ভাবলে দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের গা শিউরে ওঠে। এ অবস্থা থেকে শিশুদের রক্ষা করা খুব জরুরি।

শিশুর মানবাধিকার এবং অধিকার অর্জন করতে সব দেশের সরকারকে যে নিরিখগুলো অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। সেগুলো খুব সংক্ষেপে অথচ সম্পূর্ণভাবে বিবৃত হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিতে। এটি হলো শিশু

অধিকার সনদ। এ সনদ ইতিহাসের সবচেয়ে সর্বজনীন মানবাধিকার দলিল। তাই এ দলিল মানবাধিকারের সর্বজনীন প্রয়োগ অন্বেষায় অনন্যভাবে শিশুদের মধ্যমণি করে তুলেছে। দলিলটি অনুমোদনের মাধ্যমে জাতীয় সরকারগুলো শিশুদের অধিকার রক্ষা ও নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে এবং এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের

কাছে নিজেদের দায়বদ্ধ করে তুলেছে। বৈচিত্র্যপূর্ণ আইন ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আলোকে তৈরি শিশু অধিকার সনদটি সর্বজনীনভাবে গৃহীত কিছু অবিনিময়যোগ্য নিরিখ ও দায়দায়িত্বের সমাহার। এতে বর্ণিত রয়েছে শিশুরা সর্বত্র বৈষম্যহীনভাবে ভোগ করতে পারে এমন কিছু মৌলিক মানবাধিকার। এর মধ্যে রয়েছে শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার, পূর্ণ মাত্রায় বিকাশের অধিকার, কুপ্রভাব, নির্যাতন ও শোষণ থেকে নিরাপদ থাকার অধিকার এবং পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে পুরোপুরি অংশগ্রহণের অধিকার। সনদে বর্ণিত প্রতিটি অধিকার প্রত্যেক শিশুর মানবিক মর্যাদা ও সুষম বিকাশের জন্য অপরিহার্য। স্বাস্থ্য পরিচর্যা, শিক্ষা ও আইনগত, নাগরিক ও সামাজিক সেবা প্রদানের মান নির্ধারণের মাধ্যমে এ সনদ শিশুদের অধিকার সংরক্ষণ করে থাকে।

এছাড়া আমাদের অনেক শহর ও বন্দর ছাড়াও গ্রামাঞ্চলে শিশুরা একা একা স্কুলে যায়। মাঠে খেলে বেড়ায়। প্রায়ই অভিভাবক থাকেন না শিশুর সঙ্গে। ফলে একশ্রেণির দুর্বৃত্ত শিশুদের অপহরণ করে বিদেশে পাচার করে দেয়। শিশুদের স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে অথবা তাদের সুবিধামত স্থান থেকে অপহরণ করে নিয়ে আটকিয়ে রেখে অভিভাবকদের কাছ থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করে। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে শিশুদের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। কখনো কখনো

তা আদায় সম্ভব না হলে অপহৃত শিশুর ওপর নির্যাতন চালিয়ে হত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটানো হয়। আবার শিশুশ্রমের কাজ করতে গিয়ে এরা কখনো কখনো কলকারখানায় দুর্ঘটনায় পড়ে মারা যায়।

শুধু তা-ই নয়, আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানুষ নামের জানোয়ার মিথ্যা চুরির অভিযোগ দিয়ে শিশুকে ধরেবেঁধে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে আমাদের এ সমাজে। যার জলন্ত প্রমাণ সিলেটের শিশু রাজন। শিশু রাজন হত্যার ঘটনাটি এখনো আমাদের এ সমাজের দগদগে ক্ষতচিহ্ন হয়ে মানুষের চোখে চোখে ভাসছে। এমন ঘটনা শুধু একটি বা দুইটি নয়। আরো অনেক ঘটছে। এসবের কোনো কোনোটি মিডিয়ার বদৌলতে বিচারের আওতায় এলেও অনেক ঘটনা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। বিচারের দোরগোড়ায় যেতেও পারে না শিশু অধিকার হরণসহ নির্যাতনের অনেক ঘটনাই। নির্যাতনের ফলে অপমৃত্যুর শিকার শিশুর অভিভাবকরা অনেকে জানেনও না এর বিচারের জন্য কোথায় এবং কীভাবে যেতে হয়।

যাই হোক, বর্বর অমানবিক শিশু নির্যাতন সভ্য সমাজে চলতে পারে না। চলতে দেওয়া যায় না। এ ব্যাপারে অভিভাবক, শিক্ষক, সমাজকর্মী, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। শিশুর অধিকার হরণ কিংবা এদের ওপর জুলুমণ্ডনির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে সবাইকে। শিশুর অধিকার হরণ কিংবা কোনো অমানবিক ঘটনা দেখলেই তা অবিলম্বে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে খবর দিয়ে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। অতীতে আমাদের দেশে যেসব শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর সঠিক বিচার হলে শিশু নির্যাতনের মাত্রা কমে আসবে বলে দেশের বিজ্ঞমহল মনে করেন। আজকে যারা শিশুকালকে তারা হবে দেশের কর্ণদ্বার বা রাষ্ট্র পরিচালক। তাই এখন থেকে আমাদের দেশের প্রতিটি নাগরিক কে শিশুদের প্রতি হতে হবে সহনশীল। এবং তাদের কে আগাগী দিনের রাষ্ট্রপরিচালক হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের কে আগামী দিনের জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলা আমার ও আপনার সবার দায়িত্ব। বিশেষ করে শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে প্রতিটি শিশুর অভিভাবককে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ববান হতে হবে। শিশুদের প্রধান কাজ হলো লেখাপড়া করা। তাই প্রতিটি শিশুর অভিভাবককে শিশুদের স্কুল চলাকালে কোনো কাজে পাঠানো যাবে না। শিশুরা সঠিক সময়ে স্কুলে যায় কিনা তা অভিভাবকদের কে খোঁজখবর নিতে হবে। স্কুলের শিক্ষকদের সাথে শিশুর লেখাপড়ার ব্যাপারে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হবে। লেখাপড়ার পাশাপাশি তাদের কে খেলাধুলা করাসহ বিভিন্ন রকমের বিনোদনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কারণ যে শিক্ষার সাথে বিনোদনের কোনো সম্পর্ক নাই সে শিক্ষা কখনো প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। তাই লেখাপড়ার সাথে সাথে বিনোদনও বাধ্যতামূলক।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close